এই গল্পটা অনেক আগের। সবকিছু একদম ঠিকঠাক আমার হয়তো মনেও নেই। কিন্তু আমার বেড়ানো জীবনের সবথেকে দারুণ অভিজ্ঞতা গুলোর মধ্যে এর অবস্থান চোখ বন্ধ করে অনেক উপরে। তাই অনেকটা নিজের মনেই রাখার জন্য লিখে ফেলার চেষ্টা। কিছু ইনফরমেশন ইন্টারনেট থেকে নিয়ে আর কিছুটা আমার স্মৃতিশক্তির উপর ভরসা করে শুরু করলাম।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অফিসের পাঁচজন কলিগের সাথে ভুটান যাওয়ার প্ল্যান হলো। এই পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে আমি মোটামুটি চিনি। বাকি দুইজনকে অফিসে দেখলেও কখনো কথা বা কাজ করা হয় নি। কিন্তু এই ট্রিপের পরে নানান বয়সি মানুষের এই গ্রুপটার সবাই খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছি। যদিও জীবন জীবিকার প্রয়োজনে এখন একেকজনের বাস পৃথিবীর একেক শহরে।

ভুটানে কয়দিনের ট্রিপ ছিলো, কোথায় কোথায় বেড়িয়েছি সেইসব ডিটেলে আর গেলাম না। এই ট্রিপের হাইলাইট ছিলো টাইগার’স নেস্ট মনেস্ট্রিতে যাওয়া। আজকে সেইদিনের গল্পই বলবো। টাইগার’স নেস্ট মনেস্ট্রি ভুটানের পারো শহরের সবথেকে জনপ্রিয় জায়গা। এটি পারো তাক্সতাং নামেও পরিচিত। ভুটানিসদের জন্যে অত্যন্ত পবিত্র এই মনেস্ট্রি টুরিস্টদের জন্য মাস্ট ভিজিটের লিস্টে থাকে। ১৬৯২ সালে পাহাড়ের খাজে এক গুহার চারপাশে বানানো এই মনেস্ট্রি টুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত। চারটা উপাসনালয় আর এখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার জায়গা নিয়েই এই স্ট্রাকচার। মনেস্ট্রির ইতিহাস বলে গুরু পদ্ম সম্ভাবা এক বাঘিনীর পিঠে চেপে তিব্বর থেকে এই গুহায় উড়ে এসেছিলেন। এই কারণেই এর নাম টাইগার’স নেস্ট। এখানে তিনি তিন বছর, তিন মাস, তিন সপ্তাহ, তিন দিন এবং তিন ঘন্টা ধ্যানে ছিলেন। মনে করা হয় এই ঘটনার হাত ধরেই ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের আগমন।

পারোতে আমরা টাইগার’স নেস্ট নামেই এক রিসোর্টে ছিলাম। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে গেলাম। ভুটানে আমাদের পুরো সময়টার জন্যেই একটা গাড়ি আর গাইড ছিলো। কম বয়সী হাসিখুশি অনিল গাড়ি নিয়ে আমাদের নিয়ে গেলো পাহারের নিচে স্টার্টিং পয়েন্টে। পারো শহর থেকে মিনিট বিশেকের রাস্তা। অনিল আমাদের বুঝিয়ে দিলো কিভাবে যেতে হবে। টাইগার নেস্টে যাওয়ার জন্যে কোনো গাইডের প্রয়োজন নেই। খুবই ওয়েল ডিফাইন্ড রাস্তা। তবে পারো শহর থেকে প্রায় তিন হাজার ফিট উঁচুতে এই মনেস্ট্রিতে হাইক করে উঠতে আর নামতে পাঁচ থেকে আট ঘন্টা সময় লাগে। আমরা আনাড়ি হাইকার, আমাদের পুরা রাউন্ড ট্রিপ সাড়ে সাত ঘন্টা লেগেছিলো। যদিও এক মধ্যে বেশ খানিকটা সময় আমরা মনেস্ট্রিটা ঘুরে দেখতেও কাটিয়েছি। অনিল নিচে পুরো সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছে। পুরো রাস্তা হেঁটে উঠতে না চাইলে অবশ্য ছোট্ট ছোট্ট ঘোড়া ভাড়া করা যায়। অনেকেই তাই করছিলো, তবে ওই পাহাড়ি উঁচু আঁকাবাকা পথে ঘোড়া চলা দেখতেও ভয় লাগছিলো। আমরা হেঁটে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটাই সাদরে গ্রহণ করলাম।

টাইগার নেস্ট যাত্রার এই অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে চাইলে প্রপার জামা এবং জুতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি রাখাও জরুরি। ফেব্রুয়ারি মাসে ভুটানে অনেক ঠান্ডা ছিলো। আমি আমার বড় জ্যাকেটটাই সাথে করে রওয়ানা দিয়েছিলাম, পাহাড়ে চরতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই গরমে ঘাম ছুটে সেই জ্যাকেট একটা বাড়তি বোঝা হয়ে দাড়িয়েছিলো।

আবহাওয়া ভালো থাকলে টাইগার’স নেস্ট মনেস্ট্রিটা পাহাড়ের একদম নিচ থেকেই চোখে পরে। পাহাড়ের খাজে ঠেস দেয়া ছোট্ট বিন্দুর মতো। সেইদিকে তাকিয়ে বিশাল এক নিশ্বাস নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে আমরা রওয়ানা দিলাম। পনের মিনিটের মাথায়ই আমাদের একজন রণে ভঙ্গ দিলো। সে নাকি যাবে না। এতোটা পথ এভাবে পায়ে হেঁটে যাতে সাহস পাচ্ছে না। সেও নিচে গাড়িতে আমাদের জন্য আপেক্ষা করবে৷ কি আর করা, হারাধনের রইলো বাকি পাঁচজন মিলে আমরা চলতে থাকলাম। পাহাড়ি পথটা কিছু কিছু জায়গায় বেশ স্টিপ হলেও মোটামুটি হেঁটে যাওয়ার মতই রাস্তা। তবে আপহিল রাস্তায় হেঁটে অভ্যাস না থাকলে কিছুক্ষণ পরপর হাঁফ ধরে যাওয়া অস্বাভাবিক না। আমরা যথেষ্ট ব্রেক নিয়ে নিয়ে এগোচ্ছিলাম।

 

সত্যি কথা বলতে যতই রাস্তা পার হচ্ছিলাম, চারপাশের দৃশ্য ততই সুন্দর হচ্ছিলো। পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরেই দূরের ভ্যালি আর সবুজ গাছপালা নজর কাড়ে।

মোটামুটি এমন একটা পর্যায় পৌঁছালাম যখন মনে হচ্ছিলো আর পারবো না। ঠিক তখনই কিছুটা সমতল জায়গায় এসে পৌঁছালাম। এখানে একটা ক্যাফেটেরিয়ায় আছে। এখান থেকে টাইগার’স নেস্ট বেশ কাছে মনে হয়। আমরা তো ভাবেছিলাম পৌঁছেই গিয়েছি মনে হয়। কিন্তু তখনও পথ অর্ধেক না হলেও বেশ খানিকটা বাকি। যাই হোক, এই জায়গাটা ব্রেক নেয়ার জন্য বেশ ভালো। চা পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে নেয়া যায়। এখানে ভুটানের বৈশিষ্ট্য প্রেয়ার হুইল ঘুরালাম, চাতালের মতো একটা জায়গায় শুয়ে বসে রেস্ট নিলাম, বাতাসে নানান রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগের উড়াউড়ি দেখলাম। তারপর নতুন উদ্যমে আবার রওয়ানা হয়ে গেলাম।

ফাইনাল পুশটার জন্যে বেশ মনের জোর লাগে। টানা আড়াই তিন ঘন্টা উঁচু পথে হাঁটতে হাঁটতে শরীর বেশ কাহিল হয়ে যায়। তবে আসলেই যখন একদম কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছালাম, অসাধারণ সৌন্দর্যের এই মনেস্ট্রি দেখে চোখ মন সব জুড়িয়ে গেলো। অসম্ভব শান্তি শান্তি একটা জায়গা। একদম পথের শেষদিকে গিয়ে আবার পাথুরে সিড়ি বেয়ে কিছুটা নামতে হয়। ছোট্ট একটা জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে হেঁটে একটা ব্রিজ পার হয়ে আবার কয়েকধাপ সিড়ি বেয়ে উঠলেই মনেস্ট্রির দোরগোড়ায়। মনেস্ট্রির ভিতরে কোনো ছবি তোলা এলাও করে না। তাই আমরা হেঁটে হেঁটেই দেখে আসলাম।

মনেস্ট্রির ভিতরেও বেশ কয়েকটা ফ্লোর আছে। ছোট ছোট ঘর, বারান্দা, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা উপসনায় মগ্ন। খুবই শান্ত আর শীতল পরিবেশ। উপরের দিকের ফ্লোরগুলোতে ঝুল বারান্দার মতো আছে। ওখান থেকেও ভিউ অসাধারণ।

এরপর আবার ফেরার পালা। অবশ্যই ফেরার পথ উঠার মতো কঠিন না। তখন বেশ সহজভাবেই নেমে আসা যায়। একদম নিচে এসে যখন মুখ তুলে আবার মনেস্ট্রিটার দিকে তাকালাম, বিশ্বাস হচ্ছিলো না আমি নিজে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই ওখানে ছিলাম। চোখ বন্ধ করে বলা যায় ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। ভুটানে যাওয়ার সুযোগ হলে অবশ্যই ঘুরে আসা উচিত।