সবার আগে বলে নেই, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ বা টেকনাফ থেকে কক্সবাজার প্রায় ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকতকে আল্লাহ সবরকম ভাবে দেখার বিরল সৌভাগ্য আমাকে দিয়েছেন। বিমানে চড়ে আকাশে উড়ে উড়ে, জাহাজে করে সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে দুলে, দুই পায়ে বীচ ধরে হেটে, তাড়িয়ে তাড়িয়ে আর একদম শেষে এবার নিজের প্রিয় সাইকেলে চেপে মনের সুখে আশ মিটিয়ে।

মেরিন ড্রাইভে সাইকেল চালিয়ে পুরো সমুদ্র সৈকত আর সৈকত ঘেরা সবুজের আচ্ছাদন উপভোগ করার ইচ্ছে প্রথম জেগেছিলো সেবার, যেবার দুই পায়ে পুরো সমুদ্র সৈকতের দীর্ঘ ১০০ কিলোমিটার হেটে হেটে উপভোগ করেছিলাম। কারন সেবার সমুদ্রের বালুকাবেলার নরম কোমল বালুতে হেটে, মুহুর্তে অবাধ্য ঢেউয়ের ছুঁয়ে যাওয়া প্রান ভরে উপভোগ করলেও মনে মনে আফসোস ছিল অদুরের সবুজের কাছাকাছি যাওয়া হয়নি, পাহাড়ের পা ছুয়ে ছুয়ে হেটে বেড়ানো হয়নি বলে।
 
তাই সেবারই ঠিক করে রেখেছিলাম, আবার সুযোগ পেলেই সাইকেলে চড়ে, আয়েশ করে মেরিন ড্রাইভের পুরোটা পথ যাওয়া আসা করবো। দেখবো সবুজের পাহাড়ের পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের অপূর্ব রূপ। একপাশে সমুদ্র আর এক পাশে দীর্ঘ সবুজের বুক চিড়ে চলে যাওয়া মিহি পথের মাধুর্য। শুধু মনে মনেই ভেবে রেখেছিলাম এই স্বপ্নটা। কখনো চেষ্টা করা হয়নি, তেমন কোন পরিকল্পনা করা হয়নি, কখনো কোন দিনক্ষনও ঠিক করা হয়নি।
 
শুধু অপেক্ষায় ছিলাম কবে আসবে এমন সুযোগ, কবে পারবো ছোট্ট কিছু বেশ দুর্লভ এই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় পুরে নিতে। কিন্তু যেদিন থেকে আমার প্রিয় সাইকেলটা হাতে পেয়েছি সেদিন থেকে মনের মধ্যে একটা উথাল পাথাল অবস্থা শুরু হয়ে যায়, প্রিয় সাইকেল নিয়ে প্রিয় মেরিন ড্রাইভে চালানোর জন্য।
কিন্তু এমন সময় শীতের আগে পাওয়া যাবেনা বলে চুপচাপ ছিলাম। সদ্য ঈদ গেল, লম্বা ছুটি কাটিয়েছি ভারতে, বাসায়ও এইসব বিষয় নিয়ে এখন কথা বলা যাবেনা মোটেই। আর অর্থনৈতিক অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। তাই আসছে শীতের অপেক্ষায় ছিলাম অফিসের ছুটির, বাসায় বলার আর হাতেও দুই চারটা টাকা পয়সা জমার। কিন্তু আমার ভাগ্য বিধাতা যে নির্ধারণ করে রেখেছেন আমাকে তিনি দুহাত ভরে দেবেন, আমার কোন স্বপ্নই তিনি অপূর্ণ রাখবেননা! আমাকে তিনি অবিরত তার কাছে শুকরিয়া আদায়ে বাধ্য করবেন। তাই তো মেঘ না চাইতেই জলের মত হুট করেই পারিবারিক ভাবে কক্সবাজার যাওয়ার একটা প্রস্তাবনা এলো।
 
অনেক টাকা পয়সা খরচ হবে বলে আমি নিমরাজী, কিন্তু আমাকে যদি একটা দিন ছেড়ে দেয় শুধু আমার জন্য, আমাকে যদি সাইকেল নিতে দেয়, আমাকে যদি মেরিন ড্রাইভে সাইকেল চালানোর সময় কোন রকম বিরক্ত করা না হয় তবে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি কক্সবাজার যাওয়ার, অন্যদের প্রস্তাবের সাথে আমার সংযুক্তি ছিল এই।
 
তো আমার প্রস্তাবে বাসার সবাই-ই রাজী হয়ে গেল! ঠিক সেই সময় থেকে খুশিতে আমার ডগমগ অবস্থা! উফ কি একটা অদ্ভুত আনন্দের সময় পেতে যাচ্ছি কিছুদিন পরে এই ভেবে যে, কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে প্রিয় সাইকেল নিয়ে মনের সুখে চালিয়ে টেকনাফ যাওয়ার স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে বলে!
 
কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখলেই কি আর সেটা পূর্ণ হয়ে যায়? নানা রকম বাঁধা, সমস্যা, অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তার শেষে স্বপ্ন সত্যি হয়, হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়। এজন্যই মেরিন ড্রাইভ সাইক্লিংকে আমি ছোট্ট কিন্তু দুর্লভ স্বপ্ন বলেছি।
 
কারন ছোট এই স্বপ্নটা পূরণ করতেও আমাকে নানা রকম প্রতিকুলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যার মধ্যে প্রথম প্রতিকুলতা ছিল প্রিয় সাইকেলকে কোন রকম ক্ষতির সম্মুখীন না করে যেভাবে আছে সেভাবে কক্সবাজারের নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেটা কিভাবে নেয়া যাবে সেই নিয়ে কয়েকদিন কেটেছে নানা রকম ভাবনায় আর পরিকল্পনায়।
 
টিকেট করার সময় নিজে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে বাসের মধ্যে দাড় করিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা সেটা বুঝতে। কিন্তু না সেটা সম্ভব নয়, কারন স্লিপার ক্লাসের বাসের মাঝে সাইকেল রাখার মত যায়গা থাকেনা। যেটা থাকে গ্রিন লাইনের ডাবল ডেকারের নিচের ডেকে। তাই বাসে সরাসরি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিতে হল।
 
দ্বিতীয় অপশন হল সাইকেল খুলে বাসে করে নিয়ে গিয়ে, কক্সবাজারে গিয়ে আবার সেট করে নেয়া। কিন্তু এই ঝুঁকি আমি নিতে চাইনি যেহেতু আগে কখনো সাইকেল খুলে নিজে সেট করিনি। তাই কোন বিড়ম্বনায় পড়ে শেষে না আমার মেরিন ড্রাইভ সাইক্লিং-ই বাতিল করতে হয় সেই ভয়ে আর শঙ্কায়।
 
এরপর একবার ভাবলাম, ট্রেনে করে চিটাগাং পাঠিয়ে দেই, সেখান থেকে পিক আপে নিয়ে যাবো কক্সবাজারে। কিন্তু খোঁজ খবর নিয়ে দেখা গেল, তাতে খাজনার চেয়ে বাজনায় বেশী খরচ হয়ে যাবে। আর সাথে বাড়তি থাকবে নানা রকম বিড়ম্বনা এবং যাত্রার আগে পরে এক থেকে দুইদিন বাড়তি শ্রম দেয়ার মত ঝামেলা! তাই এটাও বাতিল।
 
শেষ অপশন সাইকেল কুরিয়ার করা। কিন্তু কাছাকাছি আর মোটামুটি নাম আছে এমন দুই একটা যায়গায় গিয়ে কথা বলে দেখলাম অনেক খরচ চায়, সেটা না হয় মেনে নিতাম কিন্তু ভালোভাবে আর নিরাপদে সাইকেল নেয়ার জন্য যেমন মানসিকতা থাকা থাকা উচিৎ তেমন মানসিকতা দেখতে পেলামনা বলে সেটাও বাতিল করে দিলাম।
 
এসব নিয়ে বেশ মন খারাপের পরে হুট করেই মনে পড়লো পাঠাও কুরিয়ারের কথা। যেটা আমার বেশ পরিচিত আর ওদের সাথে আমার ভালো বিজনেস ডিল আছে বলে। আমার অফিসের সকল কিছু ওরাই কুরিয়ার করে দেশব্যাপী, আমার মাধ্যমেই।
 
ওদের সাথে যোগাযোগ করার পরে ওরা যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়ে আমার সাইকেল কক্সবাজারে পৌঁছে দেবে বলে আশ্বস্ত করলো। আমি কিছুটা নির্ভার হলেও প্যাকিং নিয়ে টেনশনে ছিলাম। তাই তো প্যাকিং নিয়ে ঝুঁকি দিতে চাইনি বলে ওদের হাতে প্যাকিঙয়ের কাজ না দিয়ে নিজেই সাইকেল প্যাকিং করলাম নিজের ইচ্ছা মত আর তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করলাম পুরো একবেলা সাইকেলের পিছনে ব্যয় করে। কক্সবাজার যাবার দিনের শেষে।
 
শুরুতে নানা রকম প্রিন্টারের সেভিং ব্যাগ বের করলাম কয়েকটা, প্যাডেল, হ্যান্ডেল এইগুলো কভার আপ করতে। এরপর নিজের নানা রকম কাপড় চোপড় দিয়ে সিট, হ্যান্ডেলবার, চেন কভার, গিয়ার বক্স, ক্যাসেট, আর অফিস থেকে পাওয়া বেশ বড় দুটো বাবল র্যা পের পলিথিনের মত মোটা কাগজ দিয়ে ফ্রেম কভার করে তার উপরে পুরো সাইকেল জুড়ে কার্টুন কেটে কেটে টেপ আর পিন দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করে কিছুটা স্বস্থি পেলাম। কুরিয়ারে সাইকেল বুঝিয়ে দিলাম সেভাবেই, যেন কক্সবাজার যেতে যেতে কিছু নিরাপত্তা বেষ্টনি এদিক সেদিক হলেই সব যেন খুলে না ফেলে।
 
যদি আমার এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে অফিস, বাসা, কুরিয়ার আর পথের লোকজন ভীষণ অবাক হয়েছে এবং মজা পেয়েছে, তবে তাতে আমার কিছুই যায় আসেনি আদৌ। আমার কাজ, আমাকে আর আমার ভাবনা নিয়ে অন্য কার কি ভাবনা, কে কি ভাবলো সেসব ভাবার সময় আমার নেই।
 
এসবকে আমি এই জীবনে কোনদিনই পাত্তা দেইনি, আজও দেইনা, কোনদিন দেবও না। কারন আমি জানি, আমার কাজ আমাকেই করতে হবে, আমার ভালো আমাকেই করতে হবে, আর আমার নিরাপত্তা আমাকেই নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ শুধু হায় হায় আর আহা উহু করেই কাটিয়ে দেবে।
 
কুরিয়ারে সাইকেল দিয়ে এসে সোজা বাসায়। তখন বাজে রাত আটটা। আরও কিছু কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ৮:৩০ বেজে গেল। কোন রকমে রেডি হয়ে ব্যাগপত্র, বাচ্চাকাচ্চা আর ঘর গুছিয়ে বের হতে হতে রাত ৯:৩০। রাত ১১ টার বাস।
 
ভেবেছিলাম সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছে যাব, তারপর ৯ টার মধ্যে সাইকেল নিয়ে মনের সুখে চালাতে শুরু করবো। কিন্তু ওই যে বলেছি কোন স্বপ্নই একটু আধটু অপেক্ষা, ঝামেলা, কষ্ট আর অনিশ্চয়তা ছাড়া পুর্নতা পায়না বলে এখানেও অপেক্ষা আর অনিশ্চয়তা আমাকে ঘিরে রেখেছিল।
 
রাত ১১ টার বাস ছাড়ল রাত ১২:৩০ এ! আর সকাল ৮ টার পরিবর্তে কক্সবাজার পৌছালো বেলা ১১ টায়! মন মেজাজ খারাপ করে বাস থেকে নেমে দেখি বাইরে ঠা ঠা রোদ, হাঁপিয়ে ওঠা গরম আর জ্বলুনি দিয়ে যাওয়া উত্তাপ। সবাইকে অটোতে করে রিসোর্টে পাঠিয়ে দিয়ে আমি গেলাম ৬ কিলোমিটার দূরে কুরিয়ার থেকে সাইকেল ওঠাতে। সাইকেল তুলে শহরের ভাঙা চোরা রাস্তায় চালাতে শুরু করতেই বুঝতে পারলাম আজকে টেকনাফ যাওয়াটা বোকামি হবে, উপভোগ্য তো হবেইনা বরং বিরক্তিকর আর অনেক কষ্টের হতে পারে।
 
তারচেয়ে বরং আজকে ইনানি পর্যন্ত যাই, ধীরে সুস্থে আর উপভোগ করে চালিয়ে, গিয়ে রিসোর্টে থাকে, ওদেরকে সময় দেই, কাল খুব ভোঁরে বেরিয়ে পরা যাবে সাধ মিটিয়ে মেরিন ড্রাইভ উপভোগ করতে আর প্রিয় সাইকেল নিয়ে এগিয়ে যেতে।
 
এই ভাবনা নিয়ে এগোতে শুরু করতেই বেশ মজা পেতে লাগলাম, যে যাক চাপ নেই মাথার উপরে কোন। হেলেদুলে চালাতে চালাতে ইনানি পৌঁছে বিশ্রাম, খাওয়া দাওয়া, সমুদ্রের তীরে বসে বসে বাতাস খাওয়া আর ছেলে মেয়েকে নিয়ে বিকেল, সন্ধ্যা আর রাত উপভোগ করা।
 
সাইক্লিং, হাইকিং বা ট্রেকিং এ খাবার দাবার নিয়ে আমার একটা নিজস্ব ভাবনা আছে। আর সেটা হল ভারী খাবার খেতে বসে সময় নষ্ট না করে, শরীর ভারী না করে পথে কলা আর ডাব পেলেই আমি এই দুটোতে ঝাঁপিয়ে পরি! পেট ভরে যতটা পারি খেয়ে নেই। কারন ডাবের পানি ঘামে আর প্রকৃতির ডাকে শেষ হয়ে যাবে আর কলা শরীরে প্রচুর এনার্জি দেবে। শরীর ভারী করে দিয়ে ক্লান্তি এনে দেবেনা যেটা খাওয়ার পরে হয়।
 
তাই সকাল থেকে কিছু না খাওয়ার শোধ তুলতে মেরিন ড্রাইভে দুই কিলো চালানোর পরেই দেশী সাগর কলার পুরো ছড়া ঝুলে থাকা দেখেই ঝাঁপিয়ে পরলাম আমি আর আমার সাইকেল পার্টনার। যে ঢাকা থেকে আলাদা বাসে এসে কক্সবাজারে আমার সাথে যোগ দিয়েছে।
 
দুজনে মিলে ১০/১২ টা কলা একটা রুটি আর শীতল পানি সাবাড় করে আর ১২ টা কলা পলিথিনে ঝুলিয়ে নিয়ে চালাতে শুরু করলাম। লোকালয় ছাড়িয়ে সমুদ্রের ফাঁকা যায়গায় গিয়ে পৌঁছতেই সাইকেল নিজ থেকেই যেন থেমে যেতে বাধ্য হল। মেরিন ড্রাইভের প্রথম বাঁক, প্রথম কার্লভারট বা ব্রিজ আর প্রথম উত্তাল সমুদ্রের সাথে সাইকেল চালাতে গিয়ে দেখা পাওয়া। সমুদ্র দেখে সাইকেল থেমে গেল! ছবি তোলা হল, সাথে কয়েক মিনিট বিশ্রাম তারপর আবার এগিয়ে চলার শুরু।
 
এবার শুরু হল একদম সত্যিকারের মেরিন ড্রাইভে চালানোর রোমাঞ্চকর আর অদ্ভুত সুখের অভিজ্ঞতা। একপাশে উত্তাল সমুদ্র, রুপালী বালুকাবেলা, আছড়ে পরা সফেদ ঢেউ, ঝলমলে রোদে দূরের সমুদ্রের সোনালী হয়ে ওঠা, অন্যপাশে পাহাড় ঘেরা সবুজের আচ্ছাদন, মাথার উপরে গাছের মায়াবী ছায়া আর গায়ে পরশ বুলিয়ে যাওয়া সমুদ্রের উত্তাল শীতল হাওয়া। সাথে আছে আমার জানু! আমার প্রিয় সাইকেল, ট্রেক মারলিন ৫!
 
এই সমুদ্র, ঢেউ, বালুকাবেলা, পাহাড়, অরণ্য, গাছের ছায়া, মাতাল হাওয়া, এই সবকিছু মিলে কি যে একটা সুখ সুখ অনুভূতি বলে না লিখে বোঝানো মুশকিল আসলে। এই সময়ের সুখানুভুতিকে আরও একটু বাড়িয়ে নিতে আমি আগে থেকেই সেই ৯০ দশকের বাংলা সিনেমার গান ডাউন লোড করে রেখেছিলাম মোবাইলে, কানে হেড ফোন লাগিয়ে, উঁচু ভলিউমে চালিয়ে দিলাম….
 
“সাগরের ঢেউ বলে তীর পেয়েছি,
আকাশের পাখি বলে নীড় পেয়েছি…!
আরও যে কত কি!
 
গান শুনছি, মাথা দুলাচ্ছি, মাঝে মাঝে নিজেও গেয়ে উঠছিলাম উঁচু স্বরে। যখনই প্রিয় আর পরিচিত গান বেজে উঠছিল।
 
সে এক অদ্ভুত আর রোমাঞ্চকর দুপুর ছিল। প্রিয় গান, প্রিয় পাহাড়, প্রিয় সমুদ্র, উত্তাল ঢেউ, মাতাল বাতাস, প্রিয় সাইকেল আর আমাদের অপূর্ব সৈকত ছুঁয়ে ছুটে চলা দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ। কিছুদূর এগোতেই আর্মিদের একটা পয়েন্ট পেলাম। সবুজ আর সাজানো গোছানো একটা ক্যাফে হাতের বাঁয়ে, ডানে কিছুটা বাঁধাই করা বসার যায়গা, নারকেল গাছের ছায়া। দারুণ লাগলো দুর থেকে যায়গাটা। আরও ভালো লাগার কারন হল সমুদ্রের ঢেউ এখানে প্রায় মেরিন ড্রাইভ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় বারে বারে। সাইকেল থেমে গেল সেখানে নিজের ইচ্ছাতেই।
 
সেখানে আবার পানি, কলা, খেজুর খেয়ে কিছু সময় বসে কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম ঝটপট। ইনানি তখনো সম্ভবত ১৫ কিলোমিটার হবে। এবার চালাতে শুরু করতেই প্রকৃতি ভিন্ন রূপে ধরা দিল। সমুদ্র কিছুটা দূরে সরে গিয়ে দুপাশেই সবুজের আচ্ছাদনে ভরে গেল। একপাশে পাহাড়ি অরণ্যের সবুজ আর ডানে ছোট বড় মাঝারি ঝাউ ও অন্যান্য গাছের কোমল ছায়া। পথ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘাস লতাপাতার ডগা মাঝে মাঝেই স্পর্শ করে দিচ্ছিল গায়ে, পায়ে, হাতে। দারুণ একটা শিহরণ সেই সব ছুঁয়ে যাওয়ায়।
 
পথে একটা মাচায় ডাব দেখে চলতি পথেই দাম জিজ্ঞাসা করায় দাম শুনে পিলে চমকে গিয়ে দ্রুত চালাতে লাগলাম ভয় পেয়ে! একটা ডাবের দাম চায় ১৫০ টাকা। ডাবের তৃষ্ণা পরে পানি দিয়েই মেটালাম বাপরে! সামনে পথ বড় হল, গাছগাছালিতে ভরে গেল, নানা রকম হোটেল মোটেল রিসোর্ট চোখে পরতে লাগলো, সমুদ্র বেশ কিছুটা দূরে সরে গিয়ে নিখাদ লোকালয় দিয়ে চলতে থাকলাম। রেজু খালের আগে পর্যন্ত মোটামুটি এমনই পথ পেলাম। গরম আর রোদ হলেও বেশ ছায়া ঘেরা আর বাতাসের আদর ছিল সব সময়ই।
 
রেজু খালের লোহার ব্রিজের উপরে গিয়ে একটু থাকলাম দুটো ছবি তুলে স্মৃতি ধরে রাখবো বলে। দুজনে মিলে দুই তিনটি ছবি তুলে আবার পথ চলা। এবার মোটামুটি এক টানে ইনানি গিয়ে থামলাম। ব্রিজ পার হতেই আমাদের রিসোর্ট। সুর্য তখন গনগনে, গরম তখন চরমে আর রেজু খালের পরে বেশ হাঁপিয়ে উঠে যখন রিসোর্টে ঢুকি তখন বেশ কাহিল অবস্থা! ভাগ্যিস আজকেই টেকনাফ যাওয়ার ইচ্ছা বাতিল করেছিলাম। রিসোর্টে ঢুকতেই দেখি মেহেক বাবার জন্য বারান্দায় অপেক্ষা করছে! মেয়েকে দেখে ওর দিকে খেয়াল করতেই সাইকেল প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল।
 
ভাগ্যিস কোন মতে সামলে নিয়েছিলাম। সাইকেল আর আমার সেদিনের মত বিশ্রাম। সোজা রুমে ঢুকে গেলাম সাইকেল নিয়েই। সামনের বারান্দার সমুদ্রের পাড়ে সাইকেল রেখে দিলাম আগামীকালের জন্য। ইনানি থেকে টেকনাফ জিরো পয়েন্টের মূল রাইডের জন্য।
 
ইনানী থেকে টেকনাফ জিরো পয়েন্ট
 
আমার ইচ্ছে ছিল ভোর পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে পরে খুব সকালে সাইক্লিংটা শুরু করবো। সেভাবেই সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগে কক্সবাজারে কর্মরত ছোট ভাই, কক্সবাজারের আর এক পুলিশের বড় কর্তা আমাদের ক্যাম্পাসের বড় ভাইয়ের সাথে আমার ব্যাপারে কথা বলে জানালো, ৫ টায় শুরু না করে ৬ টার পরে শুরু করতে। কারন যতই টহলকে বলা থাকুক না কেন, খুব সকালে কেউ কাউকে একা পেয়ে কোন একটা ঝামেলা করে বসলে পুলিশের সহয়তা নিতেও কিছুটা সময় লেগেই যায়, তাই একটু যেন দেরি করে বের হই।
 
সেই পরামর্শ মেনেই ঠিক ৬ টায় সাইকেল বের করলাম। অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে সাইক্লিং যখন শুরু করি তখন সকাল ৬:২০। বেশ আয়েশ করে হেলেদুলে চালাতে শুরু করলাম। সুর্যদেব তখন উঠেই গেছে দূরের আকাশে আলোক রেখা তেমনই জানান দিচ্ছিল। মেঘলা ছিল বলে পুর্ন আলোর রোশনাই ফুটে ওঠেনি তখনো। বেশ একটা শীতল আবহাওয়া, দুইপাশে ঘন সবুজের আচ্ছাদন, গাছ, ঘাস লতাপাতা আর সমুদ্রের ঝিরঝিরে বাতাসে এগিয়ে যেতে শুরু করেছি।
 
প্রথম বাঁকে এসেই সাইকেল থেমে গেল! আর্মিদের কটেজ কাম রেস্ট হাউজের ঠিক আগের ব্রিজের উপরে। চমৎকার যায়গা, সমুদ্রের ঢেউ একদম ব্রিজের নিচের বালুচরে এসে আছড়ে পড়ছে যেভাবে বাংলা সিনেমার নায়িকারা নায়কের প্রেমে পরে বিছানার উপর আছড়ে পরতো ঠিক সেভাবে!
 
তাই সেই সময়ের বাংলা সিনেমার স্মৃতি রোমন্থন করতে আর সাইকেলের এতো কাছ থেকে সমুদ্রের ছবি তুলতে থামতেই হল। কয়েকটা ছবি তুলে আবার চালানো শুরু করলাম।
 
সামনের কি যে একটা ফাইভ স্টার এর কাছাকাছি বড় হোটেল ছিল, রয়েল টিউলিপ নাম বলেছে কিন্তু লেখা ছিল অন্যকিছু একটা। আমি আদার ব্যাপারীও নই তাই আর জাহাজের খবর নেয়ার মত সময় নেই বলে, সেই যায়গাটার কাদাপানির পথ পার হতেই আবার মিহি সবুজের গাছের ছায়া ঘেরা পথ পেয়ে গেলাম। এবার একটু জোরেই চালাতে শুরু করলাম কানে হেডফোন লাগিয়ে গান ছেড়ে দিয়ে। কারন আমি জানি এতো সকালে এই দিকে আর তেমন গাড়ির চাপ থাকবেনা। তাই এবার একটু দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।
 
কিন্তু না খুব বেশী সময় এমন করে চালাতে পারিনি, সকাল যত এগিয়ে আসছে, সমুদ্রের মাতাল হাওয়া তত পাগলামি শুরু করতে লাগলো! সাইকেল আমি চালাতে চাইলেও বাতাসের উল্টোদিক থেকে আসা বাঁধা সেটা চালাতে দিচ্ছিলোনা আমার মত করে।
 
তাই আবারো গিয়ার পরিবর্তন করে দুই দুইয়ে হালকা করে চালাতে শুরু করলাম। আরও কিছুদূর গিয়ে এমন একটা যায়গা পেলাম যেখানে সমুদ্রের তীর ভেঙে প্রায় মেরিন ড্রাইভ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ প্রায় রাস্তার উপরে উঠে যেতে চাইছে!
 
আর উল্টো পাশে একটা বেশ বড় সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড়ের দেয়াল! পাহাড় আর সমুদ্র এই দুইয়ে মিলে বেশ চমৎকার একটা লোকেশন এটা। তাই সেই যায়গায় সাইকেলের সুখ স্মৃতি ধরে রাখতে আবারো একটু দাঁড়ালাম। ছবি তুললাম, পানি খেলাম।
 
নতুন করে আবারো চালাতে শুরু করলাম। এতক্ষণে আমরা মাত্র ১০ কিলোমিটার এসেছি মাইল ফলক দেখে বুঝলাম। যদিও আমাদের সময় নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই, কোথাও যাওয়ার কোন তাড়াহুড়ো নেই। তাই আয়েশ করেই চালাতে বাধ্য হলাম। আসলে বাধ্য হলাম না বলে বলা যায় সমুদ্রের পাগলা হাওয়া আমাদের ধীরে চালাতে বাধ্য করলো।
 
মাঝে মাঝে বাতাসের বেগ এতোটা বাঁধা দিচ্ছিলো যে ঘণ্টায় এক কিলোমিটার বেগেও সাইকেল চলছে কিনা সন্দেহ জেগেছে! মাঝের ১০ কিলোমিটার একদম সমুদ্র ঘেঁসে চলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। হেলেদুলে, বাতাসের বেগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় অর্ধেক পথ শাপলাপুর চলে এসেছি সকাল ১০ টা নাগাদ।
 
তবে এই পুরো পথের যেটা সবচেয়ে আরামের দিক ছিল সেটা হল কোন রোদের তাপ ছিলোনা, গা ঘামেনি, তেমন একটা ক্লান্তিও ঘিরে ধরেনি আমাদের। পুরো সময়টাই মেঘলা আকাশ, মৃদু বৃষ্টি, দমকা হাওয়া, ফাঁকা মসৃণ পথ, গাছের ছায়া, ঝাউ বনের দোলা, ঢেউয়ের গর্জন, সমুদ্রের রূপ মুগ্ধ করে রেখেছিল। সাইকেল চালাতে গিয়ে একবারও মনে হয়নি, কষ্ট হচ্ছে, এতোটুকু বিরক্তি বা মেজাজ খারাপ হয়নি। শাপলাপুরের ঠিক আগে আগে একটা বাজার পেয়ে সেখানে গরম গরম পরাটা আর দুধচা পেয়ে গেলাম। ভর পেট নাস্তা করলাম দুধ চা দিয়ে পরাটা ভিজিয়ে।
 
শাপলাপুর পার হতেই হুড়মুড় করে কোন রকম নোটিশ ছাড়াই বিশাল বিশাল বৃষ্টি চুপচুপে করে ভিজিয়ে দিল কয়েক সেকেন্ডেই! এমনকি সাইকেল থামিয়ে পঞ্চোটা খোলার সময়টুকুও পাওয়া যায়নি, যে নিজেকে একটু রক্ষা করবো। সামনে, আশেপাশে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলামনা একটু মাথা গোজার মত!
 
এক অদ্ভুত আর অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে পরে গেলাম মুহূর্তেই! পঞ্চো খুলে পরতে পরতে বৃষ্টির অঝোর ধারা পায়ের জুতার মধ্যে পর্যন্ত ঢুকে গিয়ে টলটলে জলের পুকুর করে দিল দুই পায়ের ভিতরে! সারা গা মাথা ভিজলেও এতোটা বিরক্তি লাগেনা শুধু দুই পায়ের মোজা আর জুতার মধ্যে পানি ঢুকলে যতটা মেজাজ খারাপ হয় আর অসহায় লাগে!
 
একটু দূরে জলাশয়ের ওপারে একটা বস্তির মত কুঁড়ে ঘর দেখে সাইকেল হাতে করে নিয়ে বাসের সাকো পেরিয়ে সেই কুটিরে আশ্রয় নিলাম। সবকিছু চেঞ্জ করতে গিয়ে দেখি সাইকেলে থাকা ব্যাকআপ টিশার্ট, শর্টস, হাঁফ প্যান্ট সেগুলোও ভিজে গেছে প্রায়। আল্লাহর কাছে তখন শুধু চাওয়া ছিল যেন আমার সাধের আর দামী মোবাইলটা যেন ঠিক থাকে। আল্লাহ চাওয়া রেখেছেন, মোবাইলের কোন ক্ষতি আল্লাহর রহমতে হয়নি। সবকিছু তবুও পাল্টে নিলাম তুলনামূলক কম ভেজা হওয়ায়। সেই কুটিরে পরে একজন লোক আসায় তার কাছ থেকে চেয়ে একটা পলিথিন চেয়ে নিলাম মোবাইলটাকে কিছুটা রক্ষা করার জন্য।
 
মোবাইল পলিথিনে পুরে, বৃষ্টি একটু ধরে আসাতে, পায়ে জুতা গলিয়ে সাইকেল হাতে করে রাস্তায় নিয়ে আবার চালাতে শুরু করলাম। কিন্তু ভেজা জুতার মধ্যে পা দিয়ে ভীষণ রকম অসস্থি হচ্ছিলো চালাতে। তাই মনে মনে উপায় খুঁজতে লাগলাম কি করলে জুতা পরেই, কোন রকম অসস্থি বা কম অসস্থি নিয়ে সাইকেল চালানো যেতে পারে। ভাবতে ভাবতেই একটা উপায় পেয়ে গেলাম, কিন্তু দরকারি সরঞ্জাম তো কাছে নেই। তাই ধীরে ধীরে চালিয়ে গ্রামের আর পথের পাশে দোকান খুঁজতে থাকলাম।
 
বেশ কিছুটা চালিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা দোকানে খুঁজে খুঁজেও না পেয়ে আর একটা ছোট বাজারের মত একসাথে কয়েকটা দোকান পেয়ে একটা দোকানে টাকার কথা বলতে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়া গেল! পলিথিন, হ্যাঁ বেশ বড় আকারের পলিথিন খুঁজে পেতে চাইছিলাম আমি যেন পায়ে পরে তার উপর মোজা পরে তার উপর জুতা পড়লে কিছুটা হলেই ভেজা ভেজা অসস্থি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। হলও তাই। পলিথিন, তারপর মোজা আর তারপরে জুতা পরার পরে সাইকেল চালাতে আর তেমন একটা অসস্থি লাগছিলোনা বা কম লাগছিলো।
 
এভাবে আরও পাঁচ কিলোমিটার পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই রিমঝিম বৃষ্টি, হালকা বৃষ্টি, একটুখানি রোদ, কিছুটা শুকনো আবহাওয়া আবার একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কিছুদূর যাওয়ার পরে আবারো শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। এতো এতো বৃষ্টি যে চোখ খুলে রাখার উপায় ছিলোনা। চোখের মধ্যে বিশাল বিশাল এক একটা বৃষ্টির ফোঁটা যেন হুল ফোটাতে চাইছিলো! বাধ্য হলাম আগের পলিথিন আর অন্যান্য মোজা খুলে একটা যায়গায় ছাউনি পেয়ে থেমে যেতে। সেখানে সবকিছু খুলে বসে রইলাম একটু বৃষ্টিটা ধরে আসার জন্য। কিন্তু বৃষ্টি একটু কমে তো পরক্ষনেই তারচেয়েও মুষলধারে ঝরতে শুরু করে!
 
প্রায় ঘণ্টাকাল এভাবে কাটার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে বৃষ্টি শেষ হলে সাইকেল চালিয়ে জিরো পয়েন্ট যেতে চাইলে আজকে আর নাও যাওয়া হতে পারে! তাই শুরু মোবাইলটা যেন রক্ষা করা যায় এমন প্রস্তুতি নিয়ে বৃষ্টি একটু ধরে আসার অপেক্ষায় রইলাম আর দুজনে মিলে ঠিক করে নিলাম সামনের ১৩ কিলোমিটার আর কিছুতেই বৃষ্টির কারনে ব্রেক নেবনা। যদিনা নিজেদের কোন প্রয়োজন না হয়। যত বৃষ্টিই ঝরুক, আমরা সেই বৃষ্টি মাথায় করে, বৃষ্টিকে উপভোগ করতে করতেই এগিয়ে যাব। এই ভেবেই বৃষ্টি একটু ধরতেই সাইকেল নামিয়ে চালাতে শুরু করলাম।
 
ভাগ্যের পরিহাস না কি উপহার জানিনা। সাইকেলের দুই হাতলে দুই জুতা বেঁধে, দুই জোড়া মোজা দুই হ্যান্ডেলে পেঁচিয়ে, টিশার্ট সাইকেলের সাথে বেঁধে, চালাতে শুরু করলাম আর বৃষ্টিও যেন আগের চেয়েও তুমুল বেগে ঝরতে শুরু করলো। এমন বৃষ্টি আমি জীবনে দেখেছি কিনা ঠিক মনে করতে পারছিলামনা।
 
মাঝে মাঝে তো বৃষ্টির তোড়ে চোখ খুলে রাখাই দায় হয়ে যাচ্ছিল এতোই বড় ছিল বৃষ্টির ফোঁটার আঁকার আর তেজ। বাকি ১০ কিলোমিটার পথের পুরোটা পথই কখনো তুমুল বৃষ্টি, কখনো ঝিরঝিরে, কখনো টিপটিপ বৃষ্টি আর কখনো অঝোর ধারায় গান শুনিয়ে যাওয়ার মত বৃষ্টি ঝরে চলেছিল মেরিন ড্রাইভ জুড়ে।
 
সাইকেলে করে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, অদ্ভুত আনন্দে ভিজে ভিজে, চুপচুপে হয়ে গিয়ে, অঝোর ধারার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যখন সাবরঙ পৌছাই ঠিক সেই সময়েই বৃষ্টিটা হুট করেই থেমে গিয়েছিল! কিন্তু যা পাওয়ার, যা উপভোগ করার, যে আনন্দের বরষাতে ভেজার তা ভিজে নিয়েছি একটু আগেই।
 
অনন্তকাল মেরিন ড্রাইভের এই দুপুরের তুমুল বৃষ্টিতে সাইকেল চালানোর সুখ স্মৃতি অমলিন থাকবে স্মৃতির এলবামে, সুখের বুক পকেটে থাকবে একটা অদ্ভুত প্রাপ্তির ছবি হয়ে।
 
একটা দোকানে বসে চিপস আর কলা খেতে খেতে ভাবছিলাম জিরো পয়েন্ট আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। যাবো কি যাবোনা এই নিয়ে মনের সাথে যুক্তিতর্ক করছি। যা দেখার, যা পাওয়ার তা তো দেখেই নিয়েছি, পেয়েই গেছি! তাহলে?
 
তাহলে যাই-ই না শেষ পাঁচ কিলোমিটার একটা পথের শেষটুকু শেষ করে ফেলি। কোন আক্ষেপই আর থাকবেনা তবে। তারপর ইচ্ছে না হলে না হয় একটা পিকআপের পিছনে সাইকেল তুলে নিয়ে চলে আসা যাবে ইনানির দিকে! এমন ভাবনা নিয়েই চালাতে শুরু করেছিলাম শেষ পাঁচ কিলোমিটার পথ, টেকনাফ জিরো পয়েন্টের দিকে……
 
তুমুল বৃষ্টিতে সাবরঙের যে দোকানের কাঠের বেঞ্চে আমরা বসে ছিলাম সেই দোকানের পাশের সরু পথ দিয়েই চলে যাওয়া যায় টেকনাফ মূল শহরে। আর মেরিন ড্রাইভ ধরে আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই জিরো পয়েন্ট। সেই সকাল থেকে এই দুপুর অবধি এতোটা পথের প্রায় পুরোটাই বাতাসের উল্টো দিকে চালিয়ে আসতে পেরেছি আর এই শেষ পাঁচ কিলোমিটার বাকি রেখে ফিরে যাব মন কিছুতেই সেই সায় দেয়নি বলে আবারো সাইকেলে চড়ে প্যাডেল দিতে শুরু করলাম।
 
এই পাঁচ কিলোমিটার পথের সমুদ্রের পাশে একটি গাছও নেই, যে কারনে বাতাসের বেগ আগের চেয়েও তীব্র বেগে এসে সাইকেলকে রুখে দিতে সব রকম চেষ্টা করতে লাগলো। মাঝে অল্প কিছু যায়গায় বর্নিল মাছ ধরার ট্রলার গুলো এই পথটুকুকে ভিন্ন মাধুর্যতা দিয়ে ঘিরে রেখেছিলো। আর বাকি পথের পুরোটাই সমুদ্রের ঝড়ো বাতাসের বিরুদ্ধে চালিয়ে প্রায় ৩০ মিনিটে পৌছালাম জিরো পয়েন্টে।
 
কিন্তু সত্যি বলতে কি জিরো পয়েন্টে গিয়ে আমি যারপর নাই হতাশ এখানে কেন জিরো পয়েন্ট করতে হল, এই মরুভূমির বালুর মধ্যে বুঝে পেলামনা! না হয় এক বা হাঁফ কিলোমিটার আগেই শেষ করতো মেরিন ড্রাইভ ঠিক যেখানে সমুদ্রের সাথে মূল পথের শেষ হয়েছে। সেখানে করলে কি এমন দোষ হত আমি জানিনা অবশ্য। সে যাই হোক, কষ্ট লাগলেও আনন্দিত ছিলাম এই ভেবে যে অবশেষে মেরিন ড্রাইভের পুরো পথটুকুই নিজের প্রিয় সাইকেল চালিয়ে নিরাপদে শেষ করতে পেরেছি বলে।
 
কয়েকটা ছবি তুলে অফিসের কিছু কাজ নিয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় কাজ করতে করতেই সাইকেল ঠেলে পায়ে হেটেই এগিয়ে এলাম মূল মেরিন ড্রাইভে শেষ বা এদিক থেকে শুরুর পয়েন্টে। এখন আমরা বাতাসের দিকে যাব, হয়তো আগের মত কষ্ট হবেনা প্যাডেল চালিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে। আর যদি খুব কষ্ট হয় তখন না হয় বিকল্প ভাবনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা যাবে। এই ভেবে ঠিক করলাম শেষ যে পাঁচ কিলোমিটার এসেছিলাম সাবরঙ থেকে, সেই পর্যন্ত চালিয়ে যাই, তারপর বাকিটা সেখানে গিয়ে ভেবে দেখবো।
 
এই ভাবনা মাথায় নিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে ফিরতি পথে চালাতে শুরু করলাম। বাতাসের দিকে আর ফেরার আনন্দ, সেই সাথে একদম ফাঁকা মেরিন ড্রাইভ পেয়ে প্রথমবারের মত সাইকেলের গিয়ার আপ করলাম। দুই আর এদিকে তিন থেকে চারে।
 
অনুভব করলাম আমি সাইকেল চালাচ্ছিনা, সাইকেলই যেন আমাকে তার সিটে বসিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে! অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ খেলে গেল প্রানে, শরীরের সবটুকু শক্তি যেন মুহূর্তেই ফিরে এসেছে! সাথে সাথে জীবনে প্রথমবারের মত বায়ের গিয়ার তিনে আর ডানের ফিয়ার পাঁচে আপ করতেই এবার আর সাইকেল আমাকে নয়, আমিই যেন সাইকেল নিয়ে উড়ে যেতে শুরু করলাম!
 
কি যে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সেই মুহুর্তে আচ্ছন্ন হয়ে পরেছিলাম বোঝানো যাবেনা কিছুতেই। একটা অদ্ভুত নেশা হয়ে গেল প্যাডেল মারার। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, পিছন থেকে দুই একটা গাড়ি যখন আমাকে টপকে যাচ্ছিল, কিন্তু বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় লাগছিলো ওদের আমাকে ওভার টেক করতে তখনই রোমাঞ্চ আরও বেড়ে গিয়েছিল সাইকেলের গড়ি যে মারাত্মক অবস্থায় আছে সেটা বুঝতে পেরে! ঠিক ৫ মিনিটের ও কয়েক সেকেন্ড কম সময়ে আগের ৩০ মিনিটের পথ শেষ করে সাবরঙ এসে অফিসের ফোনের জন্য থামতে হয়েছিল।
 
কিন্তু ততক্ষনে সিদ্ধান্ত যা নেয়ার নিয়ে নিয়েছি যে এই ফিরে যাওয়ার রোমাঞ্চকর পথ আর তার চেয়েও রোমাঞ্চকর ইচ্ছেমত সাইকেল গতি বাড়িয়ে চালানোর রোমাঞ্চ থেকে কিছুতেই নিজেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। ফেরার পুরো পথটুকুই আরও মজা করে, উপভোগ করতে করতে উড়ে উড়ে চলবো।
 
অফিসের ফোন শেষ করে তাই ভালো করে আর একটু প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। পানি খেতে, নিজেদের একটু হালকা করে, খেজুর খেয়ে এনার্জি গেইন করে, ডাবল করে দুই পায়ে বড় পলিথিন পেঁচিয়ে কেডস ভালো করে পায়ে বেঁধে নিয়ে, গ্লাস খুলে সাইকেলে লাগিয়ে শুরু করলাম এক উড়ন্ত রাইড।
 
গড়ে ৪১ কিলোমিটার গতিতে একটানে ত্রিশ কিলোমিটার চলে এসেছিলাম শাপলাপুর পর্যন্ত। আগে যে পথের ব্রিজ গুলো ২/২ এ চালিয়ে গিয়েছি সেই পথের ব্রিজ গুলো এবার ৩/৫ এ চালিয়েছি অনায়াসে। যে যায়গা গুলোতে বাতাসের তোড়ে সাইকেল প্রায় থেমে থেমে গিয়েছিল, সেই যায়গা গুলোতে এবার উল্টো উড়ে উড়ে চলেছে! পথের গাছপালা, ঘাস, লতাপাতা, ঝাউবন সবকিছু মুহুর্তেই ছাড়িয়ে গেছি প্রতিটি প্যাডেলে প্যাডেলে। এই সময় টুকুতে মনের মধ্যে নানা ধরনের মিশ্র অনুভূতি নানা সময়ে আমাকে অদ্ভুতভাবে পুলকিত করেছে।
 
কখনো মনে হয়েছে আরে ইনানি পৌঁছে গেলেই তো শেষ হয়ে যাবে, একটু রয়ে সয়ে চালাইনা! কখনো মনে হয়েছে দ্রুত গিয়ে রিসোর্টে পৌছাতে পারলে বাচ্চাদেরকে সময় দিতে পারবো। কখনো মনে হয়েছে ইস এই যায়গাটা কি অদ্ভুত সুন্দর, মায়াময়, মনকাড়া, এখানে একটু থেমে থাকিনা কিছুক্ষন!
 
কখনো মনে হয়ছে আহা, পাহাড় আর সমুদ্রের ছুঁয়ে যাওয়া সম্মীলনে দুই গাছের সাথে হ্যামকটা ঝুলিয়ে কাটিয়ে দেইনা একটা অলস বিকেল! আবার তখনই মনে মনে হয়েছে, আহারে এমন ফাঁকা আর মিহি রাজপথ তো প্রতিদিন ভাগ্যে জোটেনা সাধ মিটিয়ে সাইকেল চালানোর, তাই আজকে একটু আশ মিটিয়ে, সাধ মিটিয়ে, গিয়ার আপ করে, দারুণ গতিতে চালাইনা সাইকেলটা!
 
এসব ভাবতে ভাবতেই মাইলেজ দেখি ইনানি আর মাত্র ২৫ কিলোমিটার! তার মানে আমরা ৩০+ কিলোমিটার চলে এসেছি এক ঘণ্টার কম সময়েই! কি অদ্ভুত আর কি রোমাঞ্চকর ছিল সেই পথটুকু লিখে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই সত্যি!
 
শাপলাপুরে মেরিন ড্রাইভের পাশের একটা ছাপরা হোটেলে দাঁড়ালাম, একটু বিশ্রাম আর ডাবের জলে তেষ্টা মেটাবো বলে। একশ টাকার বিনিময়ে প্রায় দুই গ্লাস মিষ্টি ডাবের পানি আর সাথে হালকা তুলতুলে সরের একটা ডাব দিতে বললাম। পানি খেয়ে পেট ভরে, ডাবের সরে মন ভরালাম। সেই সাথে সাইকেল নিয়ে আমাদের এই পাগলামি নিয়ে দুই এক জনের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আবার চালাতে শুরু করলাম।
 
পরের ২৫ কিলোমিটার অবশ্য আগের মত গতিতে চালাইনি। কারন আবারো অফিসের কিছু জটিলতা শেষ করতে হয়েছে সাইকেল চালাতে চালাতে, ফোনে ফোনে। তাই ঝুঁকি নিয়ে দ্রুত চালাতে চাইনি কিছুতেই। বেশ আয়েশ করে বাকি ২৫ কিলোমিটার শেষ করেছিলাম প্রায় দেড় ঘণ্টায়। দুপুর ঠিক ১:২০ মিনিটে টেকনাফ জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে বিকেল ঠিক ৪ টায় পৌঁছে গিয়েছিলাম ইনানিতে আমাদের রিসোর্টে। ফিরে এসেছিলাম দিনের বাকি সময়, রাত আর পরের পুরো দিনটি পরিবারকে দেয়ার জন্য।
 
আর ফিরে এসে ভীষণ রকম তৃপ্ত ছিলাম, ছিলাম দারুণ আনন্দিত, ভাসছিলাম একা একাই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত রোমাঞ্চকর এক অনুভূতিতে, শেষ করতে পেরে অনেক দিনের লালিত, অনেক স্বপ্নের, অনেক ছোট্ট কিন্তু ভীষণ দুর্লভ ১৫০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সাইক্লিং শেষ করতে পেরে আর জীবনের অভিজ্ঞতার খাতায় আর একটু রঙিন পাতা যুক্ত করতে পেরে।
 
আর আমার এই স্বপ্ন পূরণে আমার পরিবার পাশে থাকায়, ওদেরকে দিয়েছিলাম অন্তরের অন্তরস্থল থেকে ধন্যবাদ। মনে মনে কৃতজ্ঞতা আর শুকরিয়া আদায় করেছিলাম বিধাতার কাছে আমার স্বপ্ন নিরাপদে পূরণ করার সাধ্য, সাহস আর সহয়ায়তা করেছেন বলে।