ঘুরতে ভালো লাগে বলেই নানা ডিলের জন্যে ওয়েট করে থাকি। বিভিন্ন ক্লাবের মেম্বার হয়ে লাভ এই যে ডিল ধরতে ঢিল ছুড়তে লাগে না। ইমেইলে সব অটো এসে যায়। ডাউন-অন্ডার, অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হয়ে আরো ডাউনে নিউ জিল্যান্ডকে দেখবার ইচ্ছে ৮ বছর জিইয়ে রেখে এবার মিটালাম। নর্থ আইল্যান্ডের অকল্যান্ডকে বলা হয় সুদীর্ঘ শুভ্র মেঘ-ভূমি -‘Land of the Long White Cloud‘। ৮৪ ঘন্টায় অকল্যান্ডকে কতটা জানা যায়! শুভ্রতার মাঝে সবুজ যে এত মায়াবী তা কে জানতো?
রাতের বেলা প্লেনে চড়ার সুবিধা হয়তো ঘুমিয়ে নেয়া এবং দিনের বেলায় প্লেনের সময়টুকু বাচানো। কিন্তু যাচ্ছিলাম বাজেট এয়ারলাইনে ; নামেই ষ্টার-সার্ভিসে নন-ষ্টার। ৩০ মিনিট বিলম্বিত ফ্লাইট যখন অকল্যান্ডকে দেখবার সুযোগ করে দিল তখন মেলবোর্নে রাত ৪ টা আর সেখানে ৬ টা। ১১ টা ৫৫ থেকে ঘাড় সোজা করে সাড়ে ৩ ঘন্টার ফ্লাইটে ঘুম কেমন হতে পারে বলে ভাবছো?
অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন কত সহজ হয় তা এই প্রথমই টের পেলাম ৫ মিনিট বাদেই। বের হয়ে একটা প্রিপেইড সিম নিলাম। ইন্টারনেট ছাড়া কি করে কোথায় কি খুজবো বলোতো? তার থেকেও বড় কথা – ফেইসবুক ছাড়া; কস কি মমিন- কেমনে কি? ফোন করতেই স্বাগত জানাতে এসে গেলো বহু দিনের শখের মাজদা ইয়াঙ্গি কনভার্টীবল!
জিপিএস ব্যবহার করে কুড়ি মিনিটে শহরের দিকে যাবার পথে থেকেই দেখতে লাগলাম স্কাই টাওয়ার। সকালেই আবিষ্কার করলাম আমরা মেলবোর্নে যে ব্র্যান্ডগুলো দেখি তার অনেকগুলোই এখানে ভিন্ন নাম পরিচিত। আগেই খোজ নিয়েই এসেছি -কোথায় কোথায় যাব। যখন জানলাম আজ ৬ ফেব্রুয়ারী নিউ জিল্যান্ডের Waitangi day বা ‘নিউ জিল্যান্ড ডে’ – যার মানে আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে পাবলিক হলিডে-একটু ঘাবড়ে গেলাম, যা দেখতে চাইব তা কি আজ খোলা থাকবে আদৌ?

একটা ফাষ্ট ফুডশপে বসে পাই ফেস সমেত নাস্তা করে ছুটলাম হ্যামিলটনের (Hamilton) দিকে। কুড়ি বছর আগের সবগুলো গাছ বড় হয়ে দুই কিলো জুড়ে যে বিশাল সবুজ তাতে নানান রকম ভাস্কর্য বসিয়ে তৈরী হয়েছে Sculpture Park।বৈশ্বিক মন্দার কারণে পার্কটি এখন কেবল বাই-এপয়নমেন্ট জন প্রতি গাইডেড ১৫ ডলার হাদিয়া তসরুফ খোলা থাকে। এত দূর এসে এই? তাও হয়! বন্ধ থাকার পরেও বাঙালি অর্থেই সুযোগ নিলাম। দেখা হলো John Wakeling এর সাথে, যার হাতেই Sculpture Park গড়া এবং সুদুর ফ্রান্স থেকে এসে এই কাজে স্থিতু একজন Willing Workers on Organic Farms (WWOOF) এর সাথেও।
পরের গন্তব্য পিটার জ্যাকসনের The Hobbit মুভি সেট, সুলভে এন্ট্রি ফি জন প্রতি ৭৫ ডলার। এই ধরনের কাল্পনিক গপ্পো-কাহিনী আমি এবং সুবর্ণা দেখে থাকি না, তাই লোভ কম করলাম। দুপুর বাদে যখন রটুরোয়া পৌছে গেলাম তখন অনলাইন থেকে নেয়া আমাদের দুদিনের ঘর, স্টুডিও মোটেলের রুমটি পছন্দই হলো। টিভি, ওভেন, ফ্রিজ সবই আছে। কিন্তু এ যাত্রায় ঘরে খাবনা, পণ করেছিলাম। আর খাওয়ার কথায় যখন বললাম- সেরা খাবার খাব আমি। সেটা কোথায়, খোজ নিয়েই তো গিয়েছিলাম।
“Best Halal Food in Rotorua” রিভিউ দেখে একটা দোকান বেছে নিলাম । সেখানের রাইস আসলেই অনবদ্য, দামেও বেশ ভালো। ছোটবেলায় ডেইরি মিল্ক প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন দেখেই তো ভূ-বাঙ্গালির নিউ জিল্যান্ড কে চেনা। তাই যখন সেই দোকান থেকে টিপ টপ ভানিলা আইস ক্রিমের কাপসহ সুবর্ণাকে আবারো দেখলাম বুজা গেল ‘Happiness is ice cream when u get what u want’!
আরো পড়ুন অকল্যান্ডে অবকাশ

মোটেল থেকেই জেনেছি মানুষ আসেই রটুরোয়া thermal water eruption, স্পা আর মারুই গ্রাম-এই তিন কারণে। কিন্তু না, নিজেরা যে আমরা যথেষ্ট কাল্ন্ত তা টের পেলাম যখন বিছানায় গা এলাতেই নিরব ঘুম চোখ জুড়ে এলো।
সন্ধা-রাত্রিতে বের হয়ে খাবার সন্ধানে আমরা দুইজন পেয়ে গেলাম কোরিয়ান নুডলস হাউস। বলতে দ্বিধা নাই ডিমের অমলেট দিয়ে এইভাবে এত্তোগুলা ফ্রাইড রাইস আড়াল করার টেকনিক কোরিয়ানরা ভালোই জানে। অন্যদিকে সুবর্ণার Wasabi এর হটাত ঝালের সাথে বিইইরাট flounders খাওয়া দেখে বুজলাম, বস্তুটি মন্দ নয়।
রটুরোয়া পুরো দস্তর টুরিস্ট সিটি। সব দোকানেই কোথায় কত ডলার খরচ করে কি কি করে নিজেকে উজার করা টুরিস্ট বানানো যাবে তার লিফলেট জায়গা করেই রাখা আছে। লিফলেটগুলো ঘেটে পরের দিনের জন্য itinerary তৈরী করতে করতেই সুবর্ণার পরিচিত জনির ফোন এলো আবার। সকাল থেকেই ও ফোনে প্ল্যান দিয়েই যাচ্ছে| আমরা নেক্সট শহর তাপু (Tapu) গেলে ওরাও ভুবন ভুলানো লেক দেখতে শনিবার অনিন্দ্য-সুন্দর শহর নেপিয়ার থেকে আমার স্কুল বন্ধু তুষারের ফ্যামিলি সহ আড়াই ঘন্টা ড্রাইভ দিবে।
শনিবার সকালে নাস্তা খেয়েই বের হলাম। বিশ্বের বিখ্যাত Pohutu উষ্ণপ্রস্রবণ (geyser), মারুই গ্রাম, কিউই পাখি এবং কাঠ খোদাই দেখতে আমরা এইবার জন প্রতি ষাট ডলার মুল্য না ফেরত দিবার শর্তে Whakarewarewa ভ্যালির ৭০ হেক্টর জুড়ে অবস্থিত Te Puia Experience এ পৌঁছলাম সকাল দশটায়। মারুই নাচ-গান, geothermal geyser এর যে অভিজ্ঞতা সেই মুগ্ধতা আমাদের এই এক জায়গাতেই ধরে রাখলো অনায়াসে আরো দুই ঘন্টা।
সকল সফল মুভির মতই আমাদের দুইজনের নান্দনিক সুখের সময়ে ভিলেন হয়ে এবার পর্দায় দেখা দিল-জিপিএসটা। চার্জ নিচ্ছে না। শুভর মুখখানি টেনসনে মলিনতম হতে থাকলো। গাড়ির মালিককে ফোনে কথা বলা অবস্থায় এক অচেনা জায়গায় মোবাইলের ব্যালান্স ফুরোলো। ওকে মাটির কাছ ঘেসে থাকা মাজদায় বসিয়ে বের হলাম নিরুদ্দেস- যদি কিছু হয়। ইলেকট্রনিক্স দোকানে যাওয়ার আগেই বুদ্ধি এলো অন্য কারো গাড়িতে জিপিএসটা ট্রাই করে দেখা যাক। হু কাজ করছে, তার মানে প্রবলেম লাল-মিয়া মাজদার সিগারেট লায়টারে। ক্ষুধায় বুদ্ধি কম হয় জানি বলে আবারো খাবারের দোকানে গিয়ে বসলাম।

আরো পড়ুন কুইন্সটাউনে ভ্রমন

না হলো না এভাবে, সুবর্ণাকে ভিজিটর ইনফরমেশন সেন্টারে বসিয়ে তাই এবার জিপিএস আর গাড়ি নিয়ে অটোমোটিভ স্টোর খুঁজতে বের হলাম। ট্রাফিক লাইটে বার কয়েক রীতিমত আকুল আবেদন করে জানালার ও ধারে ড্রাইভার থেকে জেনে জেনে একটা অটোমোটিভ স্টোরে পৌছালাম। কনভার্টিবল গাড়ির ফিউজ ঠিক করা ওদের কম্মো নয়। সো ইলেকট্রিক্যাল অটো রিপেয়ার খুজতে বের হলাম ডেভিড ম্যাকায় কে দেখেই মনে হল এই-ই পারবে। হলোও তাই। টানাটানিতে গাড়ির সিগারেট লাইটারের আর্থিং লাইন খুলে এসেই যা বিপত্তি। যাই হোক, আগের রাতে ওকে বলেছিলাম হঠাৎ নিশীথ রাতের অ্যাডভেঞ্চার আমার ভালই লাগে। এই ধরো, গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল টাইপ। আল্লাহ ভালোলাগাকে দ্রুত নিশ্চিত করে ঘাম ছুটিয়ে দিলেন। বেলা সাড়ে তিনটায় ফের রটুরুয়া ভিজিটর ইনফরমেশন সেন্টারে পৌঁছে বুঝলাম আমাদের আমাদের তাপু যাওয়া পরেরবার এর জন্যই ভবিতব্য! কি দারুণ কো-ইন্সিডেন্স। আমাদের হতাশ সময়ে- সম্মুখে দাঁড়িয়ে রটুরুয়া ডাক্টুরের গাড়ি। কোন দ্বিতীয় ভাবনা ছাড়াই জনপ্রতি ৭৫ ডলার গুনে চড়ে বসলাম। এ এক অদ্ভুৎ যান। একই গাড়ি যা জলে আর স্থলে অবিরাম চলে। ড্ৰাইভার কন্ডাক্টর যে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এই এলাকায় গরণ তা জানালো। ঘুরে দেখলাম redwood, নীল লেক এবং পুরোটা শহর। আজ রাত্রিতে ডিনার করা হলো কড়া ঝাল থাই স্যুপ আর পর্তুগিজ খাবার দিয়ে।
প্রচন্ড বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তৃতীয় দিনে আমরা বের হলাম বানজি জাম্প আর জেট বোটিং করতে। আড়াই ঘন্টার সবুজ ছাপা প্রকৃতিকে পাশ করে আমরা যখন অকল্যান্ড পৌঁছি তখন হোটেলে দুপুরের হাউসকিপিং কেবল শেষ হয়েছে। পরিচ্ছন্ন ঘর নয়, হালাল বস্তুর ক্ষুধায় তো এই সময় বেশি বাস্তব ছিল। ইভেন্ট সিনেমার গ্রাউন্ড ফ্লোরে ইন্ডিয়ান চাট খেতে গিয়ে দেখা পেলাম আমাদের বাঙ্গাল সূহৃদ -হরিচরণ দাদার। কবে কোন সিঙ্গাপুর মুল্লুকে তার জাত ভাই বাংলাদেশিরা ২১ দিন বসিয়ে খাইয়েছিল দাদা তার সেই ঋণ শুধালেন আমাদের তার নিজের দুপুরের খাবার -আলু পালং শাক আর সাদা ভাতে – ‘পয়সা নিব না ভাই, ওতে জাত ভাইয়ের সাথে পাপ হবে যে’। কি বিপদ; আমরা অলরেডি জাপানিস প্রন কাত্সু এবং মিশিয়াকো অর্ডার দিয়ে ফেলেছি। দাদার সাথে কিছু ফটুক তুলে আদাব জানিয়ে রাতের জন্য জাপানিজকে টেকওয়ে করে নিয়ে বিদায় নিলাম। স্কাই টাওয়ারে যাওয়ার কিছু নেই বলে তার নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে মানা নাই। তাই হলো বে অফ প্লেনটির ফেরি এলাকা, ইউনিভার্সিটি অকল্যান্ড, ওটাগো ইউনিভার্সিটি আর কুইন স্ট্রিটে একটা লম্বা হাঁটা-পথে স্যুভেনির শপ থেকে কিছু স্মৃতি কিনে নিলাম। ও ফল খাবে, টিপটপ আইসক্রিম তো খাবেই। কাউন্টারের রেজিস্টারে তাই দেখা হল বাংলাদেশী সোমার সাথে।
“আপনারা কি বেড়াতে এসেছেন?”
“জি”.

মোবাইলে কাকাবাবু সিরিজের মিশর রহস্য মুভি দেখিয়ে রাত পার। জানা ছিল না সাসপেন্স সামনেই! সকালে উঠে যখন দেখলাম এত সকালে কেউ পেট্রোল স্টেশন খুলে নাই তখন থেকেই শুরু। গাড়ি রিটার্ন তো করতেই হবে, কোথায়? এরপর যখন কথামতো গাড়ি ড্রপ করতে গিয়ে জানলাম হোটেল থেকে শাটল বাস ৫৫ সেকেন্ডের জায়গায় ১৫ মিনিট নিবে ততক্ষণে অনেক দেরী। সাড়ে ছয়টা বাজে প্রায়, সাড়ে সাতটায় ফ্লাইট। কোন্দলের ফোনটা রেন্টারের সাথে মিনিট সময়ে গুছিয়ে গাড়িটা আনলকড কিসহ এয়ারপোর্ট হোটেলে পার্ক করেই .. দে দৌড়। রিটার্ন ফ্লাইট মিলল কিন্তু হাঙ্গামার পর!!!
মেলবোর্ন ফিরে আমাদের এইবারের ট্রিপ শেষ হলো। হ্যাঁ তা আর বলতে? অর্ডারি টমেটো-আলুর সাথে ক্যাটফিশ তরকারি তো ছিলই আরো ছিল বিশাল চিংড়ির দোপেয়াজা, ইলিশ পোলাও। বাজার সরকার আমাদের দুলাভাই, রাঁধুনি ছোট্টা। আর আব্বা এই প্রথম আপনি নিজেই আমাকে কিছু লিখতে বললেন। তাই চেষ্টা করেছি আপনাকে সাথে না পেয়েও সবটা সময় সাথেই রেখে লিখতে। আপনার জন্যই এটুকু যা লেখা। আবার যখন যাব কোথাও, কথা দিচ্ছি সঙ্গে সবাই থাকবে। এর জন্য মনটার তো কোন পারমিশন লাগে না।
‘মন বলেই আমরা মানুষ’, সত্ত্বা বিচ্যুত যাযাবর খুঁজে ফিরবে রোজ, তার নিজ সবুজ।
পড়ুন মোহম্মদ হাসানের আরো লেখা
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।
আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।