দুর্লভ, খুবই দুর্লভ রান অফ কচ (Rann of Kutch) যাওয়ার, দেখার, স্পর্শ করার সৌভাগ্য হল অবশেষে। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আমাকে দুর্লভ এই যায়গায় যাওয়ার এবং দুচোখ ভরে দেখার সুযোগ দিয়েছেন বলে।

ভারতের সবগুলো দিকের একদম শেষ বিন্দুতে যাওয়ার দুর্লভ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এদিকে পূবের মানে পশ্চিমবঙ্গের শেষ বিন্দু জয়গাও, ভারত ভুটানের বর্ডার, ঠিক উল্টো দিকে একদম পশ্চিমে গুজরাটের শেষ বিন্দু, ভুজের রান অফ কচ, যার কয়েক কিলোমিটার গেলেই পাকিস্তানের সীমান্ত, দক্ষিনে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড রামেশ্বরমের ধনুষ্কোটি, সমুদ্রের কয়েক কিলোমিটার গেলেই শ্রীলঙ্কা, তার ঠিক উল্টো দিকের একদম উত্তরের লাদাখের শেষ বিন্দু তুরতুক! মাত্র ৬-৮ কিলোমিটার গেলেই ধূসর পাহাড়ের ওপাশে পাকিস্তান।

ভারতের এই চার কোনায় গিয়ে দেখে সবচেয়ে মজার যে ব্যাপার সেটা হল একদিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা অন্য আর একটি দেশ ভুটান, ঠিক অন্যদিকে ধবধবে সাদা লবনের মরুভূমি গুজরাটের রান অফ কচ! দক্ষিনে নীল সমুদ্রের অবারিত জলরাশি আর উত্তরে ধূসর পাহাড়ের সারি! কি অদ্ভুত না?

একটা দেশের চারটা দেশের কোনা ঠিক চার রকমের প্রকৃতি ও পরিবেশ দিয়ে আবৃত! সবুজ পাহাড়, সাদা মরুভূমি, নীল সমুদ্র আর ধূসর পাহাড়ের দেয়াল! আবারো আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আমাকে সবগুলো যায়গা নিজ চোখে দেখার সুযোগ তিনি দিয়েছেন। আমার দেখা এই চার কর্নারের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে দুর্লভ মনে হয়েছে রান অফ কচ কে!

তুরতুকও দুর্লভ, রুক্ষ, কিন্তু তারপরেও রান অফ কচ আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন এবং দুর্লভ মনে হয়েছে! যার অন্যতম কারন একদম জনমানবহীন একটা প্রান্তর! ভীষণ রকম শীতের হাড় কাঁপানো বাতাস আর যাওয়ার রাস্তা ছাড়া আর কোন কিছুই অনুকুলে নয়। অথচ তুরতুকে একটা ঝলমলে গ্রাম আছে, সেখানে অনেক মানুষ আছে, থাকা খাওয়ার যায়গা আছে, কথা বলার মানুষ আছে, হেটে সময় কাটানোর সুযোগ আছে, নানা রকম প্রকৃতি উপভোগের উপায় আছে।

ভারত জয়গাও ভুটান বর্ডার আরও চমৎকার। পরিবেশ, চারপাশের প্রকৃতি, মানুষ এবং অন্যান্য কিছুর সাথে মানুষের উপভোগের জন্য যথেষ্ট। ধনুষ্কোটি, তামিলনাড়ুর বিচ্ছিন্ন সমুদ্র দ্বীপ। কিন্তু এখানেও মানুষ, মুখরোচক খাবার, অল্প দুরেই ভালো মানের শহর, থাকার যায়গা, যান বাহনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে।

কিন্তু রান অফ কচ-ই একমাত্র যায়গা এবং ভারতের সেই কর্নার যেখানে আগে থেকে সবকিছু বুক করে না গেলে, কোন কিছুই পাওয়া যাবেনা। না কোন যান বাহন, না কোন থাকার যায়গা না তেমন কোন খাবার। এতোটাই রুক্ষ, জন মানবহীন আর কোন রকম সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতা যে, দল বেঁধে, গাড়ি বুক করে রেখে, হোটেল, থাকা খাওয়া কনফার্ম করে না গেলে শুধু সাদা মরুভূমি দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আপনার, থাকবেনা। সেটাও খুব বেশী সময়ের জন্য সম্ভব নয়, শীতে জমে যাবেন, নয়তো বাতাসে উড়ে যাবেন অথবা না খেয়ে পড়ে যাবেন!

পকেটে যতই টাকা থাকুক, মনে যতই বল থাকুক, বুকে যতই সাহস থাকুক না কেন এখানে আপনি একা, অসহায় আর নিরুপায়। মূল শহর থেকেও রান অফ কাঁচের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার! শহর থেকে বের হওয়ার পরে আপনার নিজের বাহন ছাড়া পুরো পথে আর কোন বাহন নাও দেখা যেতে পারে! আর যদি দেখতে পাওয়াও যায় সেটাও খুবই নগণ্য। নেই কোন গ্রাম, কোন জনপদ, কোন বাজার ঘাট বা লোকালয়। শুধু সোজা চলে যাওয়া একটা মসৃণ পথ, যার দুইপাশের ধু ধু মরুভূমি আর হাতে গোনা যাবে এমন দুই একটি মরু বৃক্ষ! যে কারনে রান অফ কাচ আমার কাছে সবচেয়ে দুর্লভ, দুরূহ আর কঠিন যায়গা।

এমনকি তুরতুক যাওয়া আসার পথেও দুই চারটা গাড়ি চোখে পড়বে, আর্মি, সাধারন মানুষ বা টুরিস্ট জীপ পাওয়া যাবে কিছু সাহায্যের জন্য। কিন্তু রান অফ কাচ যাওয়া আসা করতে হবে একদম এক বা নিজের গ্রুপের সাথে। কারো কোন রকম সাহায্য পাওয়া মরুভূমিতে বৃষ্টির চেয়েও কঠিন আর অসম্ভব।

ভুজ স্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামি তখনো বুঝতে পারিনি যে এতোটা এতোটাই রিমোট কোন এলাকায় চলে এসেছি। কিন্তু স্টেশনের বাইরে পা রাখার পরেই মোটামুটি বুঝে ফেলেছিলাম এখানে আমি কতটা একা, কি ভীষণ একা।

এখানে কোন কমন বাহন নেই বললেই চলে। কারন মূল শহর থেকে বের হলেই সেখানে সে একা, সঙ্গীহীন আর নিজের মত করে সম্পূর্ণ স্বাধীন। একটা দিন সেই একাকী স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করেছিলাম আমার দেখা দুর্লভ রান অফ কচ গিয়ে।

কেন যেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে যেতে যেতে চারদিক দেখেই আমি এই নিস্তব্ধ শহরের অসহনীয় একাকীত্ব অনুভব করতে পেরেছিলাম, আর তাই তো ১৫০ রুপীতে বাসে যাওয়ার সুযোগ থাকা স্বত্বেও আমি ১৬০০ রুপী দিয়ে রিজার্ভ অটো নিয়ে নিয়েছিলাম সারাদিনের জন্য। নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়িয়ে, চিন্তাহীন ভাবে স্টেশনে ফিরে আসার জন্য। রিজার্ভ নিয়ে যাওয়া আর আসার পথের পুরো ২০০+ কিলোমিটারের প্রতিটা মুহূর্ত উপলব্ধি করেছিলাম বাসে না গিয়ে নিজের জন্য অটো হলেও রিজার্ভ নিয়ে কতটা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছি।

ঝকঝকে মসৃণ রাস্তায়, কনকনে শীত আর ঝড়ো বাতাস, বালুঝড়ের মধ্যে তিন তিনটা সোয়েটার, জ্যাকেট আর ওভারকোট পরেও জড়সড় হয়ে বসে থাকতে হয়েছিল পুরো ১০০ কিলোমিটার পথ। ৭০ কিলোমিটার যাওয়ার পরে নিতে হয়েছিল ১৫০ রুপী চার্জ দিয়ে রান অফ কাচ যাওয়ার বিশেষ অনুমোদন।

এরপর থেকে দুচোখ শুধু মেলেই রেখেছি শীত, বাতাস আর বালুঝড়ও উপেক্ষা করে। ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছিল আমার অটো। ধু ধু প্রান্তর পেরিয়ে আরও প্রায় ৪০ মিনিট পরে দেখা পেলাম দূরে ধবধবে সাদা প্রান্তরের। সেখান থেকে আরও ৬-৮ কিলোমিটার ভিতরে যেতে হয় দুপাশে সাদা মরুভূমির ভেতর দিয়েই। যদিও সেসব অনেকটা ধূসর হয়ে গেছে, মানুষ, উট আর উট গাড়ির অতি ব্যবহারের জন্য। অটো যাওয়ার শেষ প্রান্তে গিয়েই আমাকে নামিয়ে দেয়া হল। এরপর পায়ে চলা বা উটের পিঠে সামনে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। ভীষণ রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি নিয়ে নেমে গেলাম।

আমার সামনে চারদিকে যতটা দেখা যায়, ধবধবে সাদা একটা মরুভূমি! লবন আর পাথর কুঁচি যেগুলো খালি চোখে দেখলে বরফ মনে হবে। হাতে নিলেই কেবল বোঝা যাবে এগুলো আসলে বরফ নয়, কারন ঠাণ্ডা নেই আর গলেও যায়না! শক্ত, স্বচ্ছ, টুকরো কাঁচের মত। রোদ বা চাঁদের আলোতে চিকচিক করে, জ্বলজ্বল করে ওঠে ঝিলিক দিয়ে যায়। আমি পা রাখলাম সেই সাদা স্বচ্ছ আর চকচকে মরুভূমির শীতলতায়। পায়ে পায়ে একা একাই হেটে যেতে লাগলাম বিসৃত বাঁধাহীন প্রান্তরে। প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটলাম সোজা, যতটুকু যাওয়ার সাহস করতে পেরেছি। কারন অল্প কিছুদূর গেলেই পাকিস্থানের সীমান্ত আর নানা রকম বিপদ হলেও হতে পারে! তাই নিরাপদ দূরত্ব রেখেই নিজের মত করে হেটে বেড়ালাম, বসলাম ভেজা ভেজা সেই স্বচ্ছ পাথর কুঁচির উপরে। ছবি তুলেছি নিজেই নিজের অনিচ্ছা স্বত্বেও।

এক, একদম একা! কাছে পিঠে বা দূরে কেউ নেই, কেউ নেই! সাদা স্বচ্ছ মরুভূমির মধ্যে টকটকে লাল জ্যাকেট পরা ৩০০০ কিলোমিটার দুর থেকে আসা এক বাংলাদেশী! কি যে অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছিল সেই মুহূর্তে বলে বা লিখে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। কত গুলো দিনের অপেক্ষা, কত গুলো মাসের প্রতীক্ষা, চার চারটি বছর ধৈর্য ধরে বসে থাকা, তিন তিনবার যাওয়া আসার ট্রেন টিকেট কেটেও নানা কারনে আসতে না পারার যন্ত্রণার শেষ হল অবশেষে!

এমন আনন্দ, এমন সময়, এই ধরনের মুহূর্ত, এই অদ্ভুত ক্ষন গুলো আসলে কিভাবে উদযাপন আর উপভোগ করতে হয় আমার ঠিক জানা নেই! এই সময় গুলোতে আমি কেমন যেন বোবা হয়ে যাই, কেন যেন মাঝে মাঝে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, আমি কেন যেন স্মৃতি হারিয়ে ফেলি, বোধহীন হয়ে যাই!

কোন কিছুই ইচ্ছে হয়না, না ছবি তুলতে, না হাঁটাহাঁটি করতে, না চিৎকার করতে, না গলা ছেড়ে গান গাইতে! কিছুটা সময় আমার সবসময়ই এমন কাটে! যে কোন বহু কাঙ্ক্ষিত যায়গায় গেলেই। অনেকটা সময় বোধ আর ভাষাহীন থাকার পরে ধীরে ধীরে আমার চেতনা ফিরে আসে। আমি নিজেকে ফিরে পাই, কথা বলতে পারি, দেখতে শুরু করি, দুই একটা ছবি তুলি, নিজের সাথে কথা বলি। বিধাতার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তার এই দুর্লভ সৃষ্টি দেখার আর উপভোগের সুযোগ দেয়ার জন্য।

রান অফ কচ। তাকে প্রথম দেখে, তাকে ছুঁয়ে, তার স্পর্শ পেয়ে আমার একই রকম অনুভূতি হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। একটা অদ্ভুত সুখের পরশ অনুভব করেছিলাম মনে প্রানে, সকল অনুভূতি জুড়ে! অবশেষে আমার দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটেছিল দুর্লভ আর দুরূহ রান অফ কচ নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরে।