এইবার শীতের স্কুল হলি’ডেতে আমরা গিয়েছিলাম পাফিং বিলিতে। আজ আপনাদের সঙ্গে সেই দিনের চমৎকার অভিজ্ঞতাটা ভাগাভাগি করতে চাই এই লেখায়।
স্কুল হলি’ডেগুলো আসলেই আমরা যারা বাবা-মা, তাদের অনেক চিন্তার মাঝে আরো একটি চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে বাচ্চাকে বা বাচ্চাদের এই বন্ধে কোথায় নিয়ে যাবো বেড়াতে। অনেকেই হয়তো ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেন কাজ থেকে এবং দূরে কয়েকদিনের জন্য বেড়িয়ে আসতে পারেন, আবার অনেকেই কাছাকাছি কিছু খুঁজতে থাকেন যেটা হয়তো একদিনেই বেড়িয়ে আসা যায়। আবার ২০২০ থেকে আমাদের বিশেষ করে আমরা যারা ভিক্টোরিয়াবাসী তাদের যাপিত জীবনে লোকডাউন কথাটা যেন একটা সঙ্গী হয়ে গিয়েছে। পরিকল্পনা মাফিক কোনো আয়োজন বা ভ্রমণ বা নিমন্ত্রণ আমরা ভিক্টোরিয়াবাসী ২০২০ থেকে করতে পারিনি। অনেকেই তাই শেষমুহূর্তে হলি’ডে বাতিল হওয়ার চেয়ে কাছাকাছি কোথাও যেতেই বেশি পছন্দ করছেন। এমনি একটি জায়গা পাফিং বিলি, যা মেলবোর্নে মেট্রোপলিটনের যেকোনো জায়গা থেকেই একদিনের ভ্রমণের জন্য চমৎকার একটি স্থান।
কোথায় ও কতদূর:
পাফিং বিলি মেলবোর্নের না শুধু সমগ্র অস্ট্রেলিয়া পুরাতন বাষ্পইঞ্জিন রেললাইনগুলোর একটি, যা ভিক্টোরিয়ার গ্রেট ডান্ডিনং রেঞ্জ অঞ্চলের বিশাল সবুজ বনজুড়ে আছে। মেলবোর্ন শহর থেকে মাত্র ৬০ মিনিট/১ ঘন্টা ড্রাইভিং দূরত্বে এই পাফিং বিলি। গ্রেট ডান্ডিনং রেঞ্জের রেইনফরেস্টের গাঢ় সবুজ ফার্ন আর বড় বড় গাছের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে পাফিং বিলির লাইন। পর্যটক বা দর্শনার্থীরা চাইলে শুধু বেলগ্রাভ স্টেশন থেকে উঠেও পাফিং বিলিতে ভ্রমণ উপভোগ করতে পারে, অথবা লেকসাইড স্টেশন থেকে চড়ে পাহাড়ের মাঝদিয়ে ও আইকনিক কাঠের ট্রেস্টল সেতুর উপর দিয়ে জেমব্রুক স্টেশনের আশেপাশের খোলা খামার মাঠের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারে। । স্টেশনেও পানীয় এবং লাঞ্চ প্যাক পাওয়া যায়, অথবা আপনার খাবারের প্রি-অর্ডার করে ভ্রমণের মাঝে ট্রেনের কামরায়ও আপনি উপভোগ করতে পারেন আপনার খাবার সঙ্গে গ্রেট ডান্ডিনং রেঞ্জের রেইনফরেস্টের মনোরম দৃশ্য। প্রিয়জনকে বা সন্তানকে নিয়ে বাকি সময় স্মৃতি তৈরিতে কাঁটিয়ে দিতে পারবেন গ্রেট ডান্ডিনং রেঞ্জের রেইনফরেস্টের অপার সৌন্দর্যে।
টিকেট:
টিকেট মূল্য নির্ভর করছে কতজন ভ্রমণ করছেন বা সঙ্গে শিশু কয়জন, আবার কয়টি স্টেশন আপনি ভ্রমণ করছেন তার উপরেও টিকেটের মূল্য নির্ভর করে। আপনি চাইলেই পাফিং বিলির ওয়েবসাইটে দেখে নিতে পারেন টিকেট। তবে সাধারণত ৪-১৫ বছরের শিশুদের টিকেট মূল্য ১৯ থেকে ৩৯ ডলারের মাঝে, প্রাপ্তবয়স্কদের (১৫+) টিকেট ৩৬-৭৮ ডলারের মাঝে, কনসেশন টিকেট ২৯-৬২ ডলার এবং পারিবারিক টিকেট ৯১.৫০-১৯৬.৫০ ডলারের মাঝে। ৪ বছরের নিচের শিশুদের টিকেট ফ্রী।
যেহেতু পাফিং বিলির টাইম-টেবিল ও টিকেট মূল্য প্রায়ই পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয় তাই পাফিং বিলির ওয়েবসাইট থেকেই টিকেট ও সময় সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যাবে। আর স্কুল হলি’ডেগুলোতে টিকেটের চাহিদা বেশি থাকায় অগ্রীম টিকেট কেটে ভ্রমণ করাটাই শ্রেয়, এতে করে শেষ মুহূর্তে হতাশ এড়ানো যাবে।
পাফিং বিলির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
কম খরচে ও বাজেটে নির্মিতি ২’৬ ″ (৭৬২মিমি) গেজ লাইনগুলির মধ্যে পাফিং বিলি একটি, যা ১৯০০ -এর দশকের গোড়ার দিকে ভিক্টোরিয়ায় দুর্গম অঞ্চল খোলার জন্য নির্মিত হয়েছিল। বর্তমান বেলগ্রেভ এবং জেমব্রুকের লাইন’টি ছিল এর প্রথম ও প্রধান অংশ যা ১৮ ডিসেম্বর ১৯০০ সালে চালু হয়েছিল। ১৮.২ মাইল জুড়ে (২৯কিলোমিটার) আপার ফেরেন্ট্রিগলি থেকে জেমব্রুক ন্যারো গেজ লাইন সবসময় মেলবোর্নের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় আকর্ষণ ছিল এই পাফিং বিলি। ১৯৫৩ সালের এক ভূমিধস লাইনটি বন্ধ করে দেয়, এছাড়া অপারেটিং লোকসানের কারণে লাইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৫৪ সালে এই লাইন বন্ধ হয়ে যায়। পাফিং বিলির বর্তমান সাফল্য এসেছে জনস্বার্থের কারণে গঠিত পাফিং বিলি প্রেসেরভেশন সোসাইটি – এর নির্ধারিত সদস্যদের দ্বারা। ভিক্টোরিয়ান রাজ্য সরকারের আশীর্বাদ এবং নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবীরা, ভূমিধসকে পাশ কাটিয়ে ১৯৬২ সালে বেলগ্রেভ থেকে মেনজিস ক্র্যাক, ১৯৬৫ সালে এমারেল্ড, ১৯৭৫ সালে লেকসাইড এবং সর্বশেষে অক্টোবর ১৯৯৮ সালে জেমব্রুক পর্যন্ত লাইনটি পুনরায় চালু করে।
আমাদের একদিন পাফিং বিলি’তে:
কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদের মতো হয়তো অনেকেই বারবার অনেক পরিকল্পনা বা ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে পরিস্থিতির কারণেই। তারপরেও যখন এই বছরের শুরুর দিকে ভিক্টোরিয়াতে কোভিড’এর প্রকোপ কম ছিল অনেকেই আবার হয়তো সময়ের কারণে বা মনে পুরোপুরি জোড় না পাওয়ার করণেও দূরে বা ভিক্টোরিয়ার বাইরে ঘুরতে যায়নি। আর তাই চেষ্টা করেছি এক দেড়ঘন্টার ড্রাইভ দূরত্বে যা যা আছে দেখার বা ঘুরার মতো সেগুলোতেই ঘুরে আসতে। তো যাই হোক পাফিং বিলি’তে আজ যাই, কাল যাই করেও যাওয়া হয়ে উঠছিলো না আমাদের।
অবশেষে গত ৩ জুলাই সকাল সকাল আমরা যাত্রা করলাম পাফিং বিলির উদ্দেশে। আগেই বলেছি স্কুল হলিডের সময়ে প্রচন্ড ভিড় থাকে, তাই আমরা সপ্তাহখানেক আগেই অনলাইনে কেটে রেখেছিলাম আমাদের টিকেট। আমরা কিনেছিলাম লেকসাইট স্টেশন থেকে জামব্রোক রিটার্ন টিকেট। জুন মাসের সকাল প্রচন্ড ঠান্ডা, আমার লোকাল কফির দোকান থেকে কফি নিয়ে শুরু করলাম আমাদের যাত্রা এম-১/প্রিন্সেস ফ্রি’ওয়ে ধরে।
আমরা একটু তাড়াতড়ি পৌঁছানোর জন্য টোলওয়ে ধরলাম, আসলে আমার ছেলে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো কতক্ষনে পৌছাবো তাই আর কি। প্রায় ১ ঘন্টার রাস্তা ছিল, যদিও শনিবার ছিল তারপরেও রাস্তায় বেশ গাড়ি ছিল। আমার ছেলের ভাষ্যমতে সবাই নাকি ঐদিন পাফিং বিলি’ই যাচ্ছিলো তাই রাস্তায় এত গাড়ি। এম-১ থেকে আমরা হিথারটন রোডে এক্সিট নিলাম, ডান্ডিনং এর কাছে। বেলগ্রাভ-হালাম রোড দিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ চোখে পড়লো সাইনবোর্ড, লিখা ‘হোম-মেইড ফ্রেশ হট জ্যাম-ডোনাট’। হোম-মেইড ফ্রেশ হট জ্যাম-ডোনাট সামনে আর তা খাবোনা এতো হতেই পারেনা। সঙ্গে সঙ্গে মাসুদ গাড়ি থামালো। গাড়ির দরজা খোলা মাত্রই তাজা ডোনাটের সুগন্ধ নাকে যেনো শুধু আছড়ে পড়লো না, একেবারে নাকে চেপে বসলো। আমাদের সামনে আরো তিনজন লাইনে, তিনজন পরে আমরা ১০ ডলারে ৬ টা নিয়ে নিলাম। আমাদের মনেহয় এখন পর্যন্ত আমার খাওয়া শ্রেষ্ঠ হট জ্যাম-ডোনাট ছিল এটা।
আমাদের টিকেট ছিল বেলা ১২:০০ টার, আমরা যখন লেকসাইট পৌছালাম তখন সকাল ১১:০০টার কিছু বেশি। সকালে যাত্রার শুরুতে যদিও আকাশে হালকা রোদের দেখা ছিল লেকসাইট পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেই রোদ কোথায় যেনো হারালো, আকাশ তখন মেঘলা সঙ্গে গুড়ি গুড়ি শীতের বৃষ্টি। সবকিছু মিলিয়ে ঠান্ডাটা বেশ জেঁকে ধরলো। আর তখনি খেয়াল করলাম সকালে তাড়াহুড়ো করে আমি বা মাসুদ আমরা একজন মাথার বিনি বা হাতের মিটেন আনিনি সঙ্গে। ভাগ্য ভালো যে ছেলের সব সঙ্গে এনেছিলাম, তাকে মোটামুটি প্যাকেট করে ফেললাম বিনি, হাত মোজা, গলার স্ক্র্যাফ সব দিয়ে। আমাদের হাতে তখনও কিছু সময় হাতে ছিল তাই সেই সময়টা আমরা লেকসাইট লেকে একটু কাটালাম। ১২:৩০-এ আমরা চেপে বসলাম পাফিং বিলিতে লেকসাইট স্টেশন থেকে।
ধোঁয়া ওঠা স্টিম ইন্জিনের ট্রেন সিনেমাতে দেখেছি আর বাবা-মায়ের কাছেই শুধু শুনেছি, তাই প্রথম স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেনে চড়ে উত্তেজনাটা আমাদের দুজনেরও (আমি আর মাসুদ) ছিল শিশুসুলভ। হুঁইসেল বাজিয়ে পাফিং বিলি ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে চললো গ্রেট ডান্ডিনং রেঞ্জ-এর গাছ-গাছালির আর বড় বড় ফার্নের মাঝ দিয়ে। আমার ছেলে ফাতীন তো সিটেই বসবে না কারণ সে শুধু বাইরেই দেখবে। তার যুক্তি এখানে অনেক বন্য প্রাণী নাকি দেখা যাবে তাই সে সেগুলো মিস করতে চায় না। কয়লার পোড়া গন্ধ বাতাসে ট্রেনেই আবার ধোঁয়ার সঙ্গে ঢুকে যাচ্ছিলো, যা চোখে কিছুটা জ্বালাও সৃষ্টি করছিলো। আগেই বলেছিলাম তাড়াহুড়ো করে মাথার টুপী ও হাত মোজা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ট্রেন যখন বনের অনেক ভেতরে চলে এসেছে তখন ঠান্ডায় আমার আর মাসুদের জমার পালা। হাত ঠান্ডায় মনে হচ্ছিলো জমে বরফ হয়ে আসছে, আর নাক দিয়েও তখন পানি পড়তে শুরু করেছে, ভাগ্য ভালো ছিল যে কোভিডের কারণে মাস্ক পড়া ছিলাম নয়তো সেদিন হয়তো জমেই যেতাম। ঘন বন, কাঠের সেতু, তৃণভূমি, ছোট ছোট টিলা পেরিয়ে ৪৫ মিনিট পরে আমরা পৌছালাম জামব্রোক স্টেশনে। এখানেও একটি ছোট স্টেশন রুম আছে সাবেকি আমলের। ট্রেন থেকে নেমে আমরা সেই স্টেশন রুমে ঢুকলাম, ততক্ষনে আমি আর মাসুদ ঠান্ডায় মোটামুটি নাকাল, স্টেশন রুমে ঢুকেই দেখি আগুনের একটা বিরাট চুল্লী, তাড়াতাড়ি তার যতটা নিরাপদ কাছে যাওয়া যায় আমি আর মাসুদ গিয়ে দাঁড়ালাম।
ওহ মনে হচ্ছিলো এরচেয়ে উপভোগ্য আর কিছুই হতে পারে না, ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাত পা আর শরীর সব যেন আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে পাচ্ছিলো। আমাদের ফিরতি ট্রেন দেখা ২:৩০-এ তাই আমরা ভাবলাম এর মাঝে এই ছোট টাউনটা একটু ঘুরে দেখে নেই, আর দুপুরের খাবারও খেতে হবে। কোথাও বেড়াতে গেলে আমি আর মাসুদ দুজনেই সেই এলাকার খাবার পরখ করে দেখতে খুব ভালোবাসি। তাই আমরা বেরিয়ে গেলাম টাউন দেখতে ও স্থানীয় ভালো কোনো রেস্তোরার খোঁজে। সপ্তাহান্তের দিন তাই রাস্তা ঘাট বেশ নির্জন। স্টেশন থেকে কিছু দূরেই আমাদের পথে পড়লো একটা পুরানোদিনের গাড়ীর মিউজিয়াম। কিন্তু বন্ধ থাকায় আমাদের আর সেদিন ঢুকা হলো না, যদিও আমার ছেলের খুব ইচ্ছে করছিলো কারণ গাড়ি তার খুব পছন্দের। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় না থাকায় আমরা ঘুরাঘুরিতে বেশি সময় আর দিতে পারলাম না।
স্টেশনের কাছেই আমরা একটি কনটেম্পোরারি আর্জেন্টাইন রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। ভেতরের কাঠামো ওয়ারহাউসের মতো, বেশ উঁচু ছাদ আর ইঁটের দেয়াল। ভেতরে ঢুকেই আমাদের মন ভালো হয়ে গেলো খাবারের চমৎকার সুবাসে, আর বাইরে ঘুরে ঠান্ডায় এমনিতেই আমরা খানিকটা ধরাশায়ী ছিলাম, রেস্টুরেন্টের ভেতরের উষ্ণতা তাই আমাদের শরীর মন দুটোই চাঙ্গা করে তুললো। খাবারের মান ও স্বাদ ছিল চমৎকার আর পরিমাণেও বেশ বড়, তবে একটু দাম বেশি যা আমার মনে হয়েছে খাবারে যে মান ও স্বাদ তা পুষিয়ে দেয়।
খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করে আবার আমাদের ফেরার পালা। স্টেশনে আসে দেখি ট্রেন আসে পড়েছে। আমরাও আমাদের নিদৃষ্ট কামরায় উঠে পড়লাম। যখন লেকসাইট স্টেশনে এসে পৌছালাম ততক্ষনে বিকাল হয়ে গিয়েছে, কিন্তু মেলবোর্নের কনকনে শীতের আকাশ দিনটাকে মনে হচ্ছিলো আরো বেশি আগে সন্ধ্যা করে ফেলেছে। আমরা সুন্দর একটি দিন কাটিয়ে আবার সেই একই রাস্তা ধরে ফিরতে লাগলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি সারাদিনের ধকলে ফাতীন ঘুমিয়ে পড়েছে।
যদিও আমরা এখনো লকডাউনেই আছি, কিন্তু স্কুল হলি’ডে আবারো সন্নিকটে। যদি ভাগ্য সহায় হয় তবে হয়তো আসছে স্কুল হলি’ডেগুলোতে আমরা কিছুটা স্বধীনতা হয়তো পেতেও পারি। তখন অথবা পরে যেকোনো সময় ঘুরে আসতে পারেন পাফিং বিলি।