কোস্ট থেকে দূরে, মূল স্থলভাগের ভিতরের দিকের অঞ্চলকে বলে হিন্ডারল্যান্ড। এবার গোল্ড কোস্ট, সানশাইন কোস্ট, সাথে ব্রিসবেন মিলিয়ে দিন দশেক বেড়াবার একটা প্ল্যান করেছিলাম, আজকে সেই গল্পই  শোনাবো আপনাদের।

গোল্ড কোস্টে থীম পার্ক-টার্কে যাবার আগ্রহ ছিলনা। রেইন ফরেস্ট এর খোঁজ করতে গিয়ে দেখলাম ওই হিন্টারল্যান্ড এলাকাটা রেইন ফরেস্টের স্বর্ণভূমি। অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর দুইটা ফরেস্ট শর্টলিস্ট করলাম। ট্যাম্বোরিন আর স্প্রিংব্রুক। এইটূকু সহজ ছিল। কঠিন কাজ ছিল এত বড় ন্যাশনাল পার্কের কোন অংশটা দেখতে যাব? সময় কম, সাথে ছোট বাচ্চা। অনেক কিছু দেখতে চাই কিন্তু একদিনে এক/দুইটার বেশি স্পট কভার করা যাবে না। অনেক খুঁজে দুইটা ন্যাশনাল পার্কে দুইটা ফলস বাছাই করলাম। ট্যাম্বোরিন এ কার্টিস ফলস আর স্প্রিংব্রুক এ পারলিং ব্রুক ফলস। দুটার মধ্যে পারলিং ব্রুক ফলসটা এপিক পর্যায়ে পড়ে।

অস্ট্রেলিয়া আসার পর শুধু যে ট্রাভেল করার অনেক যায়গা পেয়েছি, তা নয়। ট্রাভেল করাটাও এখানে অনেক সহজ মনে হয়। আপনি বাসা থেকে বের হয়ে একটি স্পটে যাবেন এবং স্পট থেকে বাসায় ফিরবেন, এই পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা এত নির্ঝঞ্ঝাট আর আরামদায়ক যে ভ্রমনে কোন ক্লান্তি লাগেনা। নতুন জায়গায় ভাড়া করা গাড়ীতে গুগলে লোকেশন দিলাম শুধু, এক ঘন্টারও কম সময়ে সোজা ফলসের জন্য নির্ধারিত পারকিং এ ড্রাইভ করে পৌঁছে গেলাম। সেই রেইন ফরেস্টের ভিতরেও ক্যাফে, বাথরুম, নির্দেশনা সহ ওয়েল মেইন্টেইন্ড ওয়াকিং ট্রেইল- সব কিছুর ব্যবস্থা করা। রাস্তা কয়েক জায়গায় সরু হয়ে গেছে, কয়েক জায়গায় মেরামত চলছে কিন্তু সেখানেও চমৎকার ভাবে সবকিছু ম্যানেজ করা হচ্ছে।

বৃত্তাকার মূল ওয়াকিং ট্রেইলটা শুরু হয়েছে ফলসের মাথার একদম কাছ থেকে। ইন্টারনেটে সব জায়গায় বারবার লেখা ছিল ক্লকওয়াইজ হাঁটতে হবে। তাহলে নামার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবেন আর উঠার সময় খাড়া রাস্তা দিয়ে উঠবেন। উলটোটা করলে কষ্ট বেশী হবে। আমরা সেই মোতাবেক বাম দিকের পথ ধরলাম, ক্লকওয়াইজ ঘুরে অন্য দিক দিয়ে উঠে আসব। ফলসটা একদম খাড়া ক্লিফের মাঝে সুতরাং নীচে নামতে বা উপরে উঠতে হলে ভি শেপের দুই সাইডের ক্লিফ বরাবর অনেকখানি হাঁটতে হবে। উঠা নামা টোটাল দুই ঘন্টা। উপরে ফলস দেখার জন্য দুইটা ভিউ পয়েন্ট, আর একদম নীচে নেমে ফলসের গোড়ায় দাঁড়ানোরও জায়গা আছে।

দেশে বিদেশে বেশকিছু জলপ্রপাত দেখেছি। কিন্তু আমার লিস্টে এপিক পর্যায়ে গিয়েছে একমাত্র এই পারলিং ব্রুক ফলস। শুধু উঁচু জায়গা থেকে নীচে পানি পড়ছে, ব্যপারটা এত সিম্পল  না। ওই গহীন জঙ্গলের মাঝে এই খাড়া ক্লিফের নীচে দাঁড়িয়ে যখন উপরে তাকাবেন মনে হবে আকাশ থেকে স্রোতস্বিনী কোন নদী ধেয়ে আসছে আপনার দিকে। আগের কয়দিন বৃষ্টি হবার কারনে ফলসটা যেন তার পরিপূর্ণ রুপে সবার সামনে মেলে দেবার সুযোগ পেয়ে বসেছিল। এই ফলসের পানি প্রথমে পড়ে পাথরের উপর, তারপর নিচে পানি জমে আরে নদীর মত গড়িয়ে যায়। এতে যেটা হয়, আপনি নীচে দাঁড়ালে মনে হবে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে আপনার চারপাশে। জায়গাটির ভূপ্রকৃতিও অতূলনীয়। ছোট ছোট টিলা, গুচ্ছ গুচ্ছ গাছ গাছালি সব কিছু মিলিয়ে সেখানে একটা সিনেমাটিক পরিবেশ।

সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরলে আরও একটি বিস্ময়। মাত্রই যে নদীটি তৈরী হয়েছে, তার উপর একটি ব্রীজ বানিয়ে দেওয়া আছে। সেখান থেকে ভিউ আরও অসাধারন কারন এখন আপনি দাঁড়িয়ে আছেন জলপ্রপাতের একদম সামনে আর নীচে খরস্রোতা নদী। সেখানেও আপনি দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষন এই সৌন্দর্য এডমায়ার করতে পারবেন।

ফেরার পথে দুইটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। এক হচ্ছে আমি ও আমার স্ত্রী দুই জনকেই জোঁকে ধরে। আমারটা ছিল শিশু জোঁক তাই ধরার সাথে সাথেই টের পেয়ে যাই। আমার স্ত্রী অনেকখানি রক্ত হারিয়েছেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু এতই আকস্মিক ছিল যে আরেকটু হলেই বিপদ হতে পারত। আমাদের হাঁটার পথের উপরেই একটা রেড বেলী ব্ল্যাক স্নেক বিশ্রাম নিচ্ছিল। এদের কামড়ে যদিও মৃত্যু হবার সম্ভাবনা কম কিন্তু তারপরও তাদের বিষ আছে এবং শখ করে কোন সাপের কামড় খাবার ইচ্ছা আমাদের নেই। আমার পুত্রকে তখন ঘাড়ে নিয়ে হাঁটছিলাম তাই আমিও পুরোপুরি ব্যালেন্সে ছিলাম না, ভুল করে পাড়া দিয়ে দিলেই দফা রফা হয়ে যেত। আমাদের দেখা মাত্র সে একটু এলার্ট হয়ে গেছিল কিন্তু আমরা সাবধানে পিছিয়ে আসাতে সেও রাস্তা ছেড়ে নীচে গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম।

ফেরার সময় ফলসের শুরুটা দেখতে পারবেন। সেটা পার হয়ে গাড়িতে ফিরে ব্যান্ড এইড ট্রিট্মেন্ট নিতে হল। তখনও গিন্নির হালকা রক্ত ঝড়ছে। একটা গ্রুপকে দেখেছিলাম জুতার উপরটাও ঢেকে নিয়ে হাটতে, বুঝলাম অন্যরা প্রস্তুত হয়েই যায়।

সব মিলিয়ে শহরের কাছাকাছি খুবই নান্দনিক একটি স্থান। আর আমরা দেখেছি শুধু একটি ফলস, বাকি আরও অনেক কিছু আছে দেখার। বাদবাকি স্থান গুলোর গল্প অন্যদের কাছ থেকে শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।