Sikkim

করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে যখন তর্ক-বির্তক চলছে বিশ্ব জুড়ে ঠিক সেই সময়েই ভারতের দ্বার খুলে গেল পর্যটকদের জন্য। এই খবর দেখা মাত্রই আলমারিতে পড়ে থাকা দুই বছরের অলস পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ছুটলাম ভারতের ভিসা সেন্টারে। ভিসা সেন্টারের লম্বা লাইনের হ্যাপা পেরিয়ে দিয়ে আসা হল পাসপোর্ট। এক সপ্তাহের অপেক্ষার পালা শেষ করে অবশেষে ভারতে ভিসা মিলল তাও ছয় মাসের জন্য। ভিসা তো তাও মিলল এখন অপেক্ষা ছুটির! শেষমেশ এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আমরা ঢাকার কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে রওনা হলাম বাংলাবান্ধা হয়ে সরাসরি শিলিগুড়ি।

সন্ধ্যা সাতটার বাস মোটামুটি ১৬/১৭ ঘণ্টার জার্নি। আমি ও আমার বর আমাদের দুইজনের এই প্রথম সলো ট্রিপ। এর আগে যতবারেই দেশের বাইরে ট্যুরে গিয়েছি সব সময়েই বন্ধুদের একটি দল সারথি ছিল। সেইদিক থেকে এবারই একা একা এবং স্থল পথে প্রথমবারের মতো যাত্রা। কিছুটা শঙ্কা যে কাজ করেনি তা বললে মিথ্যা হবে। ভোর সাতটার নাগাদ আমরা বুড়িমারি পৌঁছে যাই। এরপর দুই পারের ইমিগ্রেশন শেষ হতে হতে প্রায় দেড়টার মতো বেজে যায়। সব কিছু শেষে আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছাই বিকেল ৫টা নাগাদ। এর পরেই আমাদের মূল ভ্রমণের যাত্রাপথ শুরু।

এ পর্যায়ে আমরা যেহেতু দুই জন তাই একদল বাংলাদেশি ভাইদের সাথে আলাপ হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত আমরা তাদের পাঁচজনের দলে যুক্ত হয়ে একটি জিপ শেয়ার করি গ্যাংটক পর্যন্ত। শিলিগুড়ি থেকে সিকিম প্রবেশের অনুমতি পত্র জোগাড় করে আমরা রওনা হয়ে যাই। বলে রাখছি, সিকিম যাওয়ার জন্য ভারতীয় ভিসার সাথে সিকিম প্রশাসনের অনুমতিপত্র লাগবে, যাকে ‘ইনার লাইনার পারমিট’ (আইএলপি) বলে। এ প্রসঙ্গে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে, তাই আর কথা না বাড়িয়ে আমি মূল বিষয়ে চলে যাচ্ছি। শিলিগুড়ি থেকে জীপ যতো ভেতরের দিকে প্রবেশ করতে থাকে ততোই তীব্র হতে থাকে প্রকৃতির সোঁদা গন্ধ।

সময়টা বর্ষাকাল। জুলাই মাস সিকিম বেড়ানোর জন্য অনেকের মতো উপযুক্ত সময় না হলেও আমরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই চলে গিয়েছিলাম। বর্ষায় পাহাড়ের এক অন্য রূপ আছে। গাছপালার সবুজ অরণ্যের যৌবনের মাদকতা বিছিয়ে রাখে চারিদিক। স্বচ্ছ আকাশের দেখা মিলছে  না ঠিকই, কিন্তু মেঘের ভেলায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছিলাম অন্য কোনো ভুবনে। যে জগত আমাদের চেনা জানা নয়।

গ্যাংটক সিকিমের রাজধানী। পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠা ছোট্ট একটা শহর। রাত নামতেই যতদূর চোখ যায় যেনো, মিটি মিটি তারা জ্বলতে থাকে। এই তারাসদৃশ এগুলো শহরের বাড়িগুলোর কৃত্রিম আলোকবাতি। এই শহর রাত নামতেই আপন জগতে ঢুকে পড়ে। রাত আটটার পর রাস্তায় লোক চলাচল কমে আসে। গ্যাংটকের প্রথম রাত্রিতে আমরা আমাদের হোটেল রুমেই কাটিয়ে দেই – সারাদিনের ক্লান্তির পর ভাবছিলাম পরের দিন ভোরে উঠতে পারব কি না? ট্যাক্সি আসার কথা সকাল ৭টায়। শঙ্কা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। সত্যি অবাক করার বিষয় আগের দিনের লম্বা জার্নি স্বত্ত্বেও আমরা কোনো ধরনের আলসেমি বা এ্যালার্ম ছাড়াই ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে গেলাম। হোটেল রুমের বড় জানালার পর্দা সরাতে উম্মুক্ত হয়ে গেল বিশাল মেঘের রাজ্য। মেঘ কাটিয়ে উঁকি দিচ্ছিল গ্যাংটকের পুরো শহর। পাহাড়ের গাঁয়ে ছোট্ট ছোট্ট নানা রঙের বাড়িগুলো দেখে কিছুক্ষণ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। 

নাস্তা শেষে আমরা রবিন দাদার ট্যাক্সিতে বেড়িয়ে পড়লাম গ্যাংটক শহর দেখতে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালাদোর ফ্যান রবিন দাদা বেশ হাসিখুশি স্টাইলিস্ট একজন মানুষ। ঘুরতে গিয়ে একজন ভালো ট্যাক্সি ড্রাইভার পাওয়া কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি আমাদের দুই দিনে গ্যাংটকের প্রায় সকল পর্যটক স্থান ঘুরিয়ে আনলেন। সেই সাথে থেমে থেমে সারাদিনেই চলল বৃষ্টি।  আমরা অনেকগুলো মনেস্ট্রি ঘুরে দেখলেও আমার সব চেয়ে ভালো লেগেছিল রুমঠেক মঠ, যা ধর্মচক্রকেন্দ্র নামেও পরিচিত)। অতি উজ্বল বাহারি রঙ এবং এর অবকাঠাবো সৌন্দর্য তুলানাহীন এক কথায়। গ্যাংটক থেকে চব্বিশ কিমি দূরে। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মনাস্ট্রি হল এই রুমটেক মনেস্ট্রি। আর প্রথমটি অরুণাচল প্রদেশে অবস্থিত। রুমটেক মনেস্ট্রি ওঠার পথটি অসাধারণ। তবে বেশ চূড়ায় এর অবস্থান। প্রকৃতিকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করতে করতে ওপরে ওঠা। পথে দেখা মিলবে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। বিভিন্ন বয়সের ভিক্ষু। অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে মুখ জুড়ে। রুমটেক মনেস্ট্রি ঘুরে দেখতে হাতে অনেকখানি সময় থাকা প্রয়োজন। সেখান থেকে বেড়িয়ে গেটের কাছেই স্থানীয় খাবার দোকানেই আমরা মধ্যাহ্নভোজের বিরতি নিলাম। খুবই সাধারণ খাবারের দোকান হলে কি হবে চমৎকার রান্নার স্বাদে ডুবে গিয়েছিলাম। সিকিমের প্রায় প্রতিটা খাবার দোকানেই কিছু কমন মেন্যু থাকে। ফ্রাইড রাইস, পোর্ক এর যেকোন আইটেম এবং মোমো। এছাড়াও চাইলে ভাত, সবজি, মাছের ঝোল সহ গরুর মাংসও মিলে যায়।

সেই দিনের মতো ঘোরাঘুরি শেষে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। পরের দিন আবার সেই ৭টার কল। আজকের যাত্রা সাঙ্গু লেক। অনেকটা দূরের পথ। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নাথুলা পাস বন্ধ। সুতরাং কপাল ভালো হলে হয়তো ক্যাবল কারে চড়ে সাঙ্গু লেক দেখার স্বাদ মিটবে। কিন্তু ভাগ্য সেদিন সহায় ছিল না। সেই দিন সকাল থেকেই ভারী মেঘ আর বৃষ্টিতে এক হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ভ্যানিশিং ক্রিম না মেখেও আমরা কি রকম যেন ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছিলাম সেখানে দাঁড়িয়ে। শুধু মুখটা দেখা গেলে শরীরের বাকি অংশ মেঘে ঢাকা। এটাও এক মজার অভিজ্ঞতা। সাংগু লেকের  (১২,৩১৩ ফুট) উচ্চতায় উঠে আমার হঠাৎ মোমো খেতে ইচ্ছে হল। ওপরেই একটি রেস্তোরাঁ আছে সেইখানে আমরা মোমো আর ম্যাগি নুডলস খেয়ে নিচে নামতে নামতেই হঠাৎ মেঘ কেটে পুরো লেকটি স্পষ্ট হয়ে গেল চোখের সামনেই। ইয়াকে চড়ে কিছু পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দেখতে দারুণ মজার ছিল সে দৃশ্য। ঠিক যেমনটা আমরা ৯০ শতকের বলিউড সিনেমায় দেখতাম নায়ক-নায়িকা গান গাইছে।

sikkim Changgu

সিকিমে ঘুরতে ঘুরতে আরও একটি জিনিস আমাদের দারুণ আকৃষ্ট করল। তা হল রডোডেনড্রন দিয়ে বানানো এক ধরনের বিশেষ পানীয়। বিশেষ এই পানীয় দেখতে খুবই আকর্ষনীয় হওয়ায় আমরা হোটেলে ফিরেই গুগল সার্চ করলাম এই পানীয় সম্পর্কে জানতে। এরপর আমরা জানতে পারলাম মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে সিকিমের অতিরিক্ত আকর্ষণ হয়ে উঠে রডোডেনড্রনের রক্তিম প্লাবন। গাছে ফুটে থাকা থোকা থোকা লাল, গোলাপি রঙের অসংখ্য রডোডেনড্রন ফুল সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলে বহু মাত্রায়। সেই সময় সেখানকার স্থানীরা এই ফুলের নির্যাস থেকেই তৈরি করেন অতি সুস্বাদু এই রডোডেনড্রন পানীয়। ইচ্ছে হলে যেকোন স্থানীয় দোকান থেকে সংগ্রহ করা যায়। পরের দিন আমরা রবিন দাদা এই পানীয় কেনার ইচ্ছার কথা জানালে তিনি আমাদের ৩০০ রুপি দিয়ে স্থানীয় এক দোকান থেকে কিনে দেন। শেষ পর্যন্ত যদিও আমাদের এর স্বাদ নেওয়া হয়নি তাই খেতে কেমন লেগেছে তা আর এবার বলতে পারছি না। তবে সিকিমের আবার যাওয়া হলে সেবার আর ভুল হবে না নিশ্চয়ই।

আবহাওয়ার কারনে উত্তর সিকিমের দ্বার তখন বন্ধ ছিল। যদিও পর্যটকদের কাছে উত্তর সিকিমের সৌন্দর্যের আবেদন সবচেয়ে বেশি। তারপরেও মনের ভেতর তেমন কোন আফসোস তৈরি হল না এই অদেখা প্রকৃতির জন্য। পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণের পাহাড়ের নানান খাদের অপরূপ প্রকৃতি দেখে দেখে ততদিনে আমরা বিমোহিত। আরও একটি জিনিস সিকিমের পথে প্রান্তরে পাহাড়ের পাশাপাশি মন কেড়ে নিবে এক একটি ঝর্ণা। বর্ষায় সেই ঝর্ণার রূপের বেগ যেন আরোও বেড়ে গেছে। যেখানেই যাই না কেন অসংখ্য ঝর্ণা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোন দুরন্ত মেয়ের ছুটে চলা। ঝর্ণার কলতান শুনতে শুনতে মেঘের ভেতর ছুটে চলা গাড়ির ভেতর বসে মন গুন গুন করে গেয়ে উঠে তখন “হারিয়ে গিয়েছি এই তো জরুরি খবর………………”।

পড়ুন সাবরিনা মুন্নির আরো লেখা

 

ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।

অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।

 

ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।

আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।