সেবার আমরা দার্জিলিং যাব। তো আজ মিটিং, কাল সিটিং, পরশু বাজেট তৈরি, দিনক্ষণ ইত্যাদি ঠিক করায় সবাই মাতোয়ারা।
যাইহোক, একদিন আমি একটা ভুল করে বসলাম, এবং ভ্রমণের টিম মিটিং এ সিদ্ধান্ত হল, ভুলের জন্য সবাইকে খাওয়াতে হবে! ঠিক আছে, সবাই যেহেতু বলেছে, আমি অবশ্যই খাওয়াবো। তো বললাম, আমি এখন খাওয়াবো না, আমাদের ভ্রমণের সময় এক বেলায় সবাইকে খাওয়াবো… তাতে করে, সবার একবেলার খরচ বেঁচে যাবে! বাহ! চমৎকার প্রস্তাব… সবাই সম্মত…
এবার আমি প্রস্তাব রাখলাম…
যেহেতু, আমার এই ভুলের জন্য শাস্তি স্বরূপ জরিমানা ধার্য করা হয়েছে, সেহেতু, এই রকম ভুল আর কেউ করলে এবং মেজরিটি মেম্বাররা যদি ভোট দেয়, তবে তাকেও একবেলা খাওয়াতে হবে?
সবাই আমার প্রস্তাবে রাজ হল। কিন্তু, কোন বেলা খাওয়াবে, সেটা ঠিক হলনা। উল্লেখ্য, আমাদের টিম লিডার সবসময়ই ভ্রমণের শেষ ডিনার টা স্পন্সর করে থাকেন এবং সেটাই পুরো ভ্রমণের সেরা খাওয়া হয়ে থাকে।
তো এটা তো আছেই, ভুলের জন্যও ক্ষমা নেই! আরও একবেলা খাওয়াতে হবে! সেও রাজী… সুতরাং শুরু হল, একে অন্যের ভুল ধরা এবং মিটিং এ তুলে, একবেলার খাবার দেয়াতে রাজী করানোর নতুন যুদ্ধ!
যাইহোক, এভাবে… প্রায় ৬ বেলার খাবার জরিমানা হয়ে গেল বিভিন্ন জনের। একজন কে কোন ভাবেই ভুল করাতে পারলাম না! কারণ তিনি খুব কম টিম মিটিং এ থাকেন! সুতরাং ভুলও কম করেন।
তো আমার প্রস্তাব ছিল, যেহেতু, তিমি টিম মিটিং এ কম থাকেন, সেহেতু, এটাকেই একটা কারণ ধরে জরিমানা আদায় করা হোক! কিন্তু, আমাদের টিম লিডার প্রস্তাবে সায় দিলেন না!
আমরা ভ্রমণ শুরু করলাম। আমাদের সবার একটা অন্যতম কাজ অন্যের ভুল ধরা! আর কত কম খরচে যার যার জরিমানার বেলাটা পার করা যায় সেটা!
বেশ ভোরে বুড়িমারি পৌছালাম। ইমিগ্রেশন পার হবার আগে সবাই ফ্রেস হতে গেল। আমি বিভিন্ন হোটেলে খাবারের দাম দেখছি! যে তিন-চারটা আছে সেগুলোর।
মোটামুটি ভালো, আর দামেও বেশ সস্তা! খোঁজ নিয়ে রাখলাম, কিন্তু প্রস্তাব দিলাম না! কারণ, দাম জেনে এটা আপ্রুভ করবেনা জানি! তাই কিছুই বললাম না, সবাই এসে, দু-একটা হোটেলে খোঁজ নিয়ে, অবশেষে বুড়ির হোটেলকেই বেছে নিল।
আমি মৃদু আনন্দিত! এই ভেবে যে কেউই দামের খোঁজ নেয়নি! তো গরম গরম ভাত, পাতলা কিন্তু সুস্বাদু ডাল, শুকনা মরিচ আর সরিষার তেলের মিশ্রণে মজাদার আলুভর্তা সাথে ডিম ভাজি দুজন একটা করে! খাবার শেষ মুহূর্তে, আমি টিম লিডার কে উদ্দেশ্য করে অন্য সবাইকে প্রস্তাব দিলাম।
যে এই খাবারের বিলটা আমি দিতে পারি কিনা? টিম লিডার রাজী এবং অন্য সবাইও সানন্দে রাজী হয়ে গেল! আমি তো মনে, মনে “ ওই বাল্লে, বাল্লে” গান ধরলাম! সবাই ধরে নিয়েছিল, আদৌ কেউ খাওয়াবে কিনা? ওর টাতো আগে খাই! আমি বিল দিলাম। বিল দিয়ে তো আমি আরও জোরে দুই হাত উপরে তুলে সিংদের সেই গান ধরলাম!
“ওই বাল্লে-বাল্লে, ওই বাল্লে-বাল্লে!”
যাই হোক, সবাই তো আমার উপর বেশ চড়াও! আমি বাটপারি করিয়াছি অভিযোগ দিয়া! এত কম টাকায়, আমার জরিমানা শোধ করিয়াছি বলিয়া! কিন্তু, আমাদের টিম লিডার সবাইকে বলিলেন, আমি তো কাউকে জোর করিনি, প্রস্তাব দিয়াছি মাত্র! সবাই মেনে নিয়েছে! সুতরাং এটা নিয়ে আর কোন কথা নয়! সবাইকেই খওয়াতে হবে! এবার সকলে ধরলও, আমি যেহেতু কম খরচে সকালে খাইয়েছি, তারাও সকালে খাওয়াবে! ঠিক আছে, সবাই রাজি!
শুরু হল প্রতি সকালে, এক এক জনের খাওয়ানো…
উল্লেখ্য, ভ্রমনে আমরা সবসময়ই সকালে সবচেয়ে বেশী এবং ভালো খাবার চেষ্টা করি। দুপুরে একেবারেই হালকা কিছু খাই। আর রাতে আবার ভালো খেয়ে থাকি। যে কারনে, এর পরের প্রতি সকালের খরচ আমার খরচের চেয়ে প্রায় তিন বা চার গুন! এতে করে সবাই আমার উপর আরও বেশী ক্ষিপ্ত!
কিন্তু, একজন, এখনো জরিমানার বাইরে! সুতরাং, আমার নজর তার উপর, কখন কোন ভুল করে, যেটা সবাই জরিমানা হিসেবে গন্য করবে!
তো এক সকালে… দার্জিলিং এর মল রোডে! (ম্যাল নয়! সে গল্প অন্য দিন!) নাস্তার টেবিলে… লুচি, আলুরডাল দিয়ে নাস্তা করছি। এখানে যেহেতু ডিম নেই, সেহেতু আমি মিষ্টি খাব। গরম, গরম রসগোল্লা এসেছে!!
উল্লেখ্য, সকল মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যের মাঝেই গরম রসগোল্লা আমার সবচেয়ে প্রিয়। যারা গরম রসগোল্লা চেখে দেখেছেন, তারা মাত্রই জানেন, এর কি অমৃত স্বাদ! এবং একই সাথে অনেক গুলো খাওয়া যায়! আমি ৬-৮ টা খেয়ে নিলাম! অন্যরাও অর্ডার দেবে… এই সময়…
দোকানি আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, গরম, গরম লালমোহন এসেছে… দেবে কিনা?
সবাই আগ্রহ ভরে, লালমোহন চাইল এবং অনতিবিলম্বে পেয়ে গেল।
এইবার… যিনি এখনও জরিমানার স্বীকার হননি, তিনি… হ্যাঁ তিনিই…..
দোকানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওনাকেও লালমোহন দিতে। যথারীতি, দোকানিও লালমোহন দিলেন।
কিন্তু……??? উনি আসলে খাবেন রসগোল্লা!!!


তাই দোকানিকে উদ্দেশ্য করে, ওনার প্লেটে চোখ রেখে আর আমার প্লেটের দিকে আগুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন…
“আমি এইটা না! এইটা না!! আমি লালমোহন সাদাটা চাইছি..!!!!”
দুই বা তিন সেকেন্ড হবে হয়তো…আমরা সবাই একইসাথে হতভম্ব! স্তব্ধ! বাঁকরুদ্ধ!! হইয়া, হাসিতে ফাটিয়া পরিলাম! পেটে ব্যাথা ধরিয়া গেল! হাসিতে, হাসিতে কারো, কারো বিষমও লাগিল!
আর দোকানির অভিব্যাক্তি?? তাহার কথা আর না বলি! দেখার মত ছিলো বটে! বেশ কিছুক্ষণ পরে, তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি কি বলেছেন? কি চেয়েছেন? আর কি করেছেন? টিমের সবাই সাথে, সাথে সমস্বরে তার জরিমানা ঘোষণা করলো! এবং ভ্রমণের পরবর্তী সময় গুলোতে তাকে আমরা ওই নামেই ডাকতে লাগলাম…
“লালমোহন সাদাটা!!”
কাণ্ড, এখানেই শেষ নয় আরও আছে চলুন দেখি সেটা কি? এরপর, আমরা জরিমানা চাই আর তিনি বিভিন্ন অজুহাতে পিছিয়ে দেন। আমরাও নাছোড় বান্দা, তাকে ধরে থাকি জরিমানা পরিশোধের জন্য, তিনি কথা দিলেন…
তিনি ভ্রমণের শেষ সকালে নাস্তা করাবেন, আমরাও নিশ্চিত হয়ে খান্ত দিলাম…
শেষ ভ্রমণ সকাল এলো… দার্জিলিং থেকে বেরিয়েছি… পথিমধ্যে… একটি বেশ মনোরম রেস্টুরেন্ট। খাবারের দাম ও সর্বমোট কত লাগবে জেনে, তিনি, টিম লিডার কে ম্যানেজ করলেন…যে এখন নয়, ও… বুড়ির হোটেলে খাওয়াবে!!
যেহেতু আমার খরচ নিতান্তই কম হয়েছিল…
আমরা নিমরাজী হয়েই টিম লিডারের কথা মেনে নিলাম, কিন্তু, কে জানত? এখানেও সে সবচেয়ে বড় স্বীকারে পরিনত হবে!
বিকেলে বুড়ির হোটেলে এলাম। সবাই ভীষণ, ভীষণ ক্লান্ত। ৬ দিনের বাঙালি খাবার না খাওয়ার ক্ষুধা, ভেত বাঙালীর ভাতের জন্য আকুলতা আর গ্রাম্য দেশী মুরগীর অর্ধ কাঁচা পেঁয়াজ আর মশলার সমন্বয়ে গরম, গরম সদ্য নামানো প্রায় রোষ্ট!!
সবাই পাগলের মত খেল! কেউ, কেউ দুটো রোষ্টও খেল! তারপর যে বিল উঠেছিল, তা দেখে সে…অধিক শোকে মাননীয় স্পীকার হয়ে গিয়েছিলেন!