কাকাডু ন্যাশনাল পার্ক

Avatar

Byনওশাবা রাজ্জাক, অস্ট্রেলিয়া

Nov 14, 2022 #অপরূপ, #অস্ট্রেলিয়া, #আকর্ষণীয়, #আঁকাবাঁকা, #আপহিল, #ইয়েলো ওয়াটার, #উবির, #এবোরিজিনাল, #কাকাডু, #কাকাডু ন্যাশনাল পার্ক, #কুমির, #ক্যামেরা, #ক্যাম্পিং, #গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, #ঘাস, #ঘুরুঞ্চি, #চার্টার প্লেন, #ছুটি, #জাবিরু, #জিমজিম, #টাউনশিপ, #টুইন ফলস, #টুরিস্ট ডেস্টিনেশন, #ট্রাভেল, #ডারউইন, #ড্রাইভ, #নওশাবা রাজ্জাক, #নর্দান টেরিটোরি, #নুরলাঞ্জি রকে, #নৌকা, #ন্যাশনাল পার্ক, #পথ, #পরিবেশ, #পর্যটক, #পাখি, #পাথুরে, #পানি, #পাহাড়, #প্রকৃতি, #প্লেন, #ফরেস্ট, #ফুল, #বাতাস, #বাষ্প, #বাস্তুতন্ত্র, #বিকাল, #বৃষ্টি, #বেড়ানো, #ভ্রমণ, #মেঘ, #রক আর্ট, #রাত, #রিস্ক, #শহর, #সমৃদ্ধ, #সূর্য, #সূর্যাস্ত, #সূর্যোদয়, #হাঁটাপথ

এই বছর মার্চ মাসে আমরা কাকাডু ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে আসলাম।

নর্দান টেরিটোরিতে তিন বছর পার করে ফেললেও কাকাডু ভ্রমণ আমার জন্য এই প্রথম। বেড়ানোর জন্য ড্রাই সিজন, মানে মে থেকে সেপ্টেম্বর আইডিয়াল, তারপরেও সময় ও সুযোগ পেয়ে আমরা ওয়েট সিজনেই রওয়ানা দিলাম। কাকাডু ন্যাশনাল পার্কের প্রধান শহর জাবিরু, ছোট্ট এই টাউনশিপ ডারউইন থেকে প্রায় ২৫৫ কিলোমিটার দূরে। ড্রাইভ করে গেলে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগে। এই ধরনের ড্রাইভে সাধারণত থামতে থামতে যাওয়া হয়, কাজেই সময় হয়তো একটু বেশীই লাগবে।

কাকাডু যাওয়ার আগে যা জানতাম না তা হলো, প্রায় ২০,০০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই পার্ক অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে বড় ন্যাশনাল পার্ক। তথ্যগত ভাবে সবথেকে বড় ন্যাশনাল পার্ক গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ হলেও স্থলভাগে অবস্থিত ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে আয়তনগত দিন থেকে কাকাডুর অবস্থান সবথেকে উপরে।

জাবিরু পৌঁছাবার আধাঘন্টা আগেই বাদিকের রাস্তায় একটা ছোট্ট ডিট্যুর নিয়ে যেতে হবে উবির। এবোরিজিনাল রক আর্টের জন্য বিখ্যাত উবির সম্ভবত কাকাডুর সবথেকে জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেস্টিনেশন। কারপার্কের কাছ থেকেই এক কিলোমিটারের একটা সার্কিট ওয়াকে উবিরের রক আর্ট সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা পাওয়া যায়। এই হাঁটাপথ খুবই সহজ এবং ৪৫ মিনিটের মধ্যে শেষ করা সম্ভব। ২০,০০০ বছরেরও পুরানো এই আর্ট এবোরিজিনালদের জীবনযাপনের গল্প বলে। সার্কিট ওয়াক ছাড়াও কাকাডুর ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পেতে উবিরের লুকআউটে অবশ্যই যেতে হবে। ২৫০ মিটারের এই পথ, পাথুরে, আঁকাবাঁকা এবং আপহিল। এই রাস্তার জন্য মিনিমাম ৩০ মিনিট রাখতে হবে। উবিরের লুকআউটে যাওয়ার আদর্শ সময় হলো সূর্যাস্তের সময়। ভালোমতো প্ল্যান করে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে লুকআউটে যেতে পারলে পুরাপুরি ভাবে উপভোগ করা যাবে। আর সাথে ফ্লাস্কে করে চা থাকলে তো কথাই নেই।

দুঃখজনক হচ্ছে, উবির নিয়ে এতো তথ্য জানা থাওলেও উবির আমার এই ট্রিপে যাওয়া হয় নি। ওয়েট সিজনে বেশীরভাগ সময় রাস্তায় পানি উঠে যাবার কারণে উবির বন্ধ থাকে। উবির যাওয়ার পথে আরেক “আকর্ষণের” নাম কাহিলস ক্রসিং। কাহিলস ক্রসিং, ইস্ট এলিগেটর রিভারের উপর একটা ছোট্ট রাস্তা যা কাকাডু আর আর্নহেম ল্যান্ডকে যুক্ত করে। কিন্তু সেটা এই কাহিলস ক্রসিং এর আসল পরিচয় নয়। ইস্ট এলিগেটর রিভার হচ্ছে কুমির ইনফেস্টেড একটা নদী। মে থেকে অক্টোবর, ড্রাই সিজনে কাহিলস ক্রসিং কুমির দেখার জন্য আদর্শ জায়গা। নিরাপদ দুরত্বে ভিউইং ডেক থেকে কাহিলস ক্রসিং এ অসংখ্য কুমির দেখা যায়। আর অক্টোবর থেকে এপ্রিলে বৃষ্টির সময় এই কাহিলস ক্রসিং ৪ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত পানির নিচে চলে যায়। কাজেই কুমিরের খাদ্য হওয়ার ইচ্ছা না থাকলে ওই সময় এই রাস্তায় যাওয়া অসম্ভব। সত্যি কথা বলতে ওয়েট সিজনে কাহিলস ক্রসিং বন্ধই থাকে। গত মার্চ মাসে কাহিলস ক্রসিং ৪ মিটার পানির নিচে ছিলো। এই কারনেই উবির এবং কাহিলস ক্রসিং কোনোটাই আমার দেখা হয় নি।

কাকাডুতে আমরা সবার আগে গেলাম নুরলাঞ্জি রকে। নুরলাঞ্জি রক কাকাডুর আরেকটা রক আর্ট সমৃদ্ধ জায়গা। এখানেও দেড় কিলোমিটার থেকে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত বেশ কিছু ওয়াক আছে এবং ওয়াকগুলো বেশ সহজ। পাহাড়ের গায়ে গায়ে এবোরিজিনালদের নানা রকম আঁকা ছবি আর তার সাথে নানান বর্ননা। হাতে সময় থাকলে এবং রক আর্টের প্রতি আগ্রহ থাকলে এখানে অনেকটা সময় কাটানো সম্ভব। তবে, বেশিরভাগ সময় ভিউইং স্পটগুলো থেকে পাহাড়ের ক্লিফ আর জনপ্রিয় রক আর্ট দেখেই মানুষ ফিরে আসে। আমরা নুরলাঞ্জি রকে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়েছিলাম। সত্যি বলতে মার্চ মাসের দুপুরবেলার গরমে আর বাতাসের আর্দ্রতার যন্ত্রণায় এর বেশী থাকা সম্ভব হয় নি।

বিকাল বেলা আমাদের ইয়েলো ওয়াটার ক্রুজের টিকেট কাটা ছিলো। জাবিরু থেকে ৪৫ মিনিট ড্রাইভ করে যেতে হয় ইয়েলো ওয়াটারের কাছে। সেখান থেকে ছোট্ট নৌকায় করে আমরা ঘুরে বেড়ালাম। বৃষ্টির সিজনে যাওয়ার কারনেই চারদিক ছিলো পানিতে টইটম্বুর। ভেসে থাকা ঘাস আর ফুল, নানা রকম পাখি আর অবশ্যই কুমির! তবে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে, ইয়েলো ওয়াটার ক্রুজ সকালবেলায় যেতে পারলে বেশী ভালো লাগবে। সকালের ক্রুজ শুরু হয় সূর্য উঠার আগে দিয়ে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে চারিদিকের প্রকৃতি জেগে উঠতে দেখা নাকি অসম্ভব সুন্দর। আর ড্রাই সিজনে যদি যাওয়া যায়, সকালে সূর্য উঠার সময় ঠান্ডায় পানির উপরে হালকা বাষ্প ভেসে বেড়ায়, সেই বাষ্প আর সূর্যের প্রথম আলো মিলেমিশে ইয়েলো ওয়াটারকে সত্যিকারের হলুদ করে তোলে।

তবে এখানে প্রসংগত বলে রাখি, ন্যাশনাল পার্কে রাতের বেলা ড্রাইভ করাটা যটতা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। ইয়েলো ওয়াটার ক্রুজ সকালবেলা করতে চাইলে তার ধারে কাছে একোমোডেশন নিতে হবে। কুইন্ডা লজ ইয়েলো ওয়াটারের কাছে থাকার জন্য একটা ভালো অপশন। নইলে জাবিরু থেকে ভোরে অন্ধকার থাকতে ৪৫ মিনিট পার্কের মধ্যে দিয়ে ড্রাইভ করে আসতে হবে। ন্যাশনাল পার্কের রাস্তায় জংগলের প্রানী হেটে পার হওয়াটা খুব কমন ব্যাপার। রাতের বেলা গাড়িতে তাই এক্সিডেন্টের রিস্কটা বেশি থাকে। কাজেই খুব বাধ্য না হলে আমরা রাতে পার্কে ড্রাইভ করি না। কুইন্ডা লজে এবার জায়গা না পাওয়ার কারনেই আমরা বিকালবেলা ইয়েলো ওয়াটার ক্রুজ করেছি। এই ট্রিপে আমরা ছিলাম জাবিরুতে। কুমিরের আকৃতিতে বানানো হোটেল ক্রোকোডাইল হোটেল নামেই বেশি পরিচিত।

নর্দান টেরিটোরিতে ড্রাই সিজন বেড়ানোর জন্য সবথেকে ভালো, কোনো সন্দেহ নেই৷ ওয়াটারফলের মধ্যে কাকাডুর প্রধান দুই আকর্ষণ হলো জিমজিম ফল এবং টুইন ফলস। ওয়েট সিজনে এই ওয়াটারফলগুলো এক্সেসই করা যায় না, যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

তবে, আমার প্রথম কাকাডু ওয়েট সিজনে যাওয়া আমি কখনই আফসোস করবো না। আর তার কারণ হচ্ছে পরদিন সকালে আমাদের সিনিক ফ্লাইট ট্যুর। ড্রাই সিজনে হয়তো ওয়াটারফলের কাছে যাওয়া যায়, তবে ওয়েট সিজনে ওয়াটারফলের ফুলে ফেঁপে ওঠা অসম্ভব সৌন্দর্য দেখা যায়! কাকাডুর জিমজিম ফল আর টুইন ফলস আমরা দেখলাম আকাশের উপর থেকে প্রায় খেলনা প্লেনের মতো চার্টার প্লেনে চড়ে। এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা নাম না জানা ওয়াটারফল, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড় আর সবুজের খেলা, এক ঘন্টা সময় যেনো চোখের নিমেষে শেষ হয়ে যায়। সিনিক ফ্লাইটটা একটু এক্সপেন্সিভ। একেকজনের জন্যই আড়াইশ ডলার। তবে আমার মনে হয়েছে একবারের জন্য এই অভিজ্ঞতা নেয়া ঠিক আছে।

আমার কাকাডুর প্রথম অভিজ্ঞতায় এতটুকু বুঝেছি যে আমার আবার আসতে হবে। উবিরে দাড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য, কাহিল ক্রসিং এ কুমির দেখার জন্য, জিমজম ফলে ক্যাম্পিং এর জন্য, ইয়েলো ওয়াটারের উপরে সূর্যদয় দেখার জন্য। আরও আরও অনেক কিছুর জন্য যা হয়তো আমি এখনো জানিই না।