খুব ছোট মালালা (Mallala) শহর। এর অবস্হান দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের রাজধানী এডিলেড থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অর্থাৎ বারোসা ভ্যালির (Barossa Valley) উত্তর-পশ্চিমে। এটি কৌর্না (Kaurna) আদিবাসীদের এলাকা। অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাসবিদ জিওফ্রে হেডন ম্যানিং (Geoffrey Haydon Manning) এর মতে কৌর্না ভাষায় মদলালা (Madlala) থেকেই মালালা শহরের নামকরণ করা হয়েছে। মদলালা মানে স্থলচর ব্যাঙের এলাকা।
মালালা শহর কৃষি নির্ভর। ১৮৫১ সালে ফিলিপ বাটলার এখানে প্রথম জমি গ্রহণ করেন। সে সময় প্রতি একর জমি এক পাউন্ডে বিক্রি হতো। বাটলারের সম্পত্তিকে ‘মালালা স্টেশন’ বলা হত। মালালা স্টেশনকে ঘিরে এর আশেপাশে মালালা শহর গড়ে ওঠে। মূলত অস্ট্রেলিয়াতে রাঞ্চ (গরু এবং ভেড়া পালা হয়) স্টেশন নামে পরিচিত।
আগেই বলেছি মালালা খুব ছোট শহর। গাড়িতে ৫ মিনিটে শহরের সব রাস্তা ২ বার করে ঘোরা যাবে। মালালা শহরের শেষ প্রান্তে অবস্থান এখানকার একমাত্র ক্যাম্প গ্রাউন্ডের। শহরের কেন্দ্র থেকে ৭টি রাস্তা শহরের বাইরের দিকে চলে গিয়েছে। এদের মধ্যে ওয়েসলি রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গেলেই ক্যাম্প গ্রাউন্ড, খুঁজে পেতে কোনো কষ্টই হবে না। ক্যাম্প গ্রাউন্ডের পাশেই রয়েছে বিশাল ওভাল।
লম্বা দূরত্বে ভ্রমণের সময় মালালা ক্যাম্প গ্রাউন্ডটি যাত্রা বিরতির জন্য বেশ উপযুক্ত। বিশেষ করে তাদের জন্য যারা ভিক্টোরিয়া এবং মাউন্ট গ্যামবিয়ারের দিক থেকে উত্তরে এলিস স্প্রিংস বা পশ্চিমে পার্থের দিকে যাচ্ছেন। অনেকেই এডিলেড শহরের ট্রাফিক এড়াতে চান তাদের জন্য বেশ উপযুক্ত। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমরা বেশ কয়েকবার এডিলেড এসেছি বলে এবারের ১৬ দিনের রোড ট্রিপে এলিস স্প্রিংস যাবার পথে এক রাতের জন্য ক্যাম্প গ্রাউন্ডটি বেছে নিয়েছিলাম।
ক্যাম্প গ্রাউন্ডে ২০টিরও বেশি স্বতন্ত্র নন-পাওয়ারড ক্যাম্পসাইট, ১৩টি নন-পাওয়ারড ক্যারাভান এবং ক্যাম্পার ট্রেলার সাইট, ৪টি আরভি আনপাওয়ারড সাইট এবং ৩টি তাঁবুর সাইট রয়েছে। এখানে রান্নার জন্য কোনো চুলা না থাকলেও রয়েছে বারবিকিউ সুবিধা, মাইক্রোওয়েভ, গরম পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি। বাথরুমে আছে কয়েন চালিত ঝরনা এবং কয়েন লন্ড্রি ইত্যাদি। প্রতি দিনের জন্য মাত্র কয়েকটি অস্ট্রেলিয়ান গোল্ড কয়েন দিয়ে এখানে সাইট বুক করা যায়। লায়ন্স ক্লাব এই সাইট ব্যাবস্থাপনার দায়িত্বে আছে।
আরো পড়ুন গার্লস ডে আউট
আরো পড়ুন লাল পাহাড়ের পথে
আমরা যখন মালালা পৌঁছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো। আমাদের পরিকল্পনা ছিল গাড়িতে পেট্রোল নিয়ে শহরটা হেঁটে বেড়াবো তারপর ক্যাম্পসাইটে যাবো। কিন্তু মারি ব্রিজ (Murray Bridge) থেকে বারোসা ভ্যালি হয়ে মালালা পৌঁছাতেই সূর্য ডুবে গেলো। মেলবোর্নের সাথে সাউথ অস্ট্রেলিয়াতে ৩০মিনিটের সময় ব্যাবধান সেটাও মাথায় ছিল না। যাত্রা পথে বারোসা ভ্যালির ফার্ম এলাকার রাস্তায় অনেক পোকামাকড়ের সাথে সংঘর্ষে গাড়ির কাঁচ এতো নোংরা হয়েছিল যে ভালো দেখা যাচ্ছিলো না। কাজেই, গাড়িতে পেট্রোল ভর্তি করে আগামী সকালের কথা মাথায় রেখে আরজু গাড়ির কাঁচ ঘষে ঘষে ধুয়ে ঝকেঝকে করে তুললো। আমরা শহরটাকে কয়েক চক্কর দিয়ে থামলাম ক্যাম্পসাইটে।
রাতের বেলায় ক্যাম্প সেটআপ করার কাজটা সহজ না। তবে পাশের ওভালে লাইট জ্বালানো ছিল বলে পুরো এলাকা আলোকিত হয়ে ছিল। আমাদের সাইটের আসেপাশের বেশ কয়েকটি সাইটে ক্যাম্প সেটআপ করা ছিল। লোকজন এদিক ওদিক যাচ্ছে, কেউ বারবিকিউ করেছে বা খাবারের আয়োজন করছেন। আমি আর আরজু মিলে ৫ মিনিটেই ক্যাম্প সেটআপ করে সেলফ ইনফ্লাটেবল ম্যাট্রেস বিছিয়ে নিলাম। বিপত্তি বাধলো টেন্টের পেগ (লোহার খুঁটি) পোঁতা নিয়ে। মজার ব্যাপার হলো আমাদের সাথে হাতুড়িও ছিল কিন্তু মাটি এতটাই শক্ত ছিল যে আমরা গলদঘর্ম হয়ে গেলাম। যাই হোক, স্থানীয় আবহাওয়া চেক করে দেখলাম বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ৫ কিলোমিটার। আরজু হাতুড়ি পিটিয়ে চেষ্টা করেই যাচ্ছিলো। বুঝিয়ে শান্ত করলাম যে এক রাতের ব্যাপার, বাতাসে টেন্ট উড়ে যাবে না। যাই হোক, সকালে টেন্ট গুটাতে গিয়ে আসল ঘটনা টের পেলাম। আসলে এখানে মাটি ছিল না, কংক্রিটের উপর পাথুড়ে বালু বিছানো ছিল। অনর্থক কয়েকটা পেগ বাঁকা হলো।
আরো পড়ুন স্মৃতিবিজড়িত নীল শহর
চটজলদি ক্যাম্প গুছিয়ে চলে এলাম ক্যাম্প কিচেনে। এর মধ্যে মোটামুটি সবার ডিনার শেষ। প্রথম দিনের জন্য বাড়ি থেকে বয়ে আনা খাবার গরম করে বসে পরলাম। পাশের টেবিলে দুই তরুণী খাবার শেষ করে বসেছিল। আলাপে জানলাম ওরা আমাদের টেন্টর প্রায় গায়ে লাগানো টেন্টটা ওদের। ওরা দুই বান্ধবী এসেছে ফ্রান্স থেকে। তিনমাস আগে অস্ট্রেলিয়াতে এসেছে, এডিলেড থেকে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসেছে মাস হলো। ওরা দুজনে একটা আলুর ফার্মে কাজ করে আর সপ্তাহে ২/৩ দিন আসেপাশে ঘুরে বেড়ায়। মাইক্রোওভেনের পাশেই একটা বড় কাগজের চারকোনা বাক্স রাখা ছিল। ওটা দেখিয়ে বললো, এগুলো আমাদের ফার্মের আলু। তোমরা চাইলে যত ইচ্ছা নিয়ে পারো। আলুতে কোনো আগ্রহ না থাকলেও দুই তরুণীকে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিয়ে আমরা খাওয়ায় মন দিলাম।
আমাদের আগামী কালকের গন্তব্য কুবার পেডি, এখান থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পথ। আজ সারাদিন যেহেতু গাড়িতেই ছিলাম তাই একটু ক্লান্ত। তাছাডা, অনেক সকালে উঠে গাড়ি গোছাতে হয়েছে। পরদিন সকালে উঠেই রওনা করবো বলে ঠিক করা ছিলো। রাতের মালালা শহর কেমন দেখার ইচ্ছে থাকলেও ক্যাম্প কিচেনের আরো লোকজনের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটালাম। তাদের একজন জানালেন যে তিনি এই ক্যাম্প সাইটে কয়েক বছর ধরে আছেন। কথা প্রসঙ্গে আসেপাশে বেড়ানোর জায়গা, শর্টকাট রাস্তা এবং রাস্তায় ক্যাঙ্গারু, গরু, উট এগুলো চলে আসলে কিভাবে ম্যানেজ করতে হবে সে বিষয়ে সাবধান করে দিলেন।
ভোর ৫টায় ঘুম ভেঙে গেলো। একটু ঠান্ডা পড়েছে। টেন্ট থেকে বাইরে এসে দেখি তখনো সূর্য ওঠেনি কিন্তু চারপাশ কমলা হয়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে কফি বানিয়ে ক্যাম্প কিচেনের বেঞ্চে বসে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে সকালের নাস্তা বানিয়ে ফেললাম। নাস্তা শেষে, রেডি হয়ে সবাই মিলে ১০ মিনিটের মধ্যে টেন্ট গুছিয়ে গাড়িতে উঠে গেলাম। গত রাতের ভদ্রলোকের দেখানো শর্টকাট রাস্তায় বালাকলাভা (Balaklava), বুমবুনগা (Bumbunga) হয়ে পোর্ট অগাস্টা ন্যাশনাল হাইওয়েতে উঠে আসলাম। এই যাএায় মালালা শহর বিসতারিত না দেখতেও এক রাতের ক্যাম্পিং এর স্মৃতিটুকু থেকে যাবে আজীবন।
পড়ুন সালাহউদ্দিন আহমদের আরো লেখা
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।
আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।