বাইরে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী, ঠান্ডা বাতাস, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাতে কি? আমাদের ঘোরাঘুরি থেমে থাকবে না।

আমার ছোট ছেলের এটাই শেষ স্কুল হলিডে। আর কয়েক মাস পরে, ফাইনাল পরীক্ষা। তাই সকালে উঠে রওনা দিলাম ক্যাসলমেইন (Castlemaine) এর উদ্দ্যেশে। দূরের পাহাড় ঢেকে আছে ঘন মেঘের আঁচলে, আকাশে কালো মেঘ আর মাঝে মাঝে বৃষ্টি আর কখনো মেঘের ফাঁক গলে একটু সূর্য। মেলবোর্ন শহর থেকে প্রায় ১ ঘন্টা ২০ মিনিটের দূরত্বে ক্যাসলমেইন।

আমাদের প্রথম গন্তব্য ক্যাসলমেইন শহরের দ্যা মিল (The Mill)। এখানে আছে ভিনটেজ দোকান, চকলেট ফ্যাক্টরি, চীজ ফ্যাক্টরি, রেস্টুরেন্ট এবং নানা ক্যাফে। আমরা সকালের নাস্তা আর কফি খেলাম একটা ক্যাফেতে। যেটা আগে ছিল ক্যাসলমেইন এর Woollen Mill এর ভেতরে। ক্যাফের ভিতরে ডেকোরেশন খুব সুন্দর। বাইরে বৃষ্টি আর হাতে চায়ের কাপ, জীবণে আর কি চাই।

মাঝে মাঝে বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে আমরা আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য ব্রমলি কালেকশন মিউজিয়াম (The Bromley Collection Museum) এবং ওল্ড ক্যাসলমেইন গাওল – গ্যালারি (The Old Castlemaine Gaol – Gallery)। আমার ছেলে সাফওয়ানের সাথে সাথে ডেভিড ব্রমলি (David Bromley) এখন আমারও বেশ পছন্দের শিল্পী। আগেও বিভিন্ন জায়গায় ব্রমলির আর্ট গ্যালারি দেখেছি। কিন্তু এই গ্যালারিটা বেশ ভাল লেগেছে।

১৮৬১ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ওল্ড ক্যাসলমেইন গাওল ছিল একটি জেলখানা। ১৮৬১-১৮৭৬ সালে ১০ জন কয়েদীর ফাঁসি হয় এই জেলখানায় , যাদের এই জেলখানার ভিতরে দাফন করা হয়। এটি এখন হেরিটেজ লিস্টেড লোকেশন। ক্যাসলমেইন পাহাড়ের উপর খুব সুন্দর করে এই আর্ট গ্যালারি গড়ে তুলেছেন আর্টিস্ট ব্রমলি। এন্ট্রি ফিস দিয়ে ঢুকে গেলাম ১৬০ বছেরের পুরানো জেলখানায়। আমি রীতিমত মুগ্ধ ব্রমলির আর্ট আর কালেকশন দেখে। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে জেলের ছোট ছোট সেলগুলোকে একেকটা আর্ট রুম হিসাবে সাজিয়ে রেখেছে।

এতো সুন্দর করে পুরো গ্যালারিটা সাজানো, মনে হলো এর চেয়ে আর অন্য কোনো ভাবে একটি পুরোনো জেলখানাকে ব্যবহার করা যেত না। এখানে একটা কথা না বললেই না, প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের জন্য এই যায়গাটা ঠিক উপযুক্ত নয়।

গ্যালারি দেখা শেষে প্রায় আধা ঘন্টার ড্রাইভ শেষে পৌঁছে গেলাম বেন্ডিগো (Bendigo)। ওখানে প্রথমে গেলাম গোল্ডেন ড্রাগন যাদুঘর (Golden Dragon Museum)। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ ইম্পেরিয়াল ড্রাগন, ১২৫ মিটার, যেটা প্রতি বছর ইস্টারের সময় ড্রাগন নাচ এর জন্য ব্যবহার করা হয়। এই ড্রাগনের নাম দাই গাম লুং (Dai Gum Loong)। আরো আছে বেন্ডিগো শহরে চাইনিজদের ইতিহাস। জাদুঘরের পাশেই আছে ছোট্ট ছিমছাম একটি বাগান।

জাদুঘরের এর সামনে দেখলাম রোজালিন্ড (Rosalind) পার্ক। সবচেয়ে আশ্চর্যের যেটা দেখ্লাম, সেটা হলো গাছ ভর্তি বাঁদুড়। একসঙ্গে এতো বাঁদুড় আমি আগে কখনো দেখিনি। ৩৮,০০০ এরও বেশি বাঁদুড় ঝুলে আছে গাছের ডালে ডালে । মনে হচ্ছিলো ব্যাটম্যানের শহর গোথাম শহর। ভয়ে ভয়ে ওদের নিচে দিয়ে হেটে চলে গেলাম বেন্ডিগোর ইনফরমেশন সেন্টারে।

বেন্দিগো শহরের আরেকটি আকর্ষণ – বেন্ডিগো ভিনটেজ টকিং ট্রাম। ১৮৯০ সাল থেকে বেন্ডিগোতে চলছে এই ট্রাম। ১৯৭২ তে ট্রাম সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন সময়ে ট্রাম চালানোর চেষ্টা করা হয়। অবশেষে ২০১০ এর পরে এই ট্রাম চালু হয় যা কিনা এখন একটি অন্যতম টুরিস্ট আকর্ষণ। টিকেট কেটে ট্রামে চড়লাম আর ঘুরেঘুরে দেখলাম ঐতিহ্যবাহী বেন্ডিগো। ট্রামে শুনলাম বেন্ডিগো শহরের ইতিহাস আর জানলাম এক সময়ের সোনার শহর আজো ধরে রেখেছে তার আভিজাত্য। বেন্ডিগো শহরের সোনালী সূযাস্ত দেখতে দেখতে ফিরে আসলাম মেলবোর্ন।