সাধারনভাবে পললগঠিত সমভূমির দেশ বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিন পূর্বাঞ্চল পাহাড়ি এলাকা। দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলে সুন্দরবন। তাই বৈচিত্র্যপিয়াসী ভ্রামনিকগন বিশেষ করে এসকল অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান। এর মাঝে রাংগামাটি জেলার সাজেক ভ্যালী সকল ভ্রামনিক এর কাছে এক আকর্ষণ এর নাম। শীতের সাজেক এক রকম আর বর্ষার সাজেক ভিন্ন। তাই প্রতিদিন, সারা বছর সারা দেশ থেকেই ভ্রামনিকেরা সারি বেঁধে সাজেকে যায়। পথের দুর্গমতা বা ঝুঁকি তাঁদের আকর্ষণ এ বাধা হতে পারে না। সাজেকের এই জনপ্রিয়তা খুব বেশীদিন হয় নি। ২০০৩-০৪ সাল থেকে দুর্গম এই পাহাড় চূড়ায় গাড়িতে যাতায়ত শুরু হয়। ২০১০ থেকে ভ্রামনিকদের যাওয়া শুরু। আর মুখে মুখে এর সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ২০১৫ থেকে এর জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী। এখন সপ্তাহান্তে ৩,০০০ এর মত ভ্রামনিক সাজেকে যায়, একটু লম্বা ছুটি হলে এই সংখ্যা ৪,০০০ ছাড়িয়ে যায়।

২০২৩ সালে ও সাজেক যেতে খাগড়াছড়ি যেয়ে রাত কাটাতে হয়। পরদিন সকালে ১০ টার মধ্যে রাংগামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট সেনানিবাসের চেকপয়েন্টে যেয়ে গাড়ি রেজিস্ট্রি করাতে হয়। এরপর কনভয় এর সংগে যাত্রা। একই সময়ে সাজেক থেকেও আরেকটি কনভয় যাত্রা শুরু করে। মাঝামাঝি কোথাও এদের ক্রসিং হয়। একেকটি কনভয় এ দুইশত থেকে তিনশত গাড়ি এবং সমসংখ্যক মোটরসাইকেল থাকে। যেতে যেতে ভাবছিলাম যে কারা প্রথম সাজেক এর এই উঁচু পাহাড়ে বসতি গড়ে। বাহিরের দুনিয়া বা প্রশাসনের সংগে তাঁদের সম্পর্ক কি ছিল? প্রশাসনিক কর্মকর্তা কে বা কারা এখানে প্রথম গিয়েছিলেন? তাঁদের লিখা কোন বিবরণ কি আছে কোথাও?
কিছুটা খোঁজাখুঁজি করতেই অন্ততঃ দুটি আত্মজীবনী পেলাম যেখানে গত শতকের ষাটের দশকে সাজেক ভ্রমনের বিবরণ রয়েছে। ১৯৬৩-৬৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক ছিলেন প্রাক্তন সিএসপি ১৯৫৫ ব্যাচ সুলতান-উয জামান খান (পরবর্তীতে চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিয এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন )। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি তাঁর অন্যান্য সহকর্মীদের সহ সাজেক ভ্রমণ করেন। সুলতান-উজ জামান খান তাঁর আত্মজীবনী ‘স্মৃতির সাতকাহন’ এ লিখেন “আমি জানতে পারলাম যে, প্রায় দেড়-দুই দশক আগে এক ইংরেজ ডি.সি. সাজেক উপত্যকা সফর করেছিলেন, তারপর আর কেউ যান নি। প্রশাসনিক সহকর্মীদের সংগে আলোচনা করে সেখানে যাওয়ার সফরসূচি গ্রহন করলাম। ১৯৬৩-র নভেম্বর (শীতকালই প্রকৃষ্ট মৌসুম) মাসে সিদ্দিকুর রহমান,জেলা কৃষি কর্মকর্তা মনসুর আহমদ, আলী হায়দার খান ও মোহাম্মদ হাসান সহ (বন কর্মকর্তা) আমি মারিস্যার নবপ্রতিষ্ঠিত জনপদ পেরিয়ে স্পীডবোটে রওনা হলাম। সবচেয়ে দুস্তর যাত্রাটি ছিল ‘নাক-ঠেকা’ পাহারগুলো অতিক্রম করা (পা পিছলে পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই!)। ঘন জঙ্গলাকীর্ণ সরু পথে বুনো হাতির সদ্য নিঃসৃত বিষ্ঠা দেখা গেল কোন কোন স্থানে, কিন্তু ভাগ্যিস তাদের দেখা মেলেনি!”

তিনি আরো লিখেন “অস্তগামী সূর্যের আলোয় সরু উপত্যকাভূমিতে পৌঁছে ভ্রমনের দারুন ক্লান্তির মধ্যেও এক অনির্বচনীয় আনন্দে মন ভরে উঠল! অনুভূতিটুকু এমন যে কোনো দুর্গম গিরিচূড়া জয় করেছি। সেখানে অবস্থিত সীমান্ত রক্ষী (ইপিআর) ক্যাম্পের প্রধানসহ লুসাই নরনারীরা আমাদের উষ্ণ সম্বর্ধনা জানালেন। রাতে লুসাই তরুন-তরুনীরা গিটার সহযোগে তাদের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করলো। ওখানকার হেডম্যান ছিল এক যুবক, মিশনারী শিক্ষার কল্যানে কিছুটা ইংরেজী জানত। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় পরিস্থিতি ও সমস্যাদি নিয়ে আলোচনা হলো।”

প্রথম রাতে ইপিআর জওয়ানরা আমাদের এক ভোজসভায় আপ্যায়িত করলেন। অতিথিদের জন্য খাটানো তাঁবুতে সে রাত কাটলো অতি নিস্তব্ধ প্রশান্তিতে। পরদিন সকালে দেহমনের সব ক্লান্তি মুছে গেল। আমরা যষ্টি হস্তে পর্বতপৃষ্ঠে অবস্থিত লুসাই জনপদ্গুলোর অবস্থা পরিদর্শনে বেড়িয়ে পড়লাম। স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনধারনের প্রধান অবলম্বন ছিল ‘জুম’ চাষ। এতদ্ব্যতীত, ৫০/৬০ বছর আগে খৃস্টান মিশনারিরা ঐ পাহাড়্গুলোতে ব্যাপক কমলালেবুর চাষ শুরু করেছিলেন। কমলার বাগানগুলো ছিল লুসাইদের নগদ আর্থিক আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবত যত্নের অভাবে বেশ কয়েকটি বাগান উর্বরতা হারিয়ে ফেলছিল। সেখানে যাবার আগেই খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, কারিগরী সহায়তাসহ উপযুক্ত সার, কীটনাশক ইত্যাদির অভাবে উৎপাদন শক্তি কমে আসছিল। সে কারনেই আমরা জেলা কৃষি কর্মকর্তাকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। তাছাড়া উৎপাদিত ফসল বাজারজাতকরণের সমস্যাটিও লুসাই জনগোষ্ঠীর আর্থিক দুরগতির অন্যতম মূখ্য কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানেই খবর পেলাম, সাজেক উপত্যকা থেকে মারিস্যা পর্যন্ত সরাসরি একটি রাস্তা তৈরির জন্য কাগজে-কলমে পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয়েছে। ঐ প্রকল্পটি যদি শিগগির বাস্তবায়ন করা যায়, তা হলে পন্যসামগ্রী বাজারে এনে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যেতে পারে। আমরা জেলা কাউন্সিল ও পুনর্বাসন তহবিলের সাহায্যে পরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলাম। যেটুকু বুঝা যাচ্ছে মারিস্যা থেকে স্পীড বোটে কাচালং ছড়া ধরে বাগাই হাট পয়েন্ট পার হয়ে কোথাও তাঁরা স্পীড বোট ত্যাগ করে খাড়া পাহাড় বেয়ে সাজেক উপত্যকা(?)র উপর উঠে যান। দীঘিনালা থেকে এখন বাঘাইহাট হয়ে সাজেক পর্যন্ত সড়ক চলে গিয়েছে। আর বাঘাইহাট থেকে মারিস্যা পর্যন্ত আরেকটি সড়ক এখন বর্তমান। তখন তার কোনটিই ছিল না।

জালাল আহমেদের  আরো লেখা

 

ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বর্তমানে সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। আপনি এ সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে চাইলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

 

ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের প্রায় ৭,০০০ ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।

আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।