আমি হয়তো ঘুমের ঘোরে বা স্বপ্নে ছিলাম যখন সিদ্ধান্ত নিই এই ভয়ংকর ট্রিপটাতে যাবো। ভাবছেন এমনটা কেন বলছি? কারণ ট্রিপের জন্য ঠিক করা জায়গার নাম “রহস্যময় আন্ধারমানিক অভিযান”। একে তো আন্ধারমানিক তার উপর রহস্যময় এসব শুনতেই তো ভয়ংকর একটা অনুভূতি মনে নাড়া দেয়। আমি যখন থেকে ঘুরাঘুরি শুরু করি তার কিছু দিন পরই আমি এই আন্ধারমানিক নামটি শুনেছিলাম। শুনেই কেমন জানি শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছিলো যদিও আমার ঘুরাঘুরির শুরু পাহাড়ি এলাকায়। যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা দেখাতেই অনেকে বলে এটা তো সম্ভব না, ওটা নিষিদ্ধ এলাকা, মেয়ে নিয়ে কখনোই সম্ভব না.. এমন আরো কতো কি!!

যাই হোক, মুল কাহিনীতে যাওয়া যাক। পরিকল্পনা অনুসারে ডিসেম্বর মাসের এক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়ে যাই টিমের সাথে যাবার জন্য। টিমের কয়েকজন আগের রাতে যাত্রা শুরু করে ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে আবার কয়েকজন যুক্ত হন চট্টগ্রাম থেকে। সবার সাথে একত্রিত হয়ে আমরা প্রথমে যাই আলিকদম, জমির ভায়ের হোটেলে। সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ করে ট্রিপের জন্য প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী কেনা-কাটা করে প্রায় দুপুর ১২টা নাগাদ আমরা আমতলীর ঘাটে পৌঁছাই। হাতে গোনা কয়েক জনকে ছাড়া আমারদের টিমের বাকিদের সাথে পরিচয় ছিল না।

আমতলী ঘাট থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে আমাদের ট্রিপের মূল যাত্রা শুরু হয়। ২৫/৩০মিনিট পর আমাদের নদী পথ শেষ হয় এবং শুরু হয় পাহাড়ি পথ। ট্রেকিং করে পাহাড় বেয়ে উঠানামা, ঝিরি পথ ধরেই আমাদের হাঁটার রাস্তা। মোটামুটি সেদিনের বাকি সময় এমনকি রাতের অনেকটা সময় হেঁটে প্রায় ৭/৮ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ডাউংলি পাড়ায় পৌঁছাই।

সেদিন আমরা এ পাড়ায় থাকার সিদ্ধান্ত নেই। সময় ভুল না করলে সময় তখন রাত ৯টারও বেশি। ক্লান্তি সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সকালের পর থেকে সারাদিন তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি, তাই সবাই খুব ক্ষুদার্ত। সিদ্ধান্ত হলো ঝালমুড়ি মাখা খেয়ে হাল্কা ক্ষুদা নিবারণ করে নেয়ার, পাশাপাশি রাতের খাবারের রান্না চলছিলো। রান্না শেষ করে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় রাত ১টা বেজে গেলো। সব শেষ করে শুয়ে পড়ি যে যার মতো।

পরদিন অনেক ঠান্ডা আবহাওয়া, যার কারণে আরাম করে ঘুম হচ্ছিলো না। খুব সামান্য শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। ভোর প্রায় ৪:৩০ মিনিট নাগাদ ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। যে বাড়িতে ছিলাম তাদের কথার শব্দের কারণে। সচারাচর উপজাতিরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমায় এবং খুব ভোরে উঠে যায়। সাধারণত রান্না করে খেয়ে জুম ক্ষেতে চলে যায়।

ওতো ঘুম ভাঙ্গার পর আর কোনো ভাবেই ঘুম আসছিলো না। কিছুক্ষণ পর উঠে পুরা পাড়া ঘুরে দেখলাম,ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে বসে এলার্ম এর মতো সবাইকে ডেকে দিচ্ছিলাম। সবাই এক এক করে উঠে, খাওয়াদাওয়া করে ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেকিং এর জন্য প্রস্তুত হলো। গুছিয়ে বের হতে প্রায় ১১টা বেজে গেলো। আমরা ট্রেক শুরু করি এবং গত দিনের মত ঝিরিপথ,পাহাড় উঠা নামার মধ্যে আমাদের ২য় দিন শেষ হয়। সেদিন সিদ্ধান্ত হয়েছিল আমরা রেং ক্লাং মেম্বার পাড়া অব্দি যাবো। হাঁটার রাস্তা কমে যায় বলে আমরা বিকাল ৫টার আগেই পাড়ার পৌঁছে যাই এবং রাতে থাকার জন্য ঘর খুঁজে বের করি।

আমাদের আগে আরো ২টা গ্রুপ ছিলো। ওরা আগে পৌঁছে ঘর নিয়ে নেয় ওদের পছন্দ মতো। যাক, আলহামদুলিল্লাহ শেষ পর্যন্ত আমরা তিন গ্রুপই সুন্দর ঘরে জায়গা পেয়েছিলাম। আগের দিনের নিয়মে মুড়ি চানাচুর মাখা খেয়ে রাতের রান্নার তোড়জোড় শুরু। এ পাড়ায় দোকান থাকায় সবাই দোকান থেকে খাবার নিয়ে খাচ্ছে সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম কারণ পরদিন খুব সকালেই বের হতে হবে আন্ধারমানিক নারিশ্যাঝিরির উদ্দেশ্যে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, এর মধ্যে ২/৪জন নিজেদের মতো গল্প করছে, আমার পক্ষে অকারণে রাত জাগা একটা যুদ্ধ তাই আমি গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।

পর দিন ভোরে মোটামুটি ৫টা থেকেই সবাইকে ডাকা শুরু হয়। এক এক করে সবাই উঠে নাস্তা শেষ করে পাড়া থেকে ট্রেইলের উদ্দেশ্যে রওনা হই ৭টা নাগাদ। সেদিন আন্ধারমানিক পৌঁছে আমরা আবার একই পাড়ায় ফিরবো তাই অনেক পথ হাঁটতে হবে এটা আগে থেকেই বলে দেয়া সবাইকে। সবাই ডে ব্যাগে সারাদিন খাওয়া মতো শুকনা খাবার আর পানি নিয়ে হাঁটা শুরু করি। লম্বা ঝিরি পথ শেষ করে পাহাড় পাড়ি দেই আবার ঝিরি পথ আসে আবার পাহাড় আসে এমন করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে যাই ম্যানথং পাড়া। ওই পাড়ায় মাঝে মাঝে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়,সবাই বাড়িতে ফোন দিয়ে জানায় তারা সুস্থ এবং ভালো আছে। এর পর ওই পাড়া থেকে নারিশ্যা ঝিরি যেতে খাঁড়া নামতে হয়। এর মাঝে একটু রাস্তা ভুল করে অন্য পথে চলে যাই। তার জন্য আমার এক বন্ধুর (আবির) অনেক কষ্ট হয়। পাহাড় থেকে নেমে খানিকটা সমতলে হেঁটেই আমরা সেই নারিশ্যাঝিরি পৌঁছাই, আলহামদুলিল্লাহ!!

আমার একটা ছবি তোলা হয় ২:৫৮ মিনিটে। তার হয়তো ২/৪মিনিট পৌঁছাই নারিশ্যাঝিরিতে। সবাই ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে যায় এবং খুবই নগন্য সময় কাটিয়ে ফিরে আসার পথ ধরি। ঝিরি পথ হেঁটে আবারও সেই খাঁড়া পাহাড়। যেটা বেয়ে নেমেছিলাম সেটা বেয়ে উঠতে হবে, এদিকে অন্ধকার হচ্ছে যাচ্ছে। সবার একটাই ইচ্ছে সন্ধা নামার আগেই পাড়া পৌঁছাতে পারলে পথ অনেকটা এগোবে। আমরা ঠিক ৬টার সময় পাড়ায় পৌঁছাই.আবার গ্রুপের ২/৪জন মেম্বার একটু পেছনে পড়ে যায় তাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অনেকেই  বাড়িতে ফোন দেয়ার চেষ্টা করে। কেউ বা আগুনের পাশে আগুন পোহাচ্ছে, শীত কাল তার উপর পাহাড়। ঠাণ্ডা কেমন সেটা ওই জায়গায় না গেলে আন্দাজ করাও অসম্ভব।

সবাই পাড়ার এসে পৌঁছানোর একটু রেস্ট নিয়ে আবার রওনা হই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাড়ায় পৌঁছাতে হবে। একটা জায়গায় এসে পাহাড়ের একটা অংশ নামতে এতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো সেটা লিখে বোঝানোর মতো না। প্রায় ১০০মিটার পাহাড়ি পথ নামতে আমাদের ২০/২৫ জনের ঘন্টার বেশি সময় লাগে। রাফি ভাই সহ নাহিদ ভাই, জিতু ভাই আরো ২/১জন যারা প্রথমে নামে তারা অপেক্ষা না করে হাঁটা শুরু করে এবং এর মূল কারণ রাতের জন্য রান্না করতে হবে।

দিনেরবেলা যত সব কঠিন ট্রেইল পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলাম সব পাড়ি দিয়ে ফিরতে হচ্ছে। রাত প্রায় ১০:৩০ কি ১১টা, আমাদের পিছনের বেশ কয়েকজন অনেক দূরে পড়ে যায়, তাদের জন্য অপেক্ষা করছি একটা ঝিরির পাশে। প্রকট ঠাণ্ডা, তেমন কারো কাছেই ভারি শীতের জামা নেই। ঠাণ্ডায় জমে যাই যাই অবস্থা সবার। কিছু কাঠ বাঁশ জোগাড় করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এভাবে অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর সিদ্ধান্ত নিলাম বসে না থেকে হাঁটা উচিত। কারণ, যারা পিছনে পড়েছেন তাদের সাথে আমাদের সাকওয়াত ভাই আছেন। কাজেই, চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই। আমরা রওনা দিয়ে দিই আবারও অন্ধকার পথে। আবারো একটু রাস্তা ভুল হয়, পরে আবার সঠিক রাস্তা ধরে এগোনো শুরু করি।

আরো পড়ুন সাজেক ভ্যালী

২৫ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা বলছি, হুট করে আমার মাথায় আসলো আরে আমার বন্ধুর তো জন্মদিন ২৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ আর অল্প কয়েক মিনিট পর। ঠিক ১২টায় বাজতেই দেখি আবির আমার থেকে অনেক দূরে। তার কাছে যেতে যেতে আমার ১২:০৮ মিনিট হয়ে যায়। আমি চিক্কার দিয়ে বলে উঠি শুভ জন্মদিন আবির, তারপর উপস্থিত সবাই এক এক করে সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানায়। যাক, ট্রেইলের গল্পে আসি; হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় পর খুব বেশি বিরক্ত লাগছিলো। কাজেই কারো জন্য অপেক্ষা করে আস্তে হাঁটার মনমানসিকতা হারিয়ে ফেলি। আমরা ২/৩জন মিলে তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করি। যখন প্রায় পাড়ার কাছাকাছি, অপর পাশ থেকে ২/১ লাইট দেখা যাচ্ছে, আমি আমার সাথের মানুষ গুলাকে বলছি এরা কি আমাদের খুঁজতে বের হইলো? একটু পরেই দেখি রাফি ভাই, বিকাশ আর একটা ভাইয়া আমাদের সন্ধানে বেরিয়েছে কারণ আমাদের অনেক দেরি হচ্ছিলো। অতঃপর আমাদের পাড়ায় পৌঁছাতে ১টার বেশি বাজে। ঠান্ডায় পুরা জমে শেষ, রীতিমত কাঁপাকাঁপি চলছে।এদিকে সেই পিছনে ছুটে যাওয়া টিম পাড়ায় আসে প্রায় রাত ২টারও পরে। সেই একটা ঐতিহাসিক রাত ছিলো। যেমন রহস্যময় আন্ধারমানিক বলা হয়েছে ফেরার পথে তার থেকেও বেশি রহস্যময় লাগেছিলো। পরিচিত ট্রেইলই আমরা ভুল করছি। একজনের সাথে তো ভৌতিক কিছু ঘটেছিলো (এটা তার মনের ভুলও হতে পারে)। এরপর খাওয়া দাওয়া শেষ করে এত রাত হওয়ার কাহিনী নিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের আন্ধারমানিক অভিযান শেষ হলো।

পড়ুন নাহিন তুলির আরো লেখা

 

ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।

অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।

 

ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।

আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।