এর আগের এক লেখায় সিডনির ক্যাসিনোতে আমার এক রাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলাম। এবার বলব পৃথিবীর আরেক প্রান্তে নীলনদের ফিফথ গ্রেইড র‍্যাপিড স্রোতে হোয়াইট ওয়াটার এক্সট্রিম র‍্যাফটিং এ নাকানি চুবানি খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা।

আমার উচ্চতা ভীতি বা পানি ভীতি কোনটাই নেই। আছে শুধু বউ ভীতি। কারণ যেকোন জায়গায় বাঞ্জি দেখলেই আমি জাম্প করতে যাই, আর প্রথমবার এটা দেখে তার প্রায় একটা প্যানিক এটাক হয়ে গিয়েছিল। কাজেই বউকে দেখিয়ে শুনিয়ে একাজ করা বিলকুল বন্ধ। একা ট্রিপে গেলে শুধু এইসব করার সুযোগ থাকে। লোকজন বউকে লুকিয়ে গোপনে দুষ্ট কাজ করে আর আমি না জানিয়ে গোপনে র‍্যাফটিং, বাঞ্জি, স্কুবা,প্যারাগ্লাইডিং এইসব হাবিজাবি করি।

নাইল রিভারে বিভিন্ন রকম র‍্যাফটিং আছে। র‍্যাফটিং মানে একটা ৬-৮ জন মানুষ ধারনক্ষমতা সম্পন্ন ছোট রবারের বোট দাঁড় বেয়ে স্রোতের অনুকূলে ২৫-৩০ কিলোমিটার যাওয়া। ব্যাপারটা খুব কঠিন না। কিন্তু নদীর বিভিন্ন খরস্রোতা জায়গা আছে, সাথে আছে প্রচন্ড ঢেউ। প্রায় ছোটখাটো জলপ্রপাতের মত খাড়া ঢাল বেয়ে এই ছোট বোট নিয়ে নামা একইসাথে চ্যালেঞ্জিং এবং রোমাঞ্চকর। প্রায়ই বোট ফ্লিপ করে বা উলটে যায়। অভিযাত্রী ছয়জন ছয়দিকে ছিটকে পড়ে। লাইফ জ্যাকেট থাকায় সাধারণত কেউ একেবারে ডুবে যায়না,তবে কিছুক্ষণ নাকানিচুবানি খেয়ে স্রোতে ভেসে একজন একেকদিকে চলে যায়। নিজেরা বোটে ফিরতে না পারলে রেসকিউ টিম এসে উদ্ধার করে। কাজেই রোমাঞ্চ পিপাসু অভিযাত্রীদের জন্য র‍্যাফটিং এর আসল মজাই হচ্ছে বোট ব্যালেন্স হারিয়ে উলটে যাওয়ায়।

তাই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং দীর্ঘ এই নদীর তীরে এসে তরী না ডুবিয়ে আমি অধম চলে যাব, এটা ভাবাও ঠিক হবে না। খবর নিলাম উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা থেকে চার ঘন্টা ড্রাইভ করে জিনজা শহর যেখানে নীলনদের উৎপত্তিস্থল, সেখানেই র‍্যাফটিং এর ভালো ব্যবস্থা আছে।

উগান্ডার বন্ধু নালুসুয়াকে ফোন দিলাম। সে ওইদিকেই কোথাও সরকারের বেশ উঁচু পদে ছিল শুনেছি। ফোন দিয়ে শুনি তেলেসমাতি কারবার। নালুসুয়া এখন বেশ কিছুদিন এর জন্য নাকি খোদ জিনজাতেই আছে। তাকে বলতেই বরাবরের মতো উত্তর এলো- ‘রোসো বন্ধু,তোমার র‍্যাফটিং বাঞ্জি সবকিছুই ব্যবস্থা হবে। কিন্তু কথা দিতে হবে যে আমার এখানে দুদিন থেকে আমার বাসায় দুটো ‘মাছ ইগালি’ (মাছ ভাত এর উগান্ডান ভার্সন) খেয়ে তারপর যাবে।আর কি লাগবে বলো?’ জানা ছিল হাফ ডে র‍্যাফটিংএ ছয় লক্ষ উগান্ডান শিলিং বা প্রায় দেড়শ ইউ এস ডলার চার্জ আসে। নালুসুয়াকে বললাম কিচ্ছু লাগবে না, শুধু ভালো একটা সার্টিফায়েড র‍্যাফটিং এজেন্ট খুঁজে দাও।

যাইহোক,পরদিন পাঁচ ঘন্টার র‍্যাফটিং শুরু হল সকাল নয়টায়। অন্যান্যদের সাথে এক বৃদ্ধ আমেরিকান দম্পতিও ছিল যারা কলোরাডো ‘রকি মাউন্টেইন হাই’ থেকে এসেছে। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে বুঝলাম ইনি প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র তার বউ যে কিনা আবার ইউ এস আর্মির রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন তার ঠ্যালায় পড়ে র‍্যাফটিং এর অত্যাচার সইতে এসেছেন। বুড়া হাড়ে আজ এই জিনিস সইবে নাকি তা নিয়ে তিনি যথেষ্ট সন্দিহান।তার বউকে দেখলাম এই বয়সেও সাংঘাতিক ফিট আর সাহসী।

র‍্যাফটিং শুরু হল বেশ আনন্দঘন পরিবেশে। শান্ত পানিতে স্রোতের অনুকূলে ভেসে যেতে যেতে আমি আপনমনে গান ধরলাম- ‘মাঝি বাইয়া যাওরে’। একটু পরেই পেলাম ফোর্থ গ্রেড র‍্যাপিড-শুরু হল ভয়াবহ ঢেউ আর স্রোত। র‍্যাফট চলতে শুরু করল তীরের বেগে। সাথে রোলিং পিচিং, আমার গান অটোমেটিক চেঞ্জ হয়ে গেল- ‘আমায় ভাসাইলিরে,আমায় ডুবাইলিরে’… কলোরাডোর মামা বলে এই গানের অর্থ কি? আমি বললাম ‘নদীতে ডুইবা গেলে এই বয়সে আবার তুমি ভাসতে পারবা কিনা এই বিষয়ক আধ্যাত্মিক গান।’ সে চোখ বড় করে বলে- ‘ইউ নটি ম্যান। প্রে টু গড।অনলি হি ক্যান সেভ আস’।

এযাত্রা হাল্কা চুবানি খেয়ে পার হয়ে এলেও বোট পুরোপুরি উল্টে গেল ফিফথ গ্রেড র‍্যাপিডে। একেকজন একেকদিকে ছিটকে পড়লেও এবার সবচে বেকায়দায় পড়লাম আমি নিজেই। বোটের দড়ি ধরে রাখায় আমি পড়লাম সরাসরি উলটানো বোটের নিচে। কয়েক সেকেন্ড দেখি অন্ধকার, মাথা উঠাতে পারছি না কারণ ভারি কিছুতে মাথা আটকে যাচ্ছে। পরে বুঝলাম আমার মাথার উপর আস্ত বোট। আতংকিত না হয়ে ট্রেনিং অনুযায়ী একটু আগেপিছে করে বোটের ফাঁকা জায়গায় মাথা নিলাম। দেখলাম এবার নিঃশ্বাস নেয়া যাচ্ছে। তারপর কায়দামত ভুস করে বের হয়ে এলাম বোটচাপা অবস্থা থেকে।

রেস্কিউ টিম দেখি খুব একটিভ। আমাকে ঠিকই স্পট করেছে। আমাকে বলে- আর ইউ ওকে? আমি বললাম হোয়্যার ইজ ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দি সি’ ফ্রম কলোরাডো? ওরা একগাল হেসে বলল লুক আপ প্লিজ। হি ইজ অন টপ অফ দ্য বোট। সত্যিই দেখি মামাকে উল্টানো বোটের ওপরে বসিয়ে রেস্কিউ টিমের একজন শক্ত করে ধরে রেখেছে। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে এক বালতি চিরতার রস খেয়েছে কেবলই। যমের সাথে টানাটানি ভালোই হয়েছে। বাকিরা বিভিন্ন রেস্কিউ কায়াক ধরে ভেসে আছে। নাহ, রেস্কিউ টিম আসলেই তাদের কাজ জানে। অল্প সময়েই সবাইকে একেবারে লাইনে নিয়ে এসেছে।

এই ফ্লিপ ছাড়া বাকি সময় নীলনদের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে দাঁড় বেয়ে বেশ ভালো সময় কাটলো। যারা র‍্যাফটিং ভালোবাসেন তারা নিশ্চিন্তে এই রুটটা বেছে নিতে পারেন। এখানে অনেক বছর কোন ফেটাল এক্সিডেন্ট হয়ে কেউ মারা যায়নি। শুধু একটা সিক্স ডিগ্রি র‍্যাপিডে একা র‍্যাফটিং করতে গিয়ে নেদারল্যান্ডস এর এক র‍্যাফটার মারা গিয়েছিল,তাও বেশ আগে।এখন ওই র‍্যাপিডের নাম দেয়া হয়েছে ‘ডাচম্যান’। তো যদি মরেও যান, অসুবিধা নাই। আপনার নামে নীলনদের একটা র‍্যাপিড ফলের নাম হবে।

হ্যাপি র‍্যাফটিং!

পুনশ্চঃ বরাবরের মত আফ্রিকার বন্ধু নালুসুয়ার রেফারেন্সে যাওয়ায় এজেন্ট আমার কাছ থেকে ফি নিতে সম্পুর্ন অসবীকৃতি জানায়। আমার কাছে সন্দেহ হয় যে নিশ্চয়ই এরমধ্যে ঝামেলা আছে। জানি নালুসুয়া তার পিএ বা গানম্যানের মাধ্যমে আমার ফি বাবদ কিছু টাকা অবশ্যই পাঠিয়েছে এজেন্টের জন্য। কিন্তু সে টাকা পিএ ড্রাইভার গানম্যান সবার ভাগ বাটোয়ারা হয়ে আদৌ এর হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে এটা অন্যেরা বিশ্বাস করলেও আমি ঠিক করতে পারছিলাম না। কাজেই ওকে বললাম ঠিক আছে ফি নাহয় নিবে না, কিন্তু তোমার লোকেদের টিপস তো দিতেই পারি। তুমি দেড়শ ডলার বরং টিপস হিসেবেই রাখো। নালুসুয়াকে ওটাই বলো যে আমার ফি ও দিয়েছে আর আমি দিলাম টিপস। ফ্রি জিনিস আমার ধাতে সয় না। বরাবরই বদহজম হয়। তবে আফ্রিকায় নালুসুয়ার মত বন্ধু থাকা রীতিমতো এক আশীর্বাদ।