মানুষ এতো ননসেন্স কিভাবে হয় বুঝতে পারিনা!
হাপাতে হাপাতে গাবতলি ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে কলকাতার বাসটায় কোন মতে উঠেছে অমি। ব্যাগ রাখতে রাখতে এক সিট সামনে বসা মেয়েটি ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথা গুলো বলল।
প্রথমে তেমন পাত্তা না দিলেও, চারদিকে ও বাসে ওঠার পর থেকে ফিস ফিস করে বাকা কথা শোনানো আর সামনের মেয়েটির গা জালানো কথায় কিছু না বলে আর পারলোনা।
অমি সামনে গিয়ে, মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বলল, দেখুন পুরোটা না জেনে কাউকে দোষ দেবেন না।
কি পুরোটা জানবো? কেন, ঈদের সময় বাস ছাড়ার ৩০ মিনিট আগে এলে কি হয়?
আপনি কি জানেন আমি আগে না পরে এসেছি?
তাহলে কি হাওয়া খেতে গিয়েছিলেন, বাস স্ট্যান্ডে এসে? এখন যদি ফেরি ঘাটে জ্যাম লেগে যায়? আর যদি ইমিগ্রেশনে ভিড় হয়ে দেরি হয় ওপারে যেতে কত রকম সমস্যা হতে পারে কোন ধারনা আছে আপনার?
জি সে ধারনা আছে। কিন্তু ভুল করেছে বাস কাউনটার। এই দেখুন, অমি ওর টিকেট বের করে দেখালো। এই বাসেরই টিকেট কিন্তু সময় দেয়া আছে রাত ১১ টা!
আর আমি বেশ আগেই কাউনটারে এসেছি। এসে শুনি এরা এটা করেছে আর আমার বাস ছেড়ে গেছে!
তবুও আপনার আরো আগে চলে আসা উচিৎ ছিল। এখন এই এতো সময় বসে থাকার জন্য বর্ডারে কি দুর্ভোগ পোহাতে হয় কে জানে? মেয়েটি তার মত করে বলে চলেছে। অমি ওর সিটে গিয়ে বসলো। বাস চলে যাওয়া আর সেটাকে ধরতে পারার টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে।
রাত ১১ টার ১৫ মিনিট আগে কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে যখন শুনলো ওর বাস ছেড়ে গেছে তখন মাথায় আগুন ধরার উপক্রম। বাসের সময় ১১ টায়, অথচ ১০:৩০ বাস কিভাবে ছেড়ে দেয়! ছেড়ে দেয়া বাস গাবতলি থেকেও চলে গেছে। কিন্তু ব্রিজ পার হয়নি এখনো। কাউনটার থেকে ওদের নিজেদের ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে বাসকে গাবতলি ব্রিজ পার হয়ে দাড়াতে বলা হল। বাস স্ট্যান্ড থেকে একজন অমিকে বাইকে নিয়ে রওনা হল।
ভাগ্য ভালো ছিল বলে বাস খুব বেশি দুরে চলে যায়নি।
অমির অনেক দিনের ইচ্ছে রুক্ষ পাহাড়ি অঞ্চল লাদাখ যাওয়ার। রুক্ষ বটে, কিন্তু দারুন রোমাঞ্চকর আর লোভনীয় একটা জার্নি এটা। কিন্তু সমস্যা হল, এখানে একা একা যাওয়া যায়না। আবার দল বেধে যে যাবে সেটাও মুশকিল।
কারন, লাদাখ যেতে যে লম্বা সময় আর বিশাল অর্থের দরকার সেটা ওর অন্যকোন বন্ধুর পক্ষে জোগাড় করা কঠিন। টাকা তো নয়ই, সময়ও নয়। কারন অমির সব বন্ধুই প্রায় সাংসারিক হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। অমি হয়নি, ওর ইচ্ছে হয়নি মুক্ত জীবনকে ধরাবাঁধা নিয়মে আর জীবনে বেধে ফেলার।
লাদাখের সব কিছুই কেমন যেন রুক্ষ। কিন্তু এই রুক্ষতার মাঝেও কি যেন একটা যাদু আছে, যেটা চুম্বকের মত ওকে বার বার টানে। কিছুতেই মাথা থেকে যায়না। একটা অজানা ভালোবাসা অনুভব করে কেন যেন এই রুক্ষতার প্রতি। তাই অমি লাদাখের প্রতি ওর এই টান, এই ভালোবাসার নিজস্ব একটা নাম দিয়েছে।
“রুক্ষ ভালোবাসার টানে!”
বাহ! দারুন তো! নিজের দেয়া নামে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেছে সেই থেকে। আর অপেক্ষায় থেকেছে একদিন যাবে ওর না দেখা সেই ভালোবাসাকে দেখতে। লাদাখে। একদিন অমি পালাবে ওর রুক্ষ ভালোবাসার টানে।
নানা যায়গায় গিয়েছে এখন পর্যন্ত। তবে কিছুতেই লাদাখটা মাথা থেকে যাচ্ছিলো না কেন যেন। তারপর অনেক অপেক্ষার পরেও যখন সাথে কাউকে পেলনা। তখন একদিন ঠিক করলো একাই বের হবে কোন এক লম্বা ছুটি দেখে। কিন্তু এতো লম্বা সোলো ট্রিপ যেহেতু আগে দেয়নি, তাই একটু অভ্যস্ত হতে কাছাকাছি কয়েকটা ছোট ছোট সোলো ট্রিপ দিয়েছে। বান্দরবান, সেন্ট মারটিন, মিরিক, দার্জিলিং, সান্দাকুফু, কলকাতা আর সাউথে। তারপর নিজেকে ঝালিয়ে নিয়ে এবার বেরিয়ে পরেছে জীবনের অন্যতম স্বপ্নের আর রোমাঞ্চকর এই সোলো ট্রিপে।
লাদাখ যাবে মানালি হয়ে। ফিরবে কাশ্মীর হয়ে। প্রায় ১৬-১৮ দিনের বিশাল ট্যুর। তাও একা একা। মনের মধ্যে একটু যেন কেমন কেমন লাগছিল। তার উপর জার্নির শুরুতেই বাস প্রায় মিছ হয়ে যাওয়া আর বাসে উঠে অযথা সবার বাকা কথা শুনে মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। বাকি জার্নি কেমন হবে কে জানে। যাক বেরিয়ে তো পরেছে। এসব ভেবে আর লাভ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে গেল। সারারাত আর একবারের জন্যও ঘুম ভাঙেনি।
একদম সকালে অমির যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় বেনাপোল পৌছে গেছে। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগলেও সামনের সিটের মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হতে আবার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। এর মধ্যে বাসের সুপার ভাইজার এসে সবার পাসপোর্ট চাইতে বেখেয়ালে দিয়ে দিল, যেটা ও করেনা আর দরকারও হয়না। আর তাছাড়া ট্রাভেল ট্যাক্স ওর দেয়াই আছে। অযথা ১০০ টাকা চলে যাবে পকেট থেকে।
বাস থামার পরেও সিট থেকে ওঠেনি অমি। মেয়েটিকে লক্ষ্য রাখছে। আগে মেয়েটি নেমে যাক, তারপরে ও নামবে। ওই মুখের দর্শন ও কিছুতেই করতে চায়না। যতটা এড়িয়ে যাওয়া যায়। দেখলেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। শালার আজকালকার মেয়ে গুলোর মধ্যে কোন মায়া বা মিষ্টতা নেই। এমন ঝগড়াটে আর ঝাঁঝালো কেন এরা। এদের সাথে যে কারা সংসার করে বা করবে উপরওয়ালা একমাত্র জানে।
মেয়েটি বাস থেকে নেমে কাউনটারে ঢোকার পরে অমি নামলো। ওদের কাউনটারে না গিয়ে অন্য কাউনটারে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নিল। গরমের দিন হলেও কেমন একটা কুয়াশা কুয়াশা আবেস যেন চারদিকে। গরম নেই বললেই চলে। ব্যাকপ্যাকটা পিঠে নিয়ে এক কাপ লাল চা নিয়ে দাড়ালো। চা শেষ হতে না হতেই বাস কাউনটার থেকে ইমিগ্রেশনের দিকে যেতে বলল।
খুব সকাল আর বাসের স্পেশাল কেয়ার দুইয়ে মিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস হয়ে গেল। পাসপোর্ট হাতে পেয়ে নো ম্যান্স ল্যান্ড পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পরলো। এখানেও খুব সকাল আর ওদের বাস প্রথম বলে তেমন কোন ঝামেলা হলনা।
দুই মিনিটেই সব কাজ শেষ করে বাস কাউনটারে চলে এলো। যাক ভাগ্যটা ভালো ছিল বর্ডারে। আশা করছি সেই ঝগড়ুটে অভিশাপ বন্ধ করেছে। ওর টিকেট নিয়ে বাসের কাছে চলে এলো আগে আগে বাসে উঠবে বলে। মেজাজ গরম করে ফেলা মেয়েটার সাথে কিছুতেই দেখা না হয় যেন।
সবার আগেই অমি বাসে উঠে পরলো। সবাই উঠে পরায় বাস সময়ের আগেই ছেড়ে দিল। যাক, কলকাতায় গিয়ে কিছুটা বেশি সময় পাওয়া যাবে। প্রিয় শহরে একটু হাটাহাটি করা যাবে, যদি তেমন গরম না থাকে। ওর ট্রেন সেই রাত ৮ টায়। এবার আর এপারে সময় কাটাবেনা। ডলার এক্সচেঞ্জ করে নিয়ে, হাওড়া চলে যাবে। স্টেশনের লকারে ব্যাকপ্যাক রেখে এপারে হেটে বেড়াবে গঙ্গার ধার ধরে।
ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় ফিরে, স্টেশনে গোসল করে ট্রেনে উঠে পরবে রাতের খাবার নিয়ে। আর তারপর ওর অনেক দিনের অপেক্ষার জার্নি শুরু হবে, প্রিয় বাহনে, ট্রেনে। রাতের ট্রেন চলার একটা অন্য রকম আনন্দ আছে। যেটা অমির কাছে খুব উপভোগ্য। এইসব ভেবে রেখেছে।
বাস কলকাতায় যেতে পথে এবার ব্রেক দেয়। ক্ষুধা লাগলেও, শুধু নেমে ওয়াশ রুমে গিয়ে আবার নিজের সিটে উঠে বসে পরলো। একেবারে কলকাতায় গিয়ে সকাল আর দুপুরের খাবার একসাথে আয়েশ করে খাবে বলে ঠিক করলো। বাসের এসির বাতাসে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। কলকাতা পৌছে যাওয়ায় সুপারভাইজারের ডাকে ঘুম ভাঙলো। সিটের সাথে আড়মোড়া ভেঙে বাস থেকে নেমে পরলো ব্যাকপ্যাক নিয়ে।
বাহ, অনেকদিন পরে প্রিয় শহর কলকাতায়। বেশ ফুরফুরে লাগছে শরীর মন। বেশ আনন্দ নিয়ে ডলার এক্সচেঞ্জ করতে গেল। এরপর মুখ ধুয়ে একটা জম্পেস খাওয়া দেবে অমি। তারপর হাওড়া গিয়ে লকারে ব্যাগ রেখে, ইচ্ছে মত হেটে বেড়াবে গঙ্গার ধারে। দারুন ভালো লাগায় মনটা ছেয়ে গেল।
ডলার এক্সচেঞ্জ করে, খেয়ে সোজা হাওড়া চলে গেল অমি। লকারে ব্যাকপ্যাক রেখে বেরিয়েছিল নদীর ধারে। কিছু সময় ঘোরাঘুরি করে রোদে হাপিয়ে উঠে স্টেশনে ফিরে এসেছিল ওয়েটিং রুমে। ততক্ষনে অবশ্য বিকেল হয়ে গেছে। ভাগ্যসি স্টেশনে ফিরে এসেছিল। নইলে ঝড়ের মুখে পরতে হত। লম্বা জার্নির শুরুতেই যেটা শরীরের জন্য ভালো হতনা। ওয়েটিং রুমে ফ্রেস হয়ে, সিনেমা দেখে বেশ ভালো সময় কেটে গেল। সাতটা বাজতেই, পাশের কেএফসি থেকে একটা বার্গার নিয়ে কালকা মেইলের ওর নির্ধারিত এসি কামরায় উঠে পড়লো।
অমি প্রথমে ভেবেছিল একা একা শিমলা মানালি যাবে সাথীর অভাবে। সেই অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা আর কিছুটা আক্ষেপ থেকেই দুধের স্বাদ ঘোলে না ঠিক পানিতে মেটানোর মত করে সময় পেলেই মানালি, রোথাংপাস ও এর আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো অন লাইনে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন লাদাখের নীল আকাশ, সাদা সাদা মেঘেদের দল আর পাথুরে পাহাড়ের ছবি চোখে পড়লো। বেশ অনেকক্ষণ খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সেই অদ্ভুত কিন্তু অপরূপ পাহাড়ের মন কাড়া সৌন্দর্যের দিকে। এবং মনে মনে ঠিক করেছিল, শুধু শিমলা আর মানালি নয়, একই সাথে একদিন সে লাদাখের এই নীল আকাশ আর হাজারো রঙে রেঙে থাকা পাহাড়ের ভিন্ন রূপ দেখতে যাবে।
সেই থেকে অমির মনে প্রানে লাদাখ যাবার নানা রকম জল্পনা, কল্পনা আর নিজের মত করে মানসিক প্রস্তুতি, পড়াশোনা, খোঁজ খবর নেয়া আর হাজারো গবেষণা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যায়গায় যাওয়া হয়েছে ওর কিন্তু লাদাখের ভূত কখনো ওর মাথা থেকে কেন যেন যায়নি। বেশ ভালো ভাবে জেঁকে বসেছে। যাই হোক নানা রকম ঝামেলা মিটিয়ে অবশেষে কলকাতা থেকে কালকা মেইলে চড়ে বসেছে। কালকা হয়ে ট্রয় ট্রেনে শিমলা, সেখান থেকে পরদিন সকালে বাসে করে মানালি, মানালিতে একদিন বিশ্রাম নিয়ে লেহ এর বাসে চড়ে পৌঁছে যাবে সেই স্বপ্নের লাদাখ এর লেহ শহরে।
ওর সিট জানালার সাথেই লাগোয়া। বেশ আগে থেকেই টিকেট কেটে রেখেছিল তাই বেশ ভালো একটি সিট বরাদ্দ আছে ওর জন্য। আশে পাশের সিট গুলোতে দুই একজন এসেছে, কিন্তু ওর ঠিক মুখোমুখি সিটটা এখনো ফাঁকা, কেউ আসেনি। মনে মনে ভাবছে, ইস ওর সমবয়সী কেউ যদি আসতো তবে দারুণ হত। ৩০/৩২ ঘণ্টার লম্বা জার্নি কিছু গল্প-কথায় কেটে যেত।
এই ভাবতে ভাবতেই অমির ঠিক সামনের সিটে এক ললনা এসে বসলো। দেখে খুশি হবার বদলে মনটাই দমে গেল ওর। কারন, বোঝা গেল যে মেয়েটি একাই সাথে আর কেউ নেই। বসে, ব্যাগপ্যাক রেখেই ফোনে অন লাইনে বাড়িতে আর বন্ধুদের জানিয়ে দিল যে সে ট্রেনে উঠে পরেছে। এবার শুরু হবে তার প্রথম একা একা লম্বা একটা ভ্রমণ।
এই কথা শুনে, পিঠ ও বুকের ব্যাপপ্যাক দেখে বোঝাই যায় যে সে একা এবং বেশ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। এসব মেয়েদের সাথে না যায় আরাম করে কথা বলা, না যায় নিজের মত করে চুপ করে থাকা। একটা গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়ে থাকে পুরো ভ্রমণ জুড়ে। তার উপর ৩০/৩২ ঘণ্টার মত লম্বা একটা ভ্রমণ! উহ, অমি আর ভাবতে পারছেনা। তাই একটু নিচে নেমে গেল, হালকা হয়ে গুমোট ভাবটা দূর করে আসতে।
ট্রেন ছাড়ার সময় হতেই অমি তার আসনে এসে পড়লো। মেয়েটি নিজের আসন গুছিয়ে বেশ এলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। কিছু একটা পড়ছে বেশ মনোযোগ দিয়ে, চোখে চশমা লাগিয়ে। অমি বসবে এমন সময় মেয়েটি চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ মেলে অমির দিকে চাইলো একটু। ঠিক অমির দিকে নয়, উপরের দিকে, কিন্তু অমির চোখে চোখ পরে গেল। অমি চোখ ফিরিয়ে নিল নিমিষেই। বসে পড়লো নিজের সিটে।
ও কি সত্যি দেখছে? নাকি রাতের সেই ভুত ওকে এখনো তাড়া করে ফিরছে বুঝতে পারছেনা। পুরো শরীর যেন হীম হয়ে গেল অমির!
কিছু না বলে নিজের সিটে বেশ আরাম করে পা বিছিয়ে বসে, কানে হেডফোন গুঁজে দিল মনোযোগ ফেরাতে। আর মনে মনে ভাবছে এই ঝগড়াটে এখানে কি করে? কোথায় যাবে? এর সাথে এতো লম্বা জার্নি করতে হবে? মেয়েটি ওকে আড় চোখে দেখছে, বেশ বুঝতে পারছে অমি। কিন্তু ও নিজ থেকে কিছুতেই কথা বলবেনা, পাছে হ্যাংলা ভাবে। ওর অত দরকার নেই। শুয়ে-বসে-ঘুমিয়ে-গান শুনে-বই পড়ে আর বাইরের দিকে তাকিয়ে দিব্বি কাটিয়ে দিতে পারবে ৩০/৩২ ঘণ্টা। এই ভেবে বাইরে তাকালো কানে হেড ফোন দিয়েই। ওদিকে মেয়েটিও উঠে বসে অমির মনোযোগ আকর্ষণ করে নিজের পরিচয় দিল।
হাই, আমি তরু, আপনি?
আমি অমি।
আরে, আপনি কালকের বাসের তিনি না! যার জন্য বাস অনেক সময় দাড়িয়ে ছিল।
ওটা আমার ভুল ছিলোনা, বাসের।
সে যাই হোক, ফরগেট ইট! কলকাতা যাবেন?
আপাতত।
আপাতত মানে? এরপর?
আসলে লাদাখ যাবো, কলকাতা থেকে ট্রয় ট্রেনে শিমলা হয়ে, ওখান থেকে বাসে মানালি হয়ে লেহ।
গ্রেট!
কেন?
মানে আমিও মানালি যাবো, তবে রুটটা একটু ভিন্ন।
কি রকম?
আমি ভাবছি কালকা থেকে সরাসরি বাসে মানালি, তারপর সেখান থেকে ক্যাসল, স্পিতি। শিমলা আমার তেমন একটা ভালো লাগেনা। আচ্ছা আপনি এতো গম্ভীর আর গুমোট কেন? ট্রাভেলাররা কি এমন হয়। তার উপর এমন সোলো? আরে আপনিই বলুন এমন একটা জার্নিতে যদি শুরুতেই বাস অযথা একজনের জন্য থেমে থাকে তাতে মেজাজ খারাপ হবে কিনা?
হ্যা তা হবে।
তাহলে?
ওটা সাময়িক প্রতিক্রিয়া ছিল। আমার যায়গায় আপনি থাকলে আপনারও হত। বাদ দিন তো। যাক একটু ভয় ভয়ও করছিল সেটা আর আপাতত নেই। এতো লম্বা জার্নি, একা একা কেমন লাগবে সেই নিয়ে একটু ভাবনা ছিলোই। তাতে যাই বলিনা কেন। শুনুন কাল রাতের কথা মাথা থেকো ঝেড়ে ফেলুন। আপনার কি প্ল্যান বলুন?
আসলে শিমলা যাবার আমারও তেমন কোন ইচ্ছে ছিলোনা, কিন্তু এই ট্রয় ট্রেনটায় চড়ার অনেক দিনের ইচ্ছে, তাই শিমলা হয়ে যেতে হচ্ছে।
ওহ আচ্ছা, কেন এর আগে শিমলায় আসেন নি?
নাহ, আসিনি। তাই ইচ্ছে ছিল যেবার এদিকে আসবো, ট্রয় ট্রেনে চড়ে শিমলা যাবো। এটা মিছ করতে চাইনা। আবার কবে না কবে আসা হয় কে জানে? তাই একদিনের বেশী প্ল্যান করে এই রুট।
আপনার কি প্ল্যান? আর একদম একা? নাকি অন্য কামরায় আছে বন্ধুরা বা পরিবার?
ধুর কি বলেন। পরিবার সাথে থাকলে কি এভাবে ব্যাকপ্যাক নিয়ে এসে যেতাম? আই হেইট পরিবার, মাই ফুট!
সে কি! কেন?
আছে, আছে। আসলে আমি এবার কিছুতেই চাচ্ছিলামনা আমাকে আর কেউ বাধা দিক। কোন পরিবার নয়। সেই একই ঘ্যান ঘ্যান আর প্যান প্যান। একই মুখ, একই বিধি নিষেধ আর ভালো লাগেনা। তবে একটা দিক ভালো লাগলো সেটা হল, মনের সাধ মিটিয়ে বাংলাটা বলা যাবে আপাতত।
জানেন, যেখানেই যাই না কেন, এই বাংলা বলতে না পারলে কেন যেন হাঁসফাঁস লাগে। উহ বাবা অফিসে বা বাসায় সারাক্ষণ ইংরেজি বলতে বলতে বিতৃষ্ণা ধরে গেল বাবা। আপনি বাংলা বলেন তো নাকি ইংরেজি বেশী বলেন?
কেন, একটাও কি বাংলা ছাড়া বলেছি নাকি?
হুম বেশ, তবে কালকার পরে মানালিতে আবার দেখা হতে পারে কিন্তু।
কেন ট্রয় ট্রেনেও তো যেতে পারেন? গিয়েছেন আগে?
নাহ।
তাহলে ট্রাই করতে পারেন।
কিভাবে?
রুটটা একটু চেঞ্জ করে নিলেন না হয়? একই সাথে যাওয়া যাবে কলকাতা থেকে মানালি পর্যন্ত। দারুণ হত তবে গল্প করতে করতে।
হুম ভেবে দেখি কি করা যায়? সময় যেহেতু আছে। যদিও শিমলা আমার একদম পছন্দ নয়।
ঠিক আছে দেখা যাক, আগে তো কালকা পৌছাই তারপর না হয় ভেবে দেখবেন।
হুম ঠিক আছে আগে তো কালকা পৌছাই। তারপর দেখি মন কি বলে?
বেশ।
ওদের পরিচিয় আর কথার ফাঁকে বেশ আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল। হঠাৎ খাবার অর্ডার নিতে এলো ট্রেনের বেয়ারা। অমির খাবার কেনা আছে জানালো। কথা থামিয়ে তরু রাতের খাবারের অর্ডার দিল। ট্রেন তার গতি এর একটু বাড়িয়ে দুলে দুলে চলতে শুরু করলো…