আমি এক যাযাবর গানটি মনযোগ দিয়ে শুনলে এখনও গাঁয়ে কাটা দিয়ে ওঠে। ভূপেন হাজারিকার অনবদ্য পরিবেশনা। প্রতিটি ছত্রে ছত্রে কথাগুলির মধ্যে এক একটি বড় শিক্ষা। দেশভাগের স্বল্পকাল আগে খুলনায় জন্ম নেয়া শিবদাস বন্দোপাধ্যায় এই গানটির গীতিকার ছিলেন যা খুব একটা শোনা যায় না। তাঁর সৃষ্টি ও খ্যাতিমান শিল্পীর গায়কীতে ও সুরের মূর্ছনায় তা অমর কীর্তি হয়ে রইল। গানটি বিবিসির কোনো এক জরিপে বাংলা গানের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলো।
আমাদের পূর্বপুরুষরা যাযাবরই ছিল। এখনও আদিবাসীদের জীবন প্রনালী নিয়ে পড়তে গেলে দেখা যাবে, যেমন জুমচাষী পাহাড়ী সমাজ, বা অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী, মরু আরবের বেদুইন বা ভারতীয় বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠীর কথায় বলা যাকনা কেন। কিছুদিন আগে আমাদের বেদে সম্প্রদায়কে নিয়ে গবেষনা করে কেউ একটা বই লিখেছে শুনেছি। আমি ইউরোপের রোমা বা জিপসি সম্প্রদায়ের রঙবেরং এক ধরনের বিশেষ পোশাক ও সুরেলা লোক গানের সাথে নৃত্য দেখেছিলাম রোমানিয়ার বুখারেস্টে। এসব পুরোনো দিনের মানুষদের দেখলে একটা কমন বিষয় হচ্ছে ওরা তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও অনেক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অধিকারী হয় এই যাযাবর জীবনযাপনের মাধ্যমে।
স্টীভ জবস বলতেন আমার নতুন ধারনাগুলি এসেছে কিছু দেখে, কারুর সাথে আলোচনা করে, কথা বলে বা প্রশ্ন করে। সর্বোপরি শিখতে হলে অফিসের বাইরে বেরুতেই হবে। চাইলেই তাতো আর সব সময় করা যায় না। অনেক চাকুরীতে হয়ত বিভিন্ন জায়গায় যাওযা বাধ্যতামূলক। যেমন যারা সমুদ্রগামী জাহাজে কাজ করেন, বা যারা বিমানযাত্রীদের সেবাদানের সাথে যুক্ত। আরো অনেক এরকম কাজ আছে। যারা গবেষক বা একাডেমিক তাদেরও এ সুযোগটি থাকে। রথ দেখা ও কলা বেচা এক সাথে করতে পারলে বেশ হয়।
আমারও তাই হোল কিছুটা। কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করার কারনে রেল যাত্রা, ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র উপকূল ধরে প্রায় তটরেখার সাথে লাগানো রেললাইন। বিপুল প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশি দেখতে দেখতে যাওয়া। এই উপকূলে একসময় ইউরোপীয় এক্সপ্লোরারগন, যারা জীবন হাতে করে সমুদ্র অভিযাত্রায় বেরিয়েছিলো সেই চৌদ্দ বা পনেরশ শতাব্দীতে, প্রথম তারা আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের সাক্ষাৎ পায়। একটি একটি অভিযাত্রিক দলে কত রকমের মানুষ যে থাকতো। আমি এই মূহুর্তে একজন বিমান যাত্রী হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরে আকাশে প্রায় বারো কিলোমিটার উপর থেকে সবার সাথে প্রতি মূহুর্তে যোগাযোগ করতে পারছি। একটু পর পর বিভিন্ন চয়েসের খাবার পাচ্ছি।
তখন শুধুমাত্র কম্পাস আর আকাশের তারা মন্ডলী নাবিকদের পথ চলতে সাহায্য করতো। লবন দিয়ে শুকোনো মাংস, আর যেসব খাবার শুকনো রাখা যেত তাই সংগে নিত যাতে নস্ট না হয়ে যায়, বা খেয়ে যেন পাল তোলা জাহাজের মানুষেরা অসুস্থ না হয়ে পড়ে। ভিটামিন সি এর অভাবে স্কার্ভি রোগ, চর্মরোগ, কোনো আঘাত পেলে ঘাঁ হয়ে গ্যাংগ্রীনে রুপ নিতো। রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যেতো। বৈদ্য বড় একটা বড় করাত রাখতো শৈল্য চিকিৎসার জন্য। কিছু হলে কাটো ও ফেলে দাও। এভাবেই যে সংখ্যা নিয়ে প্রথমে রওনা দিতো, উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের নিয়তিতে সলিল সমাধি ঘটতো গভীর সাগরের বক্ষে। প্রাতকার্য্য সারতো সরাসরি সাগরের পানিতে, টিস্যু বলিয়া কিছু পদার্থের অস্তিত্ব অকল্পনীয় থাকিবারই কথা। একটি দড়ির আগার গোছা সবাই পশ্চাদদেশ যতটা পরিছ্ন্ন করা সম্ভব, তাই করতো। একটারই গন ব্যবহার।
যাহোক একবার সমুদ্রে গেলে কতদিন কি হবে, কবে ডাঙা পাবে বা আদৌ পাবে কিনা, কতজন বাঁচবে তা যে কি অনিশ্চিত ছিল তা সবারই অননুমেয় হওয়ার কথা নয়। তবুও মানুষের অদম্য সাহসিকতার কাছে, বুদ্ধি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে এই গত দুই তিন দশকেই কতটা নিয়ন্ত্রন করছে তা আমরাই দেখলাম। অনেক কিছু হয়ত পারেওনি। আমরা কত অভিযোগ আর হতাশা নিয়ে তালিকা তৈরি করি অনবরত এখন, আগের মানুষদের জিপিএস ছাড়া চলাফেরার কথা চিন্তা করলেও আমরা এই অনুযোগ কমাতে পারি।
রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। ঠান্ডায় মনে হচ্ছে হাতের আংগুলগুলি বরফের মত শ্ক্ত হয়ে গেছে। বের যখন হয়ে গেছি পদচালনা শুরু করলাম। আমাকে দেখলে কেউ ভেগাবন্ড বা হোমলেস বা পাগল টাগল ভাবাটা আশ্চর্য কিছু নয়। না হলে কোন সুস্থ মানুষ প্রায় শুন্যের নীচে তাপমাত্রায় রাস্তায় পদব্রজে ঘুরে বেড়াবে না।
হোটেলের পাশে একটি বীচ গাছ তার সব পত্রাদি বিসর্জন দিয়ে মনে হয় নিরাভরনে পাশের লেকের জলে নিজের আকার দেখছে। ঠান্ডা হলেও হালকা মিষ্টি রোদ এখনও চারদিক আলো করে রেখেছে দুর দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে। এই রোদটুকুর আলো সুকান্তের প্রার্থী কবিতার উত্তাপের মত মনে হচ্ছে আমার নিকট। চারিপাশ বেশ ফাঁকা হওয়ায় খুব সুন্দর একটা প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপহার দিচ্ছে। একটু অগোছালো এলাকাটি হলেও তবুও কিন্তু বাগান মালিদের কৃত্তিম যত্নের ছোঁয়াটিকে যেন লুকোতে পারছে না।

রাস্তা পার হতেই বিবর্ন জংগল। বার্চ, বীচসহ সব পত্রমোচী বৃক্ষের বন। আন্ডারগ্রোথ থাকলেও শুকিয়ে হলুদ রং ধারন করেছে। এরকম প্রায় মৃত ল্যান্ডস্কেপ দেখতাম ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও নিউজিল্যান্ডের রোটারোয়ায় শীতকালে। একবার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় এনার্জি ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে একটা সেমিনার দিতে গিয়েছিলাম কার্বন নি:সরন হিসাবের পদ্ধতির উপর। মাইনাস ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। সারা ক্যাম্পাসে অনেক গাছপালা থাকলেও, পুরু বরফের আস্তরনে ঢাকা এরকম বিবর্নই ছিল সব।
অল্প কিছু পাইন গাছ ফাঁকে ফাঁকে ঘন সবুজ সুচের মত পাতা তার মাথায় ধরে রাখতে পেরেছে। এই পাইনগুলি চিরসবুজ। এই বনই ঘন সবুজ রঙ ও রুপ ধারন করবে সিজন চেন্জ হলেই। কিছু ছোট ছোট চড়ুই পাখির মত কিচিরমিচির করছে। একটি পাখি মরে পড়ে রয়েছে, বেচারীর এই পৃথিবী নামক গ্রহটিতে মানুষ নামের প্রানীদের জন্তুর চেয়েও জঘন্যতম সব অনাচারের দৃশ্য আর অবলোকন করতে হবে না। এখানকার রাস্তার নামগুলি নাম্বার দেয়া। সিক্সটি নাইনথ এভিনিউ ক্রস করলাম। একটা নতুন বাড়ী তৈরি হচ্ছে। তার খট খট আওয়াজ, বিল্ডিং নির্মান শ্রমিকরা শব্দ করে লোহার পেরেক মারছে। বাড়ীগুলির কাঠামো কাঠ দিয়ে তৈরি।
না জেনে অসংলগ্নভাবে যতক্ষন যাওয়া যায়। এর পরের ব্লকটিতে বাড়ীঘর তৈরি হয়েছে। জংগলের ভিতর একটা বাড়ীর সামনে দামী ফারারী গাড়ি পার্ক করা। হলিউড মুভি শুটিং প্লেসের মত। জংগলের ভাব রেখে এমনভাবে ঘরগুলি নির্মান করা হয়েছে মনে হচ্ছে বাড়ীর চারপাশে জংগলের বনস্পতি ছাড়া আর কিছু নেই। এই গ্রামের মাঝ দিয়ে বেশ কয়েকটি সরু খালের মত বয়ে চলেছে। একটি ছোট নদীর মত কিন্তু সরু। সব জায়গায় ক্যাম্পেন চলছে নো ইন্ডাস্ট্রালাইযেশন। এটার নাম নিমবি সিনড্রোম, কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে দেবে না গ্রামের বাসিন্দারা, নট ইন মাই ব্যাকইয়ার্ড। ভোটের একটা ক্যামপেন ব্যানার দেখে মনে হোল সেই কারনে। কেউই যদি ইন্ডাস্ট্রি না করতে দেয় তাহলে প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো তৈরি হবে কোথায়?
বাড়ীগুলি ছবির মতো বেশ বৃহৎ প্রাসাদপোম। লেখকদের জন্য আইডিয়াল স্পট। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ী চলছে। কিছুক্ষন ঘুরতে ঘুরতে দেখি লোকেরা অফিস শেষ করে বাড়ী ফিরছে। একটি বয়স্ক পরিবার অন্যদিক থেকে হেটে আসছে। বেশ নতুন সুন্দর বাড়িগুলিতে জাতীয় পতাকা স্ট্যান্ডের মাথায় উড়ছে। একজন মালিক বাড়ীতে ঢোকার সময় আমার দিকে ইশারায় শুভেচ্ছা জানালো। মনে করেছে আমি এখানকার স্থানীয়। এত বড় বড় এক একটি বাড়িতে মনে হচ্ছে না খুব বেশী মানুষের বসবাস।
আমি যেখানে হাটছিলাম সেই রাস্তার ওপাশে একটি কমিউনিটি পার্ক। বিভিন্ন ধরনের খেলার মাঠ, গ্রাম হলেও একটি এলাকার জন্য যা যা থাকা দরকার সব রয়েছে। আরেকদিকে একটি মিডল স্কুল। আমি জানিনা কোনদিকে যেতে হবে। ম্যাপ দেখিনি। গুগল ম্যাপে আমার হোটলের দিকে একটি ট্রেইল মতো গিয়েছে অন্য ম্যাপে তা দেখাচ্ছে না। আমি প্রায় ছয় কিলোমিটার হেঁটেছি। কোন কারনে যদি কানেকশন না থাকে আমাকে আবার ঘুরে যেতে হবে কারন একটি লেক আমার হোটেলের আর এই এলাকাটিকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
এক মহিলা রাবিশ বিন দিতে রাস্তায় আসছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ পাশে লেক ক্রস করে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা। সে বলল নতুন সেও তেমন জানে না তবে থাকতে পারে। যাহোক যা হয় হবে ভেবে যাওয়া শুরু করলাম। তারপর সরু পথ পেলাম একটা আমার দিকে আসার।
এভাবেই আমার ইলোরার থেকে রঙ না নিয়েই শিকাগো শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দুরে বার রিজ ও প্লিজ্যান্ট ডেল গ্রামের সাথে পরিচয় হলো। পরে শুনলাম বাংগালী বন্ধুর কাছে এখানের এক একটি বাড়ীর মূল্য দেড় দুই মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। শিকাগো শহরে খুব বেশী না হলেও ঠান্ডার মধ্যে হুইল চেয়ারে বসে দু একজনকে সাহায্য চেয়ে ভিক্ষা করতে দেখেছি। আবার মনে পড়ল গানের কথাগুলি
“…. আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি তার ছায়াতেই দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী….” আর এ তো সত্যিই
“…আবার দেখেছি না ফোটা ফুলের কলিরা, ঝরে গেছে অনাদরে।
প্রেমহীন ভালোবাসা দেশে দেশে ভেঙ্গেছে সুখের ঘর।….”
Post Views: 129