প্রিয় সাইকেল, রেলস্টেশন ও সে…

হেমন্তের এক সকালে, প্রিয় সাইকেলটা বকুল গাছের সাথে হেলান দিয়ে রেখে, পূব আকাশের নরম সূর্যের আলতো উষ্ণতা গায়ে মেখে, প্রিয় রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে পা ঝুলিয়ে বসে অপেক্ষা করবো। কিন্তু কিসের অপেক্ষা সে হয়তো নিজেও জানবোনা।

মালতীনগর স্টেশনের শিউলি গাছ থেকে ঝরে পরা সাদা কমলা শিউলিতে ঢেকে যাবে পুরো সবুজ ঘাস আর লাল প্লাটফর্মের বেশ কিছুটা পথ, দুর থেকে ভেসে আসবে কোন ট্রেন আসার হুইসেল, পাশের দোকান থেকে কাঁচের ছোট্ট গ্লাসে লাল চা রেখে যাবে, কৃষ্ণচূড়ার বেদীতে, তখন প্লাটফর্মে উপরে পা ঝুলিয়ে আমি মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকবো রেল লাইনের অদূরে জ্বলে থাকা হলুদ সিগন্যাল বাতির দিকে, কুয়াশা ভেদ করে যখন ইঞ্জিনের হলুদ আলো দেখা দেবে, উঠতে না চাইলেও উঠে যেতে হবে, জীবনে উপভোগের নেশায়।

নাহ, এই স্টেশনে ট্রেনটি দাঁড়াবেনা, ট্রেন প্লাটফর্মে প্রবেশ করতেই সিগন্যাল বাতি হলুদ থেকে সবুজ হয়ে যাবে, সেই সংকেত পেয়ে ছুঁটে চলে যাবে কোন একটা আন্তনগর ট্রেন। হয়তো কোন ট্রেন-ই আর থামেনা এই স্টেশনে! তবুও স্টেশনটা রয়ে গেছে কালের সাক্ষী হয়ে! নিয়ম মেনে ঘণ্টা বাজে, দোকানি কাঠের উনুনে চায়ের আগুন জ্বালে।

ট্রেন সিগন্যাল পার হতেই সবুজ আলো লাল রঙের হয়ে যাবে! এক অদ্ভুত ছেলে মানুষী আনন্দ হবে সিগন্যাল বাতির রঙ বদলের খেলা দেখে, লাল, লাল থেকে হলুদ, হলুদ থেকে সবুজ আর সবুজ থেকে আবারও লাল হয়ে জ্বলে থাকা! সেদিকেই বুঁদ হয়ে থাকবো, ট্রেনের শেষ বগির বিন্দু পর্যন্ত উঁচু গাছ আর বাঁকা রেল পথের মিলিয়ে না যাওয়া অবধি।

ঘোর ভাঙবে সাইকেলের বেল বেজে ওঠার টুংটাং শব্দে! অবাক হব, এই ভেবে যে আমার সাইকেলের তো এমন বেল বা শব্দ নেই! তাহলে?

রেললাইন আর সিগন্যাল বাতি থেকে চোখ ফেরাতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবো, আমার প্রিয় সাইকেলের গায়ের সাথে আর একটি সাইকেল হেলান দিয়েছে পরম নির্ভরতায় যেন! চারপাশে শিউলির বিছানা যায়গাটাকে আরও মোহময় করে তুলেছে। দুটো সাইকেলের আলিঙ্গনে!

বটের বেদী থেকে দোকান থেকে রেখে যাওয়া লাল চায়ের কাপ নিয়ে এসে, আলতো করে ছুঁয়ে দেবে উষ্ণতায়। ভীষণ অবাক হয়ে আমি পাশ ফিরে দেখবো, এ যে তুমি! যে তোমাকে একদিন হারিয়ে ফেলেছিলাম এই স্টেশনের ভিড়ে!

সেই থেকে আমি সময় পেলেই এখানে আসি, এই মালতীনগর স্টেশন বসে থাকি, অজানা কোন সুখের অপেক্ষায় থেকে থেকে আবার হারিয়ে যাই, ঠিক যেভাবে তুমি সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলে অথবা বলা যায়, আমি-ই তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।

অনেকটা বছর কেটে গেছে, কিন্তু তুমি যে ঠিক আগের মতই আছো! তোমার সেই চোখ নামানো লাজুক হাসি দিয়ে, চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দেবে পরবর্তী চুমুকের জন্য।

যেন আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিন, হারিয়ে যাওয়া তুমি আর হারিয়ে যাওয়া ক্ষন ফিরে এসেছে কোন সুখ স্বপ্ন হয়ে! আমাদের চুলে কিছুটা পাক ধরেছে ঠিক-ই, কিন্তু সময়টা যেন সেই আজ থেকে ২৫ বছর আগের মতই থমকে আছে!

২৭ অক্টোবর ২০২২