প্রিয় সাইকেলকে পুকুর পাড়ের গাছের ছায়ায় রেখে, ছেলেটা বিজনেস অনুষদ ভবনে ঢুকেছিলো একটু ওয়াশরুম ব্যবহার করতে। ফিরে এসে দেখে অনেকটা রবি বাবুর নায়িকাদের মত একজন আমার ওর প্রিয় সাইকেলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বেশ কৌতুহল নিয়ে। ছাড়া চুল, চোখে চশমা, একটা ছোট টিপ আর মুখে বেশ মিস্টি হাসি নিয়ে মাঝে সাইকেল আর সাইকেলের মালিকদের দিকে দুই একবার আড় চোখে দেখছে।
ব্যাপারটা ছেলেটার চোখ এড়ালোনা। যদিও মিস্টি মেয়েটির তার একজন ছেলে বন্ধুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। তারপরও তার অদূরে দাড় করানো একটা সাইকেল আর সাইকেলের পাশেই লাল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে থাকা ছেলেটির দিকে বার কয়েক তাকিয়েছে।
যদিও এসবে পাত্তা দেয়ার সময়, বয়স, সুযোগ, ইচ্ছা কোনটাই ছেলেটির নেই। তবে একটা মিস্টি মেয়ের কিছুটা কৌতূহল তাকে কিছুটা আলোড়িত করলো বৈ কি!
ছেলেটা মেয়েটির তুলনায় ভীষণই সাধারন। একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, একটা সাধারণ টি-শার্ট, কানে হেডফোন, মাঝে মাঝে অফিসের দুই একটা ফোন এটেনড করছে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে। সাথে পাশের মেয়েটির কৌতুহলী চাহুনিও খেয়াল করেছে। চা শেষ হতে না হতে, মেয়েটির বন্ধু উঠে চলে গেল। চা শেষ করে ছেলেটি সাইকেলে উঠবে ঠিক এমন সময় পাশের মেয়েটি হুট করেই সাইকেলের সামনে চলে এলো। ছেলেটি তখন মাথায় হেলমেট আর হাতে গ্লাভস পরছে।
হ্যালো ভাইয়া, আমি পদ্ম! আপনি? মেয়েটির অকপট জিজ্ঞাসা?
আমি গল্প, অবাক অভিব্যক্তিতে ছেলেটির উত্তর।
এভাবে হুট করে কথা বলাতে নিশ্চয়ই খুব অবাক হলেন!
হ্যাঁ সেটা হওয়াটাই তো। যুগ যতই আধুনিক হোক না কেন, একটা একদম অপরিচিত কোন মেয়ে এসে একজন আগুন্তকের সাথে এভাবে কথা বলবে ততটা সহজ হয়নি সমাজ।
কিন্তু আমি যদি আপনাকে আরও অবাক করে দেই, সেটা কেমন হয় বলুন তো!
আরও অবাক করবে? সেটা কিভাবে? তুমি এখানে পড় নিশ্চয়ই?
জি এখানেই পড়ছি, হ্যাঁ আপনাকে অবাক করে দিতে চাই! কিভাবে জানেন তো!
কিভাবে?
এই আপনাকে না জেনে, না শুনে, না ভেবে শুধু আপনাকে দেখেই আপনার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে!!
এই কথা শুনে ছেলেটা অট্ট হাসিতে ফেটে পরলো আর বলল, তোমার ইচ্ছে করছেনা, তুমি প্রেমে কিছুটা পড়েই গেছো!
কিভাবে বুঝলেন! আর আপনি যে আমাকে না জেনেই তুমি করে বলছেন!
শোন তুমি আমার অনেক ছোট, যেহেতু এখনো পড়ছো, তার মানে সবচেয়ে উঁচু ক্লাস ও যদি হয়, তবে মাস্টার্স। আমি তোমার চেয়ে অন্তত ১৫ বছর আগে মাস্টার্স করেছি, তাও যদি তুমি মাস্টার্সের হও। এরচেয়ে কম হলে আমি আরও বড়। তাই তুমি করে বলতেই পারি।
আর তুমি যেটাকে প্রেমে পড়া ভাবছো ওটা আসলে প্রেম নয়, এটা একটা সময়, কিছুটা মুহুর্তের, একটা ক্ষনের, কোন ভালোলাগার মত বিষয়বস্তুর প্রতি তোমার সুপ্ত থাকা মুগ্ধতা। সেটা কি তা অবশ্য তুমিই ভালো বলতে পারবে।
আপনি তো দেখছি আমার চেয়েও অকপট! আমার সাথে কথা বলতে ক্যাম্পাসের অনেক ছেলের হার্টবিট বেড়ে যায়, চোখে চোখ পড়লে মাথা ঘুরে রাস্তায় পরে যাওয়ার উপক্রম হয় আর আমি যদি যেচে কারো সাথে কথা বলি তবে তার তো বোধয় চাওয়া পাওয়ার আর কিছু থাকেনা!
সেখানে আপনি এতোটা অকপট, তাও একদম অপরিচিত কোন মেয়ের সামনে! এটা তো আমাকে আরও বেশি করে আপনার প্রেমে পড়াতে চাইছে!
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন পুকুরের পাড় ধরে হাটতে থাকলো, গাছের ছায়া, কাচা রাস্তা আর টলটলে পুকুরের পাশের ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে মেখে। আচ্ছা বলত, কেন তোমার আমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হল?
কারন আপনাকে ঠিক আমার স্বপ্নের মত করে দেখতে পেয়েছি। কি চমৎকার একটা সাইকেল, দেখেই লোভ লাগছে! আর সেই সাথে আপনি, এক পলকেই ভালো লেগে যাওয়ার মত! বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি বেশ একটা উদাসীনতা!
উদাসীনতাও বুঝি প্রেমে পড়ার একটা অনুষঙ্গ! জানতাম না তো!
না মানে জানেন কি, মেয়েরা না উপেক্ষা, উদাসীনতা সইতে পারেনা। ছেলে গুলো না খুব বোকা, সারাক্ষণ গা ঘেসা টাইপ হয়, গায়ে পড়ে কথা বলতেই ওদের যত আকুলতা! জোর করে বন্ধু হবার নানা রকম কায়দা ওরা জানে।
কিন্তু কেউ এটা একবারও এপ্লাই করেনা, যে একটা মেয়েকে একটু উপেক্ষা, কিছুটা উদাসীনতা মেয়েদেরকে বরং ছেলেদের কাছে টেনে আনে! কোন মেয়েই এসব সহ্য করতে পারেনা, তাই তো ছেলেদের কাছে তখন নিজ থেকেই গুরুত্ব পেতে নানা রকম ছাড় দেয়!
বাহ, বেশ বলেছো তো। কিন্তু আমি তো তোমাকে কোন রকম উপেক্ষা বা উদাসীনতা দেখানোর মত কিছু করিনি বা তেমন সময়ই পাওয়া যায়নি। তাহলে তোমার কেন আমার কাছাকাছি আসতে, প্রেমে পড়তে, কথা বলতে ইচ্ছে হল?
ওই যে বললাম, আমার স্বপ্নের সাথে মিলে গেছে তাই। শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া!
কিভাবে স্বপ্নের সাথে মিল হল! আর কোন একটা ব্যাপার বাদ পরলো?
এই শুধু ইচ্ছার সাথে হাইট টা একটু কম হয়েছে! আর বাকি সবকিছু একদম আমার মনের মত করে পাওয়া গেছে!
কেমন বল তো শুনি?
সময় আছে আপনার?
ঘুরতেই তো এসেছি, সবুজ প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে। সময় পালাবে কোথায় বল?
তাহলে চলুন প্রিয় পথে চলতে চলতে গল্প করা যাক।
চল, হাটতে হাটতে হল গুলোর পিচ ঢালা পথ পেরিয়ে লাল ইট বেছানো আবাসিক এলাকার দিকে চলে গেল।
শুনুন, একটা আলগোছে ছেলে, মেয়েদের প্রতি সাথে খুব বেশি গা ঘেঁষে থাকেনা, দেখতে শুনতে মোটেই যেন হিরো টাইপ না হয়, কিন্তু স্মার্ট, সাহসী আর গায়ে পড়া হবেনা এমন ছেলে আমার পছন্দের তালিকায় প্রথম।
আর পরেরটা হল, সাইকেল। আমার অন্যতম প্রিয় বাহন, বন্ধু, চলার সাথী, সুখ দুখের সাক্ষী আর সেই সাইকেল পছন্দ করে তেমন ছেলে আমার ভীষণ ভালোলগে। সাইকেল থাকা কিন্তু নয়, সাইকেলটা যার প্রেম, ভালোবাসা, ভালোলাগা, সাইকেল যার কাছে প্যাশন, তেমন একটা ছেলে যদি হয়, উপরে দেয়া বর্ননার মত করে, তবে তো সোনায় সোহাগা!
আপনি সাইকেলটা রেখে যাওয়ার আগে আর ফিসে এসে পরে তার প্রতি আপনার যে চাহুনি, যে দরদ, যে আকুলতা আমি দেখলাম, হয়তো সেটা আপনি নিজেও জানেন না। খুব ভালোবাসেন বুঝি তাকে!
খুব মানে খুব! ওকে আমি কখনো কাঁদায় চালাইনা! কাঁদা পথ পেলে আমি হেটে ওকে কোলে তুলে নেই!
কখনো খুব বেশি ভাঙাচোরা পথ সামনে এলেও আমি ওকে কোলে তুলে নেই!
আমি প্রতিদিন ওর যত্ন নেই। মুছি, পলিশ করি, আদরে, আহলাদে রাখি!
আপনি তো আমার পুরো প্যাকেজ! একদম মনের মত! সাথে বাড়তি যোগ করেছেন আপনার উপেক্ষা বা উদাসীনতা!
কই? উদাসীনতা কোথায় দেখলে?
ওই যে, ওখানে সাইকেল নিয়ে বসে রইলেন, সেটা রেখে ভিতরে গেলেন, এসে চা খেলেন, কত যত্ন করলেন, কি আবেগে নিজের টি-শার্ট দিয়ে মুছলেন!
অথচ পাশেই আমার মত একটা সুন্দর মেয়ে বসে আছে, একবারও তাকিয়ে দেখলেন না! ইচ্ছে হলনা! কেন? বলুন তো! তাই তো জেচে আলাপ করতে এলাম, আপনি ঠিক আমার প্রেমে পড়ার মতন!
আচ্ছা?
জি….
তুমি একা?
একা বলতে যদি প্রেমিক থাকা বোঝাতে চান তবে একাই। আর যদি বন্ধু, ছেলে বন্ধু বোঝাতে চান তবে একা নই!
হুম বেশ কঠিন কথা হয়ে গেল। তবে তুমি যাই বল, এমন প্রকৃতি, এই চমৎকার পরিবেশ, এতো সবুজ, বনভূমি, জলাশয়, ঝিল, পুকুর, ঝোপ জঙ্গল, শাপলা শালু ভরা পুকুর, ছায়া ঘেরা পথ, নির্জন প্রকৃতি, ছেলে মেয়েদের নিজেদের মত করে নিজেকে গড়ে তোলা, এমন যায়গায় একা থাকাটা কেন যেন খুব বেমানান লাগে আমার কাছে। আমি ভাই এমন যায়গায় একা থাকার কথা ভাবতেই পারতামনা।
নাহ, একা কেন, কত বন্ধু, বান্ধবী তো আছেই।
হঠাৎ খুব জরুরী ফোন এসে যাওয়ায় ওদের উঠতে হল। হুট করেই ছন্দ পতন ঘটলো ওদের পথ চলার, কথা বলার। চলার পথ ভিন্ন হতে চাইলো।
আচ্ছা, আমাদের কি আবার দেখা হতে পারে?
জানেন খুব ভালো লেগেছে আজ সকালে এমন একটা সময় কাটাতে পারে।
হ্যাঁ সে তো নিশ্চিত। একটা চমৎকার সকাল কাটলো এই অপরিচিত তোমার সাথে। আর দেখা? সে তো হতেই পারে।
এদিকে কি সবসময়ই আসেন?
মাঝে মাঝে, সাইকেল চালাতে।
ঠিক আছে আবার আসবেন, শীতে আমাদের ক্যাম্পাস আরও চমৎকার, ভীষণ সুন্দর, হাজার হাজার অতিথি পাখিদের সাথে, আমার বাড়তি আনন্দ হয়ে না হয় আপনিও এলেন প্রার্থীত অতিথি হয়ে!
ঠিক আছে, শীত আসুক…
চলুন আপনাকে এগিয়ে দেই গেট অবধি।
চল… সাইকেল চালাবে?
দেবেন চালাতে?
নাও….
মেয়েটি সাইকেল চালাতে শুরু করলো আর ছেলেটা একটা অটোতে উঠে পরলো…