সাউথ অস্ট্রেলিয়ার মাউন্ট গাম্বিয়ার এক আশ্চর্য জনপদ। পরিচ্ছন্ন আর ছিমছাম শহর। আছে দেখার মতো বেশ কটি লেক। আমাদের আগ্রহ ‘ব্লু (Blue) লেক’ আর ‘ভ‍্যালি লেক’ দেখার। আছে বেশ কটি সিঙ্কহোল। আশ্চর্য জনপদ বলছি বেশ কয়েকটি কারণে।

ভাবতেই অবাক লাগে যে জনপদে পা ফেলেছি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে, তারও অন্তত ৩০ হাজার বছর আগে এখানেই ছিলো প্রাচীন অষ্ট্রেলিয় আদিবাসী, বন্ডিক জনগোষ্ঠির বাস। আবারো বলছি, ৩০ হাজার বছর কিন্তু! যেখানে মিশরীয় সভ‍্যতার বয়স মোটামুটি সাড়ে পাঁচ হাজার বছর।সেখানে ৩০ হাজার বছর আগে মানুষের বাস সেটা চিন্তা করলেও রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। এখানকার পাহাড়, বন, সমতলে ছিলো তাদেরই পদচারনা।হাজার হাজার বছর ধরে বন্ডিক মানুষগুলো এখানকার মাটি, জল, বন, পাহাড়ে মিশে ছিলো। এখানকার পাহাড়গুলো ছিলো তাঁদের মায়ের মতো। অতি পবিত্র আরাধনার তুল‍্য আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা। পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তৃত সমতলে কিংবা পাহাড়ের গুহায় ছিলো তাদেরই বাস। যেখানে হয়তো বাজতো আদিম মানুষের বুনো গান, বুনো সুর। বুনো শিশুরা হয়তো খেলে বেড়াতো এই সমতলে, দ্বিগবিদিক।

হাজার বছরের ব‍্যবধানে এই এলাকা এখন কেবলই শুনশান প্রকৃতির। কোথাও নেই তাদের কোন স্মৃতিচিহ্ন। কালের অতলে হারিয়ে গেছে সেই বন্ডিক জনগোষ্ঠীর সব স্মৃতি। হয়তো সব মুছে ফেলা হয়েছে বা মুছে গেছে… তবু রয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ বছর আগের আগ্নেরগিরি আর সেখান থেকে তৈরি লেক আর সিঙ্কহোল।

ব‍ন‍্য আর আদিম মানুষের এক সময়ের চির চেনা পথ আর প্রান্তরে আমাদের যাত্রা। কেমন যেন অচেনা, অজানা। অজানাতেই তো রোমাঞ্চ! সেই অজানাকে জানতেই ভিক্টোরিয়া থেকে যাত্রা দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় জনবহুল এই শহর মাউন্ট গাম্বিয়ার। ভিক্টোরিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র সতোরো কিলিমিটার পথ পেরুলেই দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এ শহর। যদিও মেলবোর্নে আমাদের অকুস্থল থেকে শহরটিতে যেতে পেরুতে হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশ কিলোমিটার পথ।

ছবির মতোন সাজানো এই শহরের উপকন্ঠে অনিন্দ‍্য সুন্দর পাইন কাউন্ট্রি ক‍্যারাভান পার্ক। এই ক‍্যারাভান পার্কে পৌঁছে দেখি আশে পাশে সবখানে ক‍্যারাভ‍্যানের ছড়াছড়ি। কেউ কেউ আবার ব‍্যাক্তিগত গাড়ির পাশে গেঁড়েছিলেন তাবু। এমন পঞ্চাশটি অস্ট্রেলিয়ান পরিবারের ক‍্যারাভানে জমজমাট ছিলো ক‍্যারাভান পার্কটি। এখানে অবশ‍্য অস্ট্রেলিয়ান সংস্কৃতির একটি অনুষঙ্গ না বললেই নয়…

অস্ট্রেলিয়ানদের একটি অভ‍্যাসে মুগ্ধ হতে হয়। সারা বছর তাঁরা কাজ করেন। কিন্তু তাঁদের মনটা উড়ো উড়ো। পায়ের তলায় শর্ষে দানার মতো। ফলে, স্থির থাকা কঠিন। একঘেয়ে জীবন তাঁদের একেবারেই পছন্দ নয়। বছরে বারে বারে এমন ক‍্যারাভ‍্যান পার্কে থাকা তাঁদের জীবন যাত্রার অংশ। বন-বাদার, মাটির কাছে থেকে ঘোরাঘুরি তাঁদের ভীষণ পছন্দ। নিজের বা ভাড়া করা ক‍্যারাভ‍্যান নিয়ে, বছরে কয়েকবার পরিবার সমেত বেড়িয়ে পড়া চাই। যদিও, আমরা ক‍্যারাভ‍্যান নয়, ভাড়া করেছিলাম ছোট এক কেবিন। ছোট, সুন্দর, পরিপাটি।

শহরের নানান দর্শনীয় স্থানে বেড়ানোর কালে আমাদের পরিচয় হয় নিউ সাউথ ওয়েলসের বায়রন বে থেকে আসা একটি পরিবারের সঙ্গে। নয় বছরের কন‍্যা আর সাত বছরের পুত্রকে সাথে নিয়ে এক বছরের জন‍্য ঘুরতে বেড়িয়েছেন বাবা মা। ঘোরাঘুরিতে খোরাকির টাকা আসবে কোথা থেকে? এমন প্রশ্নে নির্ভার পরিবারের কর্তা জানালেন, টাকা শেষ হয়ে গেলে দুই মাসের জন‍্য কোন এক শহরে থিতু হবেন। কাজ করবেন স্বামী আর স্ত্রী মিলে। টাকা জমলে আবার বেড়িয়ে পড়বেন অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে।এভাবে ঘুরে ঘুরে পুরো অস্ট্রেলিয়ার এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখার ইচ্ছা পরিবারটির। ঘুরুঞ্চি এই পরিবারটির সাথে কথা বলতে বলতে মনে হলো, আরে… আমাদের ব্লু লেক দেখতে যাবার কথা…

ক‍্যারাভান পার্ক থেকে ব্লু লেকের দুরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। উচুঁ পার্কিং লট থেকেই চোখে পড়লো অনিন্দ‍্য সুন্দর ব্লু লেক। গোলাকার উচুঁ পাড় আটকে রেখেছে টলমলে নীলাভ পানি। সেই পাড় ধরে আছে সুদৃশ‍্য পায়ে হাঁটা পথ। সাধারণত নভেম্বরে যখন অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্ম আসে, বৃষ্টি কমে যায় লেকের পানি পরিণত হয় হাল্কা নীলাভ রঙে। বছরে কয়েকবার আবহাওয়া আর বৃষ্টিপাতের সাথে তারতম‍্য হয় লেকের পানির রঙের। লেকের গভীরতা ৭৫ থেকে ৭২ মিটারের মতো।

লেকের একটি পয়েন্টে গিয়ে দেখি, লোহার শিকে শতশত তালা লাগানো। অস্ট্রেলিয়াতে অনেক উঠতিবয়সী ছেলে মেয়েরা কোনো একটি আইকনিক পর্যটন স্পটের গিয়ে সেখানে তালা দিয়ে তাদের ভালবাসার ঘোষণা করে থাকে যা “লাভ লক” (love lock) নামে পরিচিত। লাভ লকের সঠিক বাংলা কি আছে আমার জানা নেই তবে প্রেমের তালা বলা যেতে পারে। ধারণা করা যায় যে মনের মানুষকে সারা জীবনের জন্য বন্দী করার বাসনা থেকেই লাভ লক ঝোলানো হয়। অনেকে ১০, ২০ পর এমনকি ৬০ বছর পরে গিয়ে তাদের লাগানো লাভ লকের দেখা পেয়েছেন।

সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় দেখার মতো অনেকগুলো প্রাকৃতিক স্থাপনা তৈরি হয়েছে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে। এসব আগ্নেয়গিরি তৈরি হয় ২০-৩০ লক্ষ বছর আগে।থেকে থেকে অগ্ন‍্যুৎপাত হয়েছে। ধারনা করা হয় এই ব্লু লেকে  সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে এখানে সবশেষ অগ্ন‍্যুৎপাত হয়েছিলো। তারপর এটি ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে। পরিণত হয়েছে অনিন্দ‍্য সুন্দর লেকে।

প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল। ব্লু লেকের ঠিক দুই কিলোমিটারের মধ‍্যেই দেখা মিললো ভ‍্যালি লেকের। যেখানটার পানির রঙ সবুজাভ। মাউন্ড গাম্বিয়ার চূড়ার সেন্টেনারি টাউয়ার থেকে ভ‍্যালি লেকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। পাহাড়ের পাদদেশের সমতল ভূমি। দূরে সমতলের শেষপ্রান্তে আবছা মাউন্ট শ‍্যাঙ্কও চোখে পড়লো। যার সৃষ্টিও আগ্নেয়গিরি থেকে। সংক্ষিপ্ত সফরের কারণে মাউন্ট শ‍্যাঙ্ক ট্রেকিং জমা রেখেই এদফা ফিরতে হলো চেনা পরিবেশের মেলবোর্নে।