হিমাচলের স্পিতি ভ্যালিতে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম বাইশের জুলাইয়ে। আমি ঠিক ভ্রমণপিপাসু কিংবা পর্যটক নই, তবে ছবি তুলতে গেলে এগুলো একসাথে যুক্ত হয়ে যায় অটোমেটিক। মাঝে মাঝে মনে হয় ক্যামেরা সৃষ্টির আগে যদি জন্মাতাম তাহলে কী করতাম! তখন নির্ঘাত কবি হতাম। আমার পছন্দের কবি কালিদাস। কেননা আমার মেঘ ভীষণ ভাল লাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসে মেঘদূত পড়ার সুযোগ মিললেও আশৈশব মেঘমুগ্ধ লোক আমি। এবার না হয় আরেক মুগ্ধতার কথা শোনাই- সেদিনও আকাশে মেঘ ছিল, যদিও স্পিতি গিয়েছি বরফ (স্নো) দেখতে। জুলাইয়ে স্নো খুব একটা দেখা যায় না, দুরের পাহাড়ে কখনো গ্লেসিয়ার কখনোবা হালকা স্নোর প্রলেপ। আমাদের সেদিনের গন্তব্য ছিল পিন ভ্যালি। আমাদের থাকার হোটেল ছিল কাজা শহরে, যেটাকে স্পিতির হেড কোয়ার্টার বলে। আর ওখান থেকে পিন ভ্যালির দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। বরাবরের মত পাহাড় আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আমাদের গাড়ি ছুটছিল আঁকাবাঁকা পথ ধরে। পথিমধ্যে কুংরি মনেস্ট্রিতে আমরা বিরতি দেবার জন্য যেতেই দেখতে পেলাম ওখানে বড় কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লুফে নিলাম ক্যামেরায়, কেননা আমার শখের বিষয় ট্রাভেল ফটোগ্রাফি। ট্রাভেল ফটোগ্রাফির অন্যতম অংশ কোন নির্দিষ্ট স্থানের কালচারকে ধারণ করা।

কুংরি থেকে আমরা গেলাম পিনভ্যালির একটি গ্রামে যার নাম- মুদ্। গ্রামের নাম এত ছোট নাম হয়! বাংলাদেশ হলে এটার নাম হত- মুদপুর, মুদনগর ইত্যাদি। ছোট্ট একটি নাম, অথচ কী মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। প্রথম অবস্থায় খুব আহামরি ভাল লাগছিল না। কিন্তু ওখানে আমাদের দুপুরের খাবার অর্ডার করে হোটেলের খোলা লবিতে বসে আছি। মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি। চারদিক আস্তে আস্তে তাকাতে আরম্ভ করি আর তখনি বোধ করলাম ফটোগ্রাফার হয়ে খুব ভাল কিছু করি নি। তাড়াহুড়ো ক্লিক আর মোমেন্ট ক্যাপচার এসবের বাইরেও সৌন্দর্য উপলব্ধির একটা বিষয় আছে, যার নাম অখণ্ড অবসর। জীবনানন্দের সেই ‘অবসরের গান’ কবিতার কথা মনে পড়ল। হাত পা ছেড়ে কিছুক্ষণ চোখ মুদে ছিলাম মুদ্ গ্রামে। আস্তে আস্তে আলো বাতাস আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত ছুঁয়ে গেল। ক্যামেরা নিয়ে সামান্য এদিক সেদিক করতে কিছু ছবি তুলতে পারলাম। বৃষ্টি বাতাস আরো খানিকটা ছুঁতেই দেখলাম কর্মজীবী মানুষজন উপত্যকার জমিনে কাজ করছে, সব সবুজ মটরশুটির গাছ। কেউ কেউ উপরে উঠে আসছে পিঠ ভর্তি ফসল নিয়ে। এরমধ্যে এক পিতা/পিতামহকে দেখলাম পিঠে ছোট্ট এক শিশুকে নিচ থেকে উঠে আসছে। চেহারাটা তার জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোশোয়ার মত। চোখে সানগ্লাস, পরনে জীর্ণাবরণ। স্পিতি ভ্যালিতে রোদের তীব্রতা থাকে বলে সব কর্মজীবীই দিনের বেলায় সানগ্লাস পরে থাকে।

মুদ ভিলেজ থেকে দেখা পিন ভ্যালির সবচেয়ে সুন্দর ভিউ।
স্পিতিতে সবচেয়ে বেশি সবুজের আধিক্য দেখা যায় এই পিন ভ্যালিতে। এখানে একটি ন্যাশনাল পার্ক আছে, তবে পার্ক বলতে আমরা যেরকম বাউন্ডারি দেয়া রিজার্ভ এরিয়া বুঝি এটা সেরকম নয়। বেশ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে এর বিস্তৃতি, এর ভেতর অনেকগুলো মানব বসতির গ্রামও আছে। আমাদের গন্তব্য পিন ভ্যালির শেষ প্রান্ত মুদ্ ভিলেজ, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা সাড়ে বারো হাজার ফিট উপরে। হিমালয় পর্বতমালা বেষ্টিত অপূর্ব এক গ্রাম। সবুজ মটরশুটির বিস্তৃর্ণ মাঠের রঙ আমাদের দেশের সবুজের থেকে আলাদা; এটা হলদে সবুজ। হিমালয়ের রুক্ষ এ জনপদে বৃষ্টিপাত হয় নিয়মিত। অন্যদিকে পাহাড়ে জমা বরফ গলে গলে শীতল জলস্রোত সৃষ্টি করেছে পাহাড়ি নদী। স্পিতি কিংবা পিন ভ্যালি দুটোরই নাম হয়েছে নদী থেকে। মুদ্ ভিলেজের পাশেই বয়ে গেছে পিন নদী। গ্রীষ্মে হালকা জলস্রোত মনে হলেও এটা কিন্তু খরস্রোতা। মুদ্ ভিলেজের যেকোন গেস্ট হাউজ বা রেস্টুরেন্টে বসলেই উপত্যকা বেষ্টিত আঁকাবাকা পিন নদীকে দেখা যায়। আর সামান্য দূরে, চূড়ায় বরফ লাগা যে পাহাড়টি দেখা যায় এটিকে বলে পিন পার্বতী পাহাড়, এটাতে অনেকে ট্রেক করতে যায় পিন নদী পার হয়ে। স্পিতি ভ্যালিতে নিয়ে যাবার পথ প্রদর্শক কলকাতার আলোকচিত্রী আশিস শূর। উনার কাছে হাতে কলমে ল্যান্ডস্কেপ শিখতে গিয়ে জানলাম, ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে নদী বেষ্টিত ভ্যালি বা উপত্যকা। সে হিসেবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্পট এটাই।

পিন ভ্যালির হলদে সবুজ সবক্ষেত্রে কৃষক-কৃষাণিরা মটরশুটি তুলছিল।
সামান্য একটা দুপুর, বড়জোর দু’ঘণ্টা; এর ভেতর অল্প বৃষ্টিপাত, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, কয়েকজন মানুষের মুখচ্ছবি এর বেশি মনে পড়ার কিছু নেই মুদকে ঘিরে। প্রকৃতির কত রঙ- ভোর কিংবা শেষ বিকেলের কমলা রোদ; পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যার নক্ষত্রখচিত রাত, তুষারে ঢেকে যাওয়া মুদের জনপদ কিছুই দেখা হল না। তবু একেকবার ভাবতে বসলে কল্পনায় আমি যেন সব দেখি- মুদের রাস্তা, মঙ্গোলয়েড মুখাবয়ব, পার্বতী পাহাড়ের বরফ ঢাকা চূড়া, তুষার শুভ্র জনপদে জ্যোৎস্নার শিহরিত প্রতিফলন!