অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের বিখ্যাত টুয়েলভ এপোসল থেকে লক আর্ড গৰ্জ গাড়িতে যেতে লাগে মাত্র তিন থেকে চার মিনিট। তাই পোর্ট ক্যাম্পবেল শহরের হোটেল থেকে রওনা হয়ে, এতো অল্প সময়ে পৌঁছে যাবো লক আর্ড গর্জে…বুঝতেই ধন্ধে লাগলো।
কার পার্কে নামার পর, চারপাশে চা গাছের মতো ঘনঝোপ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। এদিকে, ডিসেম্বরের গনগনে সূর্য মাথায় তখন আগুন ঢালছিলো। ফলে আমার কন্যা দীপিতার মেজাজ ক্রমেই তিরিক্ষি হচ্ছিলো।
ঘনঝোপের ভেতরে পায়ে চলার মেটে রাস্তা। পথেই যেন গন্তব্যে দিকে ধেয়ে নিচ্ছিলো। সেপথ ধরে কোন কোন পর্যটক ফিরছিলেন। কেউবা আমাদের মতোই।
লক আর্ড গৰ্জ নামটা দেখে তখন কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না। তাই কৌতুহল আরো বাড়ছিলো। পথে যেতে যেতেই ঝোপের ধারে বেশ কটা কবর দেখতে পেলাম। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে এপিটাফে পেলাম লক আর্ড জর্জের বিস্তারিত। পড়ে গা শিহরে উঠলো। হৃদয় বিদারক ঘটনা…
১৮৭৮ সালের ১লা জুন লক আর্ড নামের এক জাহাজ সমুদ্রের এ উপকূলে ডুবে যায়। যাতে প্রাণ যায় ৫২ জনের। মাত্র চারজন বেঁচে গিয়েছিলেন। জাহাজটি নারী শিশুদের নিয়ে লন্ডন থেকে মেলবোর্নে পথে পাড়ি জমিয়েছিলো। তিনমাস পর উপকূলের এখানটিকেই এসে, নতুন দেশে পা রাখার ঠিক আগেই, প্রায় সবার স্বপ্নের হয়েছিলো সলিল সমাধি!
সমাধি আর ইতিহাস পড়েদেখে মন ভারাক্রান্ত হলেও, এখানকার সমুদ্র উপকূল যে বিচিত্র লীলা তৈরি করেছে, তাতে চিত্ত প্রফুল্লই হলো। প্রায় ৮ তলা সমান কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামলাম সমুদ্রের বালুকায়। কারণ এখানকার তীর একদম খাড়া। সিঁড়ির বেয়ে না নেমে, সমুদ্রের পানিতে পা ভেজানোর আর কোন উপায়ই নেই।
নিচে নেমে বুঝলাম কেডস্ পায়ে রেখে বিপদ করেছি। কারণ বালুর কারণে হাঁটা দায়। নরম শুকনো বালুতে পা দেবে যাচ্ছিলো বারবার। বরং যারা ছিলেন খালি পায়ে তারা বেশ স্বচ্ছন্দ। তাই দেখে আমার স্ত্রী নীলিমা ও কন্যা দীপিতা জুতে খুলে নেমে গেলো ছোট্ট তীরে। আর তাদের জুতা পাহার দেয়ার চাকরি জুটলো আমার ভাগ্যে!
যাক, তীরে নেমে মনে হচ্ছিলো কুয়োর ভেতরে নেমেছি। তিনদিকে পাহাড়ের খাড়া তীর। একদিকে সমুদ্র। তাতে ঢেউ আঘাত হানছে। পাহাড়ের উঁচু খাড়া তীরের কারণে শব্দ বেরুতে পারছিলো না। সমুদ্রের গর্জন বিকট মনে হচ্ছিলো।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পাহাড় ক্ষয়ে ক্ষয়ে তৈরি হয়েছে বিচিত্র এই উপকূল। বোধ করি ক্ষয়ের এ ধারা এখনো চলমান। বাতাস স্রোতের ঝড় ঝাপটা সহ্য যতখানি পাথর টিকে গেছে তাই দিয়ে হয়েছে এমন অপরূপ উপকূল।