অনেকদিনের শখ ছিল হরিণ শিকারের। কিন্তু সময় আর সুযোগ দুটোই প্রতিকূলে ছিল। কাজের এক কলিগের সাথে শিকার নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম সে প্রফেশনাল শিকারী। তার কাছ থেকে আরও জানতে পারলাম হরিণ শিকার অস্ট্রেলিয়ার কিছু কিছু জায়গায় বৈধ। কারণ ঐসব জায়গায় হরিণ কৃষকদের ফসল নষ্ট করে ফেলে।তাছাড়া বন্য কুকুর ছাড়া আর তেমন কোন মাংসাশি  হিংস্র প্রাণি না থাকায় সেসব জায়গায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত হরিণ দেখা যায়। তাকে বললাম, এরপর যখন শিকারে যাবে তখন আমাকেও সাথে নিয়ে যেও। দশ মিনিট পর সে এসে জানালো পরবর্তী সপ্তাহে সে আমাকে নিয়ে হরিণ শিকারে যাবে।

পরের সপ্তাহে সিডনি থেকে আমরা ভোর পাচঁটায় রওয়া হলাম ভিক্টরিয়া-নিউ সাউথ ওলেসের বর্ডার অলবেরী-উদঙ্গার উদ্দেশ্যে। টানা ছয় ঘন্টা ড্রাইভের পর আমরা পৌঁছালাম  মিতা মিতা (Mitta Mitt ) নামে ছোট্ট একটি গ্রামে। পথে ফাস্টফুড শপে নেমেছিলাম লান্চ করার জন্য। কারণ আগামি পাঁচদিন ক্যানফুডই ভরসা।

মিতামিতায় আমরা একটা লেকের পাশে কেম্পিং এরিয়াতে রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। গাড়ি থেকে নেমে মনে হলো, এ যেন কোলাহল আর কৃত্তিমতা হতে অনেক অনেক দূরে লুকায়িত এক স্থান! বহমান পানির রিমঝিম শব্দ, গাছের পাতা নিয়ে বাতাসের খেলা আর ঝিঝি পোকার একটানা কর্কশ সুরের সাথে পাখিদের মিষ্টিমধুর সুরের তাল- এযেন প্রকৃতির প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন স্বত্তা গাইছে আপন সুরে। আর তাদের সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে এক অকল্পোনীয় আবেগি তাল।

আমরা তাঁবু টানালাম লেকের পাশ ঘেঁষে। তারপর তাড়াতাড়ি করে বের হলাম হরিণের খোঁজে। ফোর হুইল ড্রাইভে করে উঠতে থাকলাম মাউন্ট বেনামরায়। প্রায় একঘন্টা পর পাহাড়ের চূড়ায় উঠেও কোন হরিণের দেখা পেলাম না। পাহাড়ের চূড়ার লুকআউটে নেমে হরিণ না পাওয়ার কষ্ট ভুলে গেলাম। জায়গাটা এত সুন্দর ছিল যে কিছুক্ষনের জন্য ছবি তোলার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম। সূর্যাস্ত দেখে কেম্পে ফিরার পথে হেজার্ড লাইটে দুটি চোখ দেখে গাড়ি থেকে নেমে আস্তে আস্তে এগুতে শুরু করলাম। কিন্তু বিধি বাম! কিছু বোঝার আগেই হরিণটি হারিয়ে গেল জঙ্গলে। সাধারণত রাতে হরিণরা পানির খোঁজে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসে।

“সূর্যাস্তে পর হরিণ শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ”

কেম্পে ফিরে এসে শুকনো পাতা আর ডাল দিয়ে আগুন জ্বেলে বেইকড বিন আর টিন টুনা গরম করে রাতের খাবার খাওয়া হলো। প্রকৃতির শুনশান নিরবতা ছিন্ন করে ভেসে আসা পোকার শব্দ শুনতে শুনতে কখন যেন তাঁবুর মাঝে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন ভোর চারটায় অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে পড়লাম হরিণের খোঁজে। পয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছালাম গতকালের নির্ধারিত স্থানে। টানা দুঘণ্টা ঘাপটি মেরে বসে থাকার পরও কোন হরিণের দেখা পেলাম না। সূর্যের তাপ বাড়ছিলো, তাই কিছু লুকআউট ঘুরে ফিরে আসলাম কেম্পে। পাহাড়ি লেকে গোসল সেরে কাপড় ধুয়ে নিলাম। ঐ দিন আর কোথাও না গিয়ে কেম্পেই সময় কাটালাম।

পরদিন আবার খুব ভোরে ঘুম ভাঙে। তাঁবুর বাইরে ঘন কুয়াশায় আগুন জ্বেলে চা বানালাম।

চা খেয়েই আমরা হরিণের খোঁজে বের হলাম। অনেক্ষণ পর একটা বাচ্চা হরিণের দেখা পেলাম। হরিণ সাধারণত কিছু দেখলে দু-চার সেকেন্ডের মাঝেই পালিয়ে যায়। কিন্তু এই বাচ্চা হরিণটা আমাদের দেখে কোন ভয় না পেয়ে আমাদের সামনেই সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। আমার কলিগ হরিণটার দিকে বন্দুক তাক করেও আর গুলি ছুঁড়ে নাই। তার বন্দুক তাক করা দেখে আমার ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো! পরে জানতে চাইলে সে বলে, হরিণের ছোট বাচ্চা দেখে তারও মায়া লাগছিলো।

শিকার কিংবা গহিন জঙ্গল নিয়ে আমার জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। জঙ্গলের ভেতর একশ মিটার হাঁটতে তিনশ মিটার ঘুরে যেতে হয়। এখানে ওখানে পড়ে আছে বড় বড় গাছ আর গাছের ডালপালা। আর সব পরিত্যক্ত গাছ মুড়ে বেড়ে উঠেছে কাঁটাযুক্ত পরগাছা! প্রতিটা পা বাড়ানোর আগে দেখে নিতে হয় কোথায় পা ফেলছি। একটু অসাবধান হলেই পা পড়তে পারে কোন গর্তে, সাপ বা বিষাক্ত পোকামাকড়ে। আর একটা কথা জানানো প্রয়োজন, এখানে বন্য কুকুরের অনেক উপদ্রব। সাধারণত একসাথে অনেক বন্য কুকুর মিলে শিকারে বের হয়। সুতরাং শিকারে সবসময় সাবধান থাকা একান্ত আবশ্যক।