সুন্দর জায়গা দেখার ব্যাপারে আমার তেমন একটা আগ্রহ নাই। সুন্দর সব একরকম, আলাদা কইরা তেমন একটা অনুভূতি তৈরি হয় না, ক্যানবেরাতে গেলাম, বাহ্ খুব সুন্দর, গ্রেট ওসেন রোড গেলাম, বল্লাম, আহা কী সুন্দর! ফিলিপ আইল্যান্ড গেলাম, এইতো আছে আর কি, মোটামুটি।
মানুষ নাই, জন নাই, পাখি নাই, জন্তু নাই, এক সীমাহীন আকাশ, নিরাকার সাগর, তার নিঃসীম নীল, ঘন বাতাস, যেই বাতাসে সব গাছের পাতা একই ভাবে নড়ে- পৃথিবীর সব গাছ। তো জায়গায় জায়গায় গিয়া এই একই সুন্দরের খোঁজ নিয়া সময় নষ্ট করার চেয়ে বরং একটা জায়গা বাইছা নেন ঘরের কাছে, ঐখানেই বারে বারে যান, আপনার টেকা খরচ কম হবে, কার্বণ ফুটপ্রিন্ট না কী যেন কয় ঐটা কম হবে, আপ্নের সময় নষ্ট কম হবে, আপ্নে সেই সময় দিয়া যেইসব দেশে অনেক মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন তাদের মন, তাদের সৌন্দর্য,বা ওইসব মানুষরে যেইসব ইন্টারেষ্টিং জিনিস বানায়া রাখছে, ওগুলা দেখতে যাইতে পারেন কিংবা প্লানিং করতে পারেন।
আমার তো মনে হয় ট্রাভেল করার চাইতে ট্রাভেল নিয়া প্ল্যানিং করাটা বেশি ইন্টারেষ্টিং। কোন ওয়েবসাইটে গিয়া হোটেল বুকিং দিমু, সস্তা পড়বে কোনটায়, ফ্রি ক্যান্সল্যাশন আছে কি না, কোন সময়ে ফ্লাই করলে সস্তা পড়বে, ফ্লাইট এর টাইম কী বেশি সকালে হইয়া যাবে নাকি অনেক রাইতে হবে, যখন পৌছামু ঐখানের টাইম তখন কত হবে? ট্যাক্সি পাওয়া যাবে তো? হোটেল খোলা থাকবে তো? এত কিছুর খোঁজ খবর নিতে যে মজা, ঘুরতে যাওয়ার পর সেই মজা কি পাইবেন? মনে হইবো ধুর, এই!
তো গত জুন মাসে আমাগো কুইন্সল্যান্ডের হুইটসানডে দ্বীপে যাওয়ার আগে সেই অবস্থা হইছিল।বছরের শুরু থেকে চারিদিকে কোভিড, বৌ কইলো খবরদার কোথাও যাওয়া যাবে না কিন্তু এই সময়ে। আমি ছয় মাস সময় নিয়া বৌরে না জানায়া একটা বুকিং দিলাম, বাচ্চাগো স্কুল বন্ধ থাকবে তখন, কোভিড ইনশাল্লাহ এর মধ্যে ফুইটা যাবে। আর বেশি আগের টিকেট ও সস্তা, হোটেল ও সস্তা, কিন্তু সস্তার যে তিন অবস্থা ঐটা একদম মাথায় থাকেনা টিকেট কিনার আগে। হোটেল বুকিং দেয়ার পর খেয়াল করলাম, ক্যান্সেল করলে নো মানি ফেরত। আমি ভাবি আরে তখন কি আর কোভিড থাকবে! আমাগো দুরন্ত মেডিকেল সাইন্স কোৎ কইরা গিলে ফেলবে কোভিডরে।
দিন যায় মাস যায়, কোভিড তো আর যায় না। ফ্লাই করার এক মাস আগে কুইন্সল্যান্ড আমাগো ভিক্টরিয়ানগো হাতে হারিকেন দিয়া দিলো, কইলো পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আমাগো হেগো জায়গায় যাওয়া নিষিদ্ধ। বৌ কইলো আমি বলছিলাম না ? বলছিলাম? তোমারে টিকেট কাটতে না করছিলাম? তো সবকিছুতেই তো বৌদের না থাকে, দুই একটা তো মিলবেই। এখন তো দেখি খবর খারাপ।
এই বিশ্বের সবচে সুন্দর সৈকত দেখা হবে না, ঐখানের বালু নাকি ট্যালকম পাউডারের চাইতেও পেলব। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখা হবে না, ভাবলাম সমস্ত কোরাল মইরা যাবার আগে পোলাপাইনদের দেখায়া নেই, বলি দ্যাখ মানুষ কেমনে দুনিয়াটারে ধ্বংস কইরা দিতেছে। টেকা পয়সাও ধরা, হোটেলের টাকা পাওয়া যাবে না, প্লেনের টিকেট কী পিছানো যাবে? কতগুলা ফোন করলে সেই টেকা আবার আমার হবে? সেই সব ভাইবা আর ঘুম আসে না। এদিকে আবার আজিমরে ফুসলায়া রাজি করছি। এখন বৌ কয় আমার টাকা ফেরত দাও, আজিম কয় মনু টাকা কী ফেরত পাবো? আমি আল্লাহরে ডাকি, নিয়ম কইরা বলি এইবার বাইচা গেলে কোরবানি দিবো গরু আর কাউকে মাংস দিবো না। আমি হোটেল বুকিং ক্যানসেল করি না, মনে মনে বলি লক ডাউন উইঠা যাবে ইনশাল্লাহ, পোলাপাইন বলে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ কি হবে না বাবা? আমি বলি অবশ্যই হবে আর প্রতিদিন সকাল বেলা উইঠা প্রথমেই ড্যান ভাইয়ের প্রেস ব্রিফিং শুনি।
আল্লাহ শুনে হয়তো আমার কথা, যেইদিন দুপুরে আমাদের ফ্লাইট তার আগেরদিন লকডাউন উঠায়া দেবার ঘোষণা দেয় কুইন্সল্যান্ড। হাফ ছাইড়া বাঁচি। আমি বলি হ্যাগো শুনছো। বৌ বলে জানি। বৌ জানে না এমন কিছু দুনিয়াতে আছে নাকি? পরের দিন ঠিকঠাক এয়ারপোর্টে পৌঁছাই, সস্তা একটা জায়গায় গাড়ি রাখি, ফ্লাই করি, ল্যান্ড করি, স্যুটকেস টোকাই, ড্রাইভার ঠিক করা ছিল আগে থেকে, ঠিকঠাক হোটেলে যাই, গিয়া দেখি তেরো নাম্বার রুম পাইছি, আমি আবার কুসংস্কার বিশ্বাস করি না কিন্তু একটু পরেই প্লেনের লোকজনের কাছ থেকে ফোন আসে, আমি নাকি আরেকজনের স্যুটকেস নিয়া চইলা আসছি। কী এক্সসাইটিং!
অবশেষে প্রথম রাত হইলো, আমাগো ভ্রমণ শুরু হইলো। ভ্রমণ নিয়া অবশ্য কিছু বলার নাই, স্যুটকেস হারানো ছাড়া বাকি সব আপনাগো ঘোরাঘুরির মতোই সুন্দর – সুন্দর বালি, সুন্দর সাগর, সুন্দর বন, সুন্দর সৈকত, এইসব নিয়া কথা বলার কী আছে? তার বদলে ছবি দেখেন।