মালদ্বীপ: এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য

Avatar

Byমুনতাসীর মঈন, বাংলাদেশ

Dec 19, 2022 #ইকো সিস্টেম, #ইফতার, #ইবনে বতুতা, #ইসলামী, #এটোল, #এভারেস্ট, #এয়ারপোর্ট, #এশিয়া, #কচুরিপানা, #কড়ি, #কাঁকড়া, #কোরাল, #ক্যামেরা, #ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, #খ্রিস্টমাস, #ঘুরুঞ্চি, #চাইনিজ, #চাইনিজ মেডিসিন, #ছুটি, #জুলভার্ন, #ডাইভিং, #ডিনার, #ড্রিল, #তামিলনাড়ু, #ধর্ম, #নক্ষত্র, #নারিকেল, #নিদর্শন, #নিমোর, #নীল, #নৈশভোজ, #নোটিলাস, #নৌকা, #পর্যটক, #পান্না, #পালকি, #প্রকৃতি, #প্রবাল, #প্লেন, #ফুলের মালা, #বণিক, #বিপদাপন্ন প্রাণী, #বৃক্ষ, #বৃষ্টি, #বেবি সার্ক, #বৈদিক, #বৌদ্ধ, #ব্যবসা, #ব্যুফে, #ব্রাজিলিয়ান, #ভারত, #ভিক্ষুরা, #মহিলাদ্বীপ, #মাছ, #মাতৃতান্ত্রিক, #মালদ্বীপ, #মালাদ্বীপ, #মুনতাসীর মঈন, #মুসলিম, #রংবেরঙের মাছ, #রানী, #রিফ, #রিসোর্ট, #রেস্টুরেন্ট, #রোলার কোস্টার, #লাইফ জ্যাকেট, #লাক্কাদ্বীপ, #শামুক, #শ্রীলংকা, #সবুজ, #সংস্কৃত, #সহবস্থান, #সাগর, #সাঁতার, #সাবমেরিন, #সি টার্টল, #সি প্লেন, #সেন্ট মার্টিন, #স্টিং রে, #স্পীডবোর্ড, #স্বচ্ছ, #স্বর্ণের দিনার, #হাস্যজ্বল

সাবমেরিনের পেটে বসে নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সাবমেরিনটা হেলেদুলে ঠিক যেন পালকির মতো চলছিল। আমি ছোট বেলায় চলে গেলাম। একসময় খুব পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে জুলভার্ন পড়তাম। তখনকার পড়া টোয়েন্টি থাউজেন্ড লীগ আন্ডার দি সি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো আমি নোটিলাসে বসে আছি, ক্যাপ্টিন নিমোর পাশে। হালকা থেকে গাঢ় হতে থাকলো নীল। অদ্ভুত রং বেরঙের নাম না জানা মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে কোরাল বাগানে। চোখ ধাঁধানো রঙের সেই বাগান। কি সুন্দর, কি রহস্যময়! এক সময় সাবমেরিন কোরাল রিফের শেষ প্রান্তে এসে পড়লো নিচে গভীর খাঁদ। ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আমাদের হলুদ সাবমেরিন কচুরিপানার মতো বিশাল সমুদ্রে ভাসতে লাগলো। এভারেস্টের নিচে দাঁড়িয়ে যেমন গভীর শুন্যতা অনুভব করেছিলাম এখানেও তাই হলো। গভীর ঘোর লেগে গেলো। ছেলে ধাক্কা দিয়ে ঘোর ভাঙালো। বাবা এই মাছের নাম কি? আমি ফ্যাল ফ্যাল করে বললাম সি ফিস! আজ আমাদের মালদ্বীপের দ্বিতীয় দিন।

প্লেনের  ককপিটে যখন ক্যাপ্টিন বললো আমরা আর কিছুক্ষনের মধ্যে মালদ্বীপে ল্যান্ড করবো তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে এক অপার্থিব সুন্দর্য দেখলাম। গাঢ় নীল একটি আর্টিস্ট পেলেটের মধ্যে যেন আকাশি, ফিরোজা, সাদা আর সবুজের রঙের প্রলেপ। এ রকম ছোট বড় হাজার হাজার রঙের প্রলেপ পুরো পেলেট জুড়ে। এ গুলো এক একটা দ্বীপ। ঠিক যেন রঙের মালা।  কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন, মালদ্বীপ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মালাদ্বীপ থেকে যার অর্থ ফুলের মালার দ্বীপ। তবে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এ দ্বীপকে বলা হয়েছে ‘লাক্কাদ্বীপ’ বা শত হাজার দ্বীপ। তবে মালদ্বীপে এক হাজারের বেশি দ্বীপ থাকলেও এক লাখ দ্বীপ নেই। তবে বর্তমান মালদ্বীপে  ১১৮৪ টি দ্বীপ ও ২৮ টি প্রাকৃতিক অ্যাটল আছে। এর মধ্যে মাত্র ১৮৭টি দ্বীপ বসবাস উপযোগী।

আমাদের রিসোর্টটি ছিল এমনই এক দ্বীপে। রিসোর্টের নাম হার্ডরক হোটেল মালদ্বীপ। সাউথ মালে এটোলে এটি অবস্থিত। এটোল হচ্ছে দীর্ঘ বৃত্তকার প্রবল প্রাচীর। প্রবল প্রাচীরের পার ঘেঁষে রিসোর্ট গুলো গড়ে উঠেছে। মালে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ২০ মিনিট স্পীডবোর্ডে রিসোর্টে পৌঁছানো যায়। মালদ্বীপের ইন্টারন্যাশন এয়ারপোর্ট টা বেশ মজার। অন্য দেশের মতো না। অন্য যে কোনো দেশে আমরা এয়ারপোর্টে নেমে রাস্তা মাপি আর মালদ্বীপে মাপতে হয় সুমুদ্র। এয়ারপোর্টে নেমেই বিশাল সুমুদ্র। রিসোর্ট এ যেতে চাইলে উঠে পড়তে হয় স্পীডবোর্ড এ অথবা সি প্লেনে। আমাদের রিসোর্টের সদা হাস্যজ্বল ভুবন আমাদের রিসিভ করার জন্য এসেছিলো। চমৎকার ইংরিজিতে বললো “ওয়েলকাম টু দা হ্যাভেন” ছোট্ট এই লাইন জীবন তৃষ্ণা আরো বাড়িয়ে তুললো। কি চমৎকার মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। প্লানের ৪ বোরিং ঘন্টা জার্নি শেষে গাঢ় নীল সুমুদ্র যেন ইফতারের সরবতের গ্লাস। নোনা বাতাসে ঝরঝরা লাগলো শরীর নোনা স্বাদ ও যেন পেলো জিহ্বা। স্পীডবোর্ড চলতে শুরু করলো ছেলের চোখে আনন্দ মেয়ের চোখে উৎকণ্ঠা কারণ ততক্ষনে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগলো আমাদের স্পীডবোর্ডে। স্পীডবোর্ড বাম্প করতে লাগলো রোলার কোস্টারের মতো। ২০ মিনিট পর শান্ত হলো স্পীডবোর্ড আমরা ততক্ষনে গভীর সুমুদ্র থেকে রিফে পৌঁছে গেয়েছি। ধীরে ধীরে ল্যান্ডিং জেটি চোখে পড়লো। গাঢ় নীলের পর পান্না সবুজ পানি তার উপর সাদা দ্বীপ। জেটি সামনে আসতেই চোখে পড়লো রিসোর্টের সাত জন স্টাফ হাত নেড়ে আমাদের ওয়েলকাম জানাচ্ছে। তাদের দলপতি স্বর্ণকেশী রাশিয়ান আলিশা  চমৎকার হেসে সম্ভাষণ জানালো আর বললো মঈন ফ্যামিলিকে পেয়ে আমরা আনন্দিত। মনে হচ্ছিল কত দিনের চেনা।

রিসিপশনে ফরমালাটি শেষ করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের কাঙ্খিত ওয়াটার বাংলো তে। আমাদের বাংলোটি স্বচ্ছ নীল পানির উপর দুই রুমের কুঁড়েঘর। একটি মাস্টার বেডরুম আর একটি ড্রেসিং রুম। মাস্টার বেডরুমের সাথে লাগোয়া একটি টেরেস । টেরেসের এক পাশে আছে সিঁড়ি যা দিয়ে সরাসরি রিফে নেমে পরা যায়। আর টেরেসের আরেক পাশে এ মোটা সাদা দড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে বিশাল ট্রাম্পোলিন এবং তার ঠিক নিচে সুমুদ্র। বাচ্চারা লাফালাফি শুরু করলো ট্রাম্পোলিনে আমরা ও জয়েন করলাম তাদের সাথে আহা সে কি আনন্দ।  আসলে নামে কুঁড়েঘর হলেও আধুনিক বসবাসের সমস্ত সুযোগ সুবিধা মেলে এই বাংলোগুলো তে। ষ্টার রেটিং ভেদে বাড়তে থাকে সুযোগ সুবিধার পরিধি। কিন্তু কিছু ম্যাজিক ষ্টার রেটিং মানে না। এই ম্যাজিকের ম্যাজিশিয়ান হলো রিফের বাসিন্ধা বেবি সার্ক ,স্টিং রে , সি টার্টল আর অসংখ নাম না জানা রংবেরঙের মাছ। তারা ম্যাজিক দেখাতে হটাৎ হটাৎ চলে আসে বাংলো গুলোর ঠিক নিচে। উপর থেকে বসে তাদের খেলা ধুলা দেখতে বেশ লাগে। কতটা সহজ স্বাভাবিক ভাবে তারা ঘুরে বেড়ায় বাংলোর আশেপাশে। যেন আমাদের মতো তারাও ঘুরতে এসেছে মালদ্বীপে। এরকম মানুষের সাথে প্রাণীদের সহবস্থান দেখতে আমার বেশ লাগে। নিজেদের সর্বশ্রেষ্ট তাকিমা লাগিয়ে অহংকার করা আমার মোটেও ভালো লাগে না। পুরো ইকো সিস্টেমের আমার সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি থেকে ক্ষুদ্র মৌমাছি কে বাদ দিলে কয়েক বছরের মধ্যে বৃক্ষ শুন্য হয়ে পড়বে সবুজ পৃথিবী। তখন কি হবে চিন্তা করা যায়?

আমরা মালদ্বীপে গেয়েছিলাম ৭ই  জানুয়ারী। তখন মাত্র খ্রিষ্টমাস শেষ হয়েছে। কিন্তু পুরো রিসোর্ট জুড়ে ছিল খ্রিস্টমাসের সাজসজ্জা আর আমেজ। গোলাপি আলোয় আলোকিত পুরো রিসোর্ট। সেদিনই ছিল তাদের খ্রীষ্টমাস ডিনারের শেষ আয়োজন। সমুদ্রতটের সাদা বালির উপর বিছানো হয়েছে টেবিল। তার উপর মোমবাতি। সাগরের মৃদুমন্দ হাওয়া তার সাথে তাল মিলিয়ে ব্রাজালিয়ান এক ব্যান্ড দল বাজাচ্ছিল আভা মারিয়া। করুন আভা মারিয়া কেন যেন যীশুর লাস্ট সাপারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। জীবনের শেষ নৈশভোজে বসেছেন যীশু তার বারো জন শিষ্য কে নিয়ে। ভীষণ শান্ত স্বরে যীশু বললেন কাল তোমাদের মধ্যেই একজন আমার সাথে বিস্বাস ঘাতকতা করবে, ধরিয়ে দেবে আমাকে। যীশুর মুখে এই কথা শুনে এই বারো জনের কারো মুখে ভয়, কারো আগ্রহ ,কারো সন্দেহ ,কারো মুখে কৌতূহল, করো মুখে ঘৃণা কারো বা উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। কি অদ্ভুত !  এই নিয়ে একটি বিখ্যাত চিত্র আছে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির নাম “দা লাস্ট সাপার” আঁকা হয়েছিল মিলানের “সান্তা মারিয়া দেল্লে গ্র্যাছে”.এক বার এই ছবিটা দেখতে গেয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি পনেরো মিনিটের জন্য। গির্জায় ঢোকার শেষ সময় ছয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট আমার পৌঁছেতে পৌঁছেতে সাতটা বেজে গিয়েছিলো। সেই আফসোস আমার আজো গেলো না ! খৃস্টমাসের শেষ ডিনারের আয়োজনটা ছিল হুলুস্তুর রকমের। শুরুটাই এক গ্লাস শ্যাম্পেইন হাতে ধরিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার অনিত বললো ,আজ ডায়েটের কথা ভুলে যাও যা মন চায় খাও। নাম না জানা অসংখ খাবারে পরিপূর্ণ ব্যুফে, কমলা আলাস্কান ক্র্যাব লেগ, খরগোশের নরম মাংসের ফ্রেঞ্চ টেরিন, সদ্যতোলা নীল রিফের ওয়েস্টার ,চীজ হুইলে মাখানো গরম গরম পাস্তা আরো কত কি! অনিতের সাথে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিলো , মালদ্বীপের প্রথম দিকের জনবসতিদের মধ্যে অন্যতম ছিল তামিলরা যারা প্রাচীন তামিলকাম থেকে এসেছিলো। এই তামিলকামই বর্তমানে ভারতের তামিলনাড়ু । সেই সময়ে যে সমস্ত পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছিল তারা সকলেই রানী দ্বারা শাসিত এ রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। শ্রীলঙ্কান প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’-এ মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘মহিলাদ্বীপ’ বা নারীদের দ্বীপ।তার মানে বুঝা যায় মাতৃতান্ত্রিক এক সমাজ ব্যবস্তা ছিল এই মালদ্বীপে। লুইস মরগানের একটি চমৎকার বই আছে নাম এনসিয়েন্ট সোসাইটি। সেখানে লেখকের দাবি আদিমকালে সকল গোষ্ঠী নাকি ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কি মজার একটা ব্যাপার মা দের চোখ রাঙ্গানি খেয়ে বাবারা চুপ করে বসে থাকতো  এরপর সম্রাট অশোকের সময় বুদ্ধ ভিক্ষুরা যেয়ে মালদ্বীপে বসবাস শুরু করে। তখন ই বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার পায় । এখনো প্রচুর নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক দ্বীপে। ১২ শতকের দিকে মুলসিম বণিকেরা বেবসা করতে ভারত সাগরে এসে ঘাঁটি গাড়ে মালদ্বীপে। শুরু হয় দীর্ঘ ইসলামী যুগের। গল্প শেষে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম স্বপ্নের সেই স্বপ্নকুটিরে । বাচ্চারা কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাদের বিছানায় রেখে আমরা শুয়ে রইলাম নেটের তৈরী টেরেসের সেই ট্রাম্পিলিনে। আকাশে তখন উঠেছে অনন্ত নক্ষত্র বীথি।  তারায় পরিপূর্ণ আকাশ। এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে অনন্ত জীবন বেঁচে থাকার লোভ জাগে। তখন ঠিক বারোটা। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের বিয়ের বারো বছর পূর্ণ হলো।

সকালে ঘুম ভাঙলো মৃদু ঠক ঠিক শব্দে। উঠে দেখি ঘরে বেড়াতে এসেছে দুটো সাদা ড্রিল। ড্রিল হচ্ছে ছোট সাদা শামুক।  হাঁটার সময় টালির সাথে শক্ত শেলের বাড়িতে শব্দ হচ্ছিলো ঠক ঠক। কিছুক্ষন বাচ্চাদের নিয়ে তাদের সাথে খেলে বাচ্চাদের বললাম তাদের ফিরিয়ে দিতে রিফে। মালদ্বীপের সহ প্রাচীন পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলের মুদ্রা ছিল কিন্তু এক ধরণের শামুক তা আমরা কড়ি নামে চিনি। ১৩৪৪ সালে ইবনে বতুতা মালদ্বীপে এসে দেখেছিলেন প্রতি বছর মালদ্বীপ ৪০ জাহাজ কড়ি রপ্তানি করতো। প্রশ্ন জাগে কেমন ছিল এই কড়ির আর্থিক মান ? তখন চার লক্ষ্য কড়ি দিয়ে একটি স্বর্ণের দিনার পাওয়া যেত।

এবার রিফে নামার পালা। রুমের সামনে টেরেসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লাম স্বচ্ছ পানিতে । পানির তাপমাত্রা চমৎকার আরামদায়ক। কোমর পর্যন্ত পানিতে অনায়াশে হাটা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। নরম বালিতে কিছুক্ষন হাটার পর শরীর ভাসিয়ে দিলাম পানিতে। সাদা বালির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ কোরাল তার মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট রং বেরঙের  মাছ। হাতদিয়ে ধরতে গেলে দৌড়ে পালায়। ততক্ষনে ছেলে কোরাল সংগ্রহে নেমে পড়েছে। রং বে রঙের কোরাল সংগ্রহ করে পকেটে পুরে রাখছে। ছেলে শুনে অবাক হলো এই কোরল গুলোর ও এক সময় প্রাণ ছিল , পরে বুড়ো হয়ে মরে গিয়ে তারা জমতে শুরু করে সাগরের তলদেশে। মরে যাবার পর তাদের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের একটি পাথরে স্তর তৈরি হয় আর সেটাকেই আমরা প্রবল বলি। এই প্রবালগুলো এভাবে লক্ষ্য লক্ষ্য বছর জমে এক একটি পাথর আকৃতি নেয় আর কোটি কোটি বছর জমে একটি দ্বীপ সৃস্টি করে। কি অদ্ভুত প্রকৃতির খেয়াল। ছেলেকে বললাম কোটি কোটি বছর পুরোনো এই পাথর বাগান কোনো ভাবেই নষ্ট করা উচিত নয় । এরা খুবই দুর্লভ। পৃথিবীতে অল্পকিছু আছে যার মধ্যে একটি আছে আমাদের দেশে। যাকে আমরা সেন্ট মার্টিন বলে জানি। সেন্ট মার্টিনের কথা বলতে বলতে মন খারাপ হয়ে গেলো। দেশে এতো সুন্দর একটা দ্বীপ আছে যাকে ইচ্ছে করলেই এমন মালদ্বীপের মতো করা যেত কিন্তু আমরা চরম অবহেলায় ফেলে রেখেছি। গুন গুন করে গাইতে লাগলাম,

জনম গেল বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে, শক্তিদাতা
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা’

রিফে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা সাবমেরিনের প্রোগ্রাম করলাম। রিসোর্টে একটি ছোট সাবমেরিন আছে। সেটা ঠিক সাবমেরিন না সাবমেরিন আকৃতির এক নৌকা  বলা যায়। নিচের দিকে ফাঁকা একটা জায়গায় ছয় সাত জন বসতে পারে চারিদিকে স্বচ্ছ জানালা দিয়ে ঘেরা। রিফের অপুরূপ সুন্দর্য দেখতে এই সাবমেরিনের জুড়ি নেই। স্নোরক্লিং করে অল্প একটু জায়গা ঘুরে দেখা যেতে পারে আর ভালো ডাইভিং এর জন্য দরকার ট্রেনিং এর এই দুটোর মাঝে এই ধরণের সাবমেরিন ট্যুর ভালো অপসন হতে পারে। সাবমেরিনের বর্ণনা প্রথমেই একটু বলেছিলাম। কিন্তু তার সুন্দর্য ভাষায় প্রকাশের শব্দ আমার ডিক্শনারিতে নেই।

আমাদের রিসোর্টর ছোট বড়ো মিলিয়ে মোট পনেরোটা রেস্টুরেন্ট ছিল। তার মধ্যে কিছু ইন্টারন্যাশনাল চেইন রেস্টুরেন্ট। মিনিস্ট্রি অফ ক্র্যাব তেমনি এক রেস্টুরেন্ট। আজ ডিনারের জন্য আমরা সেই রেস্টুরেন্টে যাবার প্ল্যান করলাম। এই মিনিস্ট্রি অফ ক্র্যাব এশিয়ার ছয়টি দেশে তাদের রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছে। ওয়ার্ল্ডস ফিফটি বেস্ট রেস্টুরেন্ট এ তাদের অবস্থান পঁচিশ। বড় বড় কাঁকড়া ই তাদের প্রধান আকর্ষণ। তাদের প্রধান নীতি হলো তারা ফ্রজেন ফুড সেল করে না। এই জন্য তাদের বিশাল ঝামেলা পোহাতে হয়। মালদ্বীপের এই রেস্টুরেন্টে তাদের কাঁকড়া গুলো আসে প্রাইভেট প্লেন করে শ্রীলংকা থেকে। তারপর তাদের বসবাস উপযোগী একটি চৌবাচ্চায় জ্যান্ত সংরক্ষণ করা হয় প্লেটে সার্ভ করার আগ পর্যন্ত। কাস্টমার অর্ডার করার পর জ্যান্ত কাঁকড়া নিয়ে আসা হয় সাইজ ঠিক আছে কিনা দেখানোর জন্য। এখানে প্রায়  দশ সাইজের কাঁকড়া পাওয়া যায়। সবচেয়ে ছোটটা হাফ কিলো আর সব চেয়ে বড়টা দুই কিলো। তারা প্রায় পাঁচ রকম ভাবে ক্র্যাব রান্না করতে পারে। এর মধ্যে পিপার ক্র্যাব অসম্ভব জনপ্রিয়। আমরা পিপার ক্র্যাব অর্ডার করেছিলাম সাথে ছিল ক্র্যাব লিভার পাটে এপেটাইজারে । ছোট্ট একটি বিস্কুটের উপর এই ক্র্যাব লিভার পেস্ট জেলির মতো লাগিয়ে উপরে ম্যাপেল সিরাপ দিয়ে কুট্টুস করে কামড় দিয়ে খেতে হয়। মেইন ফুড দুই কেজির বিশাল পিপার ক্র্যাব খাবার জন্য ঘাম ঝরানো জরুরি। রীতিমতো ছেনি বাটাল নিয়ে ভাঙতে হয় ক্র্যাবের শক্ত খোল তারপর বের হয় কাঙ্খিত সাদা মাংস। পিপার সসে ডুবিয়ে সেই মাংস মুখে পুরে অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায় জগৎ সংসারকে। ডেজার্টে ছিল নারিকেলের খোলে তৈরী ফ্রেঞ্চ ক্রিম ব্রুলে। এবার ঘুম।

আজ ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির শব্দে। সে কি বৃষ্টি ! গতকালের ভেজা কাপড় গুলো শুকাতে দেয়া হয়েছিল টেরেসে সেগুলো আবার ভিজে গেলো। রুমের দরজা খুলে টেরেসে গিয়ে নতুন রঙের আভা দেখলাম । সবুজ সুমুদ্র আরো সবুজ দেখা যাচ্ছে আর উপরে কালো আকাশ। সে কি রূপ! সমুদ্র ভয়ঙ্কর হতে লাগলো বাড়তে লাগলো বৃষ্টির তেজ,মালদ্বীপের বৃস্টি নাকি ভয়ঙ্কর একবার শুরু হলে এক সপ্তাহ। মন খারাপ হয়ে গেলো। আরো দুই দিন যে থাকতে হবে! কিন্তু কিছুক্ষন পরই আকাশের মেঘ কেটে গেলো চমৎকার এক সূর্যের দেখা পেলাম। পুরো পরিবার নিয়ে রিফে নেমে গেলাম। গতকাল নাকি এক বিশাল মান্তা রে ঢুকেছে রিফে। এই প্রাণীটা বেশ মজার। এরা নাকি তেইশ ফিট পর্যন্ত চওড়া হতে পারে ! অদ্ভুত দর্শনের জন্য এদের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে ভীষণ ভয় পেত। প্রাচীন কালে নাবিকরা বিশ্বাস করতেন যে তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক এবং নোঙ্গরগুলিতে টান দিয়ে নৌকো ডুবতে পারে। পরে যখন ডাইভিং জনপ্রিয় হয় তখন মানুষ বুঝতে শিখে এরা নিরীহ গোচের প্রাণী আর শুরু করে তাদের উপর অত্যাচার। তাদের ফুলকা চাইনিস মেডিসিনের এক দুর্মূল্য উপাদান তাদের এই ফুলকা জন্য হাজার হাজার মান্তা রে প্রতি বছর মারা হয়। তাদের সংখ্যা নাটকীয় ভাবে কমে যাওয়াতে গত বছরই তাদের বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকা ভুক্ত করেছে। দুপুরে যখন আমরা পানি থেকে উঠে লাঞ্চ করেছিলাম তখনি দেখা মিললো সেই বিশাল কালো মান্তা র। প্রবল দাপটে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিফে। মাছদের খেলা দেখতে দেখতে বিকেল নামলো,বেগুনি হয়ে উঠলো আকাশ। রিফের সেই আকাশি পানি কিন্তু তখনো আকাশি কিন্তু কিছুটা কালচে। চমৎকার বেগুনি আকাশের নিচে আকাশি সুমুদ্র ঠিক যেন কোনো পেইন্টিং। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে যে কোনো শিল্পীর মনে হতে বাধ্য এখানে বাকি জীবন কাটালে মন্দ হতো না। সারাদিন শুধু ছবি আঁকবো ফিরবো না আর যান্তিক নগরে। সত্যি সত্যি এমন পাগলামি কিন্তু একজন করেছিল ,তার নাম ছিল পল গোগাঁ। ফ্রেঞ্চ শিল্পী গোগা তাহিতি নামক এক দ্বীপে যেয়ে প্রেমে পরে যান তার পর সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে আমৃত্যু বসবাস করতে থাকেন সেই দ্বীপে।

 মালদ্বীপের এই তটে বসে গোগার মনের অবস্থা টের পাচ্ছিলাম। এই ক্ষুদ্র জীবনে খুব বেশি কিছু কি দরকার? পৃথিবী এতো সুন্দর কেনো? মন খারাপ হয়ে গেলো, কিন্তু তবুও ফিরে যেতে হবে কাল।  আকাশে তখন তারা ফুটে উঠছে। বেগুনি থেকে গাঢ় নীল হচ্ছে পৃথিবী।