আমার ফিশারম্যান বন্ধু জয় ভাই ফেসবুকে আমার ছবিটার ক্যাপশান দিয়েছে – “নিরো, মাছটা কত বড় ছিল?” নিরো দেখাচ্ছে এত্ত বড়! গল্পের শুরু ১৫ বছর আগে, দক্ষিন কোরিয়ায়। মাছ ধরাটা সে সময় নেশা হয়। তবে, আজকের গল্পটা গত ১৫ বছরের মাঝে সেরা দিনটাকে নিয়ে।
৪ মাস বয়সী বাচ্চা নিরোকে নিয়ে মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছি শুনে যারা আৎকে উঠছেন তাদের জন্য সামান্য তথ্য – আজকের দিনটার জন্য আমরা প্রিপারেশন নিচ্ছি প্রায় ৩ মাস ধরে। ৩/৪ বছর বয়সের আগে বাচ্চাদের মোশন সিকনেস বা সী-সিকনেস হয় না। আর নিরাপত্তার জন্য যা যা দরকার ছিল সবকিছুরই আয়োজন করেছিলাম আমরা।
যাই হোক, তিন মাস আগে বউ জিজ্ঞেস করলো এটাতো তোমার স্পেশাল জন্মদিন, কী আয়োজন করবো? মাছ ধরতে যাবা কোথাও? বললাম- সব ফিশারম্যানদের স্বপ্ন থাকে একটা মার্লিন (marlin) ধরার, মার্লিন ধরতে না পারি একটা মাহি মাহি (mahi mahi) ধরতে পারলে মন্দ হয় না। জিজ্ঞেস করলো কোথায় ধরা যায় এই মাছ। বললাম দুনিয়ার হাতে গোনা কয়েকটা জায়গায় ধরা যায় এই মাছ। অস্ট্রেলিয়ার বন্ধু বাঁধন একবার ইনভাইট করেছিল মার্লিন ধরতে যাওয়ার জন্য, শেষবার যখন সিডনি গিয়েছিলাম খুব বেশি সময় ছিল না। হাওয়াইতে অনেকে ধরে শুনেছি, আর এদিকে মেক্সিকোতে আছে কাবো, মার্লিনের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এখন না। নিরোকে নিয়ে এত ঝামেলা করার দরকার নেই। আমাকে না জানিয়েই সে ট্যুর বুক করে ফেলে আমাকে জানালো। আমি বললাম- তাহলে নিরো? সে বললো আমি রিসার্স করে দেখেছি সমস্যা হবে না।
ট্যুর যেহেতু কনফার্ম, মার্লিন ধরতে পারি আর না পারি প্রস্তুতি তো নিতেই হবে। একটা মাহি মাহি যদি ধরতে পারি এটাই বা মন্দ কী! প্রস্তুতি শেষে আমরা কাবোতে পৌঁছাই। পরদিন, আমি একা এমনি টেস্ট হিসেবে ছোট একটা নৌকা নিয়ে যাই সমুদ্র দেখতে, আর যদি মাছ ধরতে পারি তো পারলাম এই উদ্দেশ্য। যাওয়ার পথে এক ঘন্টার মধ্যেই মাছ ধরার ছোট নৌকার ইন্জিনে সমস্যা দেয় বলে নাবিক আমাকে নিয়ে তীরে ফেরত আসে। যাদের কাছ থেকে নৌকা নিয়েছিলাম ওরাই আমাকে আরেকটা নৌকা দেয়। বৌকে ফোন করে জানাই – সে বলে ভালো তো, যাও! গেলাম কিন্তু একে তো দেরি হয়ে গেছে অন্যদিকে মাহি মাহি’র জন্য বিশ্বখ্যাত কাবোতে সারা দুনিয়া থেকে এসেছে ফিশারম্যানরা মাছ ধরতে, কারন এইদিন চলছে মাহি মাহি বা ডোরাডো (স্থানীয় ভাষায়) ট্যুর্নামেন্ট। ১০/১২ মাইল হটস্পটে (যে এলাকায় মাছ বেশি ঘোরাফেরা করে) প্রায় ৩০০ রেজিস্টার্ড নৌকা মাছ ধরতে এসেছে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে “worst day at fishing is still better than the best day at work” – মেনে নিলাম, কিন্তু একেবারে খালি হাতে ফিরিনি, হাহ! একটা ছোট মাহি মাহি নিয়ে ফিরেছি বৌ আর বাচ্চার জন্য। বোনাস হিসেবে দেখলাম এক অর্কা তিমি মাছ দেখে এসেছি। এ অঞ্চলটা তিমি মাছ দেখার জন্যও বিখ্যাত।
আরো পড়ুন আমাদের নায়াগ্রা যাত্রা
মেক্সিকান খাবারের সাথে যারা পরিচিত আছেন তারা হয়তোবা জানেন ‘ফিশ টাকো’ নামে একটা খাবার আছে যেটা সবচেয়ে ভালো হয় এই মাহি মাহি মাছ দিয়ে। এই মাহি মাহি টাকো- রেস্টুরেন্টে আমি কখনো পাইনি, হয়তো কমার্শিয়াল ফিশিং এর রেস্ট্রিকশান এর জন্য। যাইহোক এদিক ওদিক খোঁজ নিয়ে জানলাম অল্প কিছু টাকা দিলে এরা যেভাবে খুশি মাছ রান্না করে দেয়। তাই করলাম। এডওয়ার্ডো নামের আমাদের নবীন শেফ দুইভাবে মাছটা রান্না করে দিলো- টাকো বানালো আর প্যান সিয়ার্ড। দুটোই খেতে অসাধারণ লাগলো তবে এমন দারুণ ফিশ টাকো আমি দুনিয়ার কোথাও খাইনি!
আজ সকালে ঘড়ির এলার্মের আগেই নিরোর সাথে সাথে ঘুম ভাঙলো আমাদের সাড়ে চারটায়। ছয়টার সময় আমরা কাবো সান লুকাস মেরিনা (Cabo San Lucas Marina) পৌঁছলাম। নৌকার মাঝি অক্টাভিও আর তার সহকারী লুইস আমাদের স্বাগত জানালো, নৌকার ওঠার পর জিজ্ঞেস করলো কী মাছ ধরতে চাও তোমরা। আমি বললাম মার্লিন, আর যদি মাহি মাহি পাই এতেও চলবে। গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে অক্টাভিও, ৪০ বছর ধরে মাছ ধরার সাথে জড়িত সে (মানে আমার জন্মের কাছাকাছি সময় থেকে)। লুইস বলে- মার্লিন ধরতে মাঝ সমুদ্রে যেতে হয় আর মাহি মাহি সমুদ্রতীর থেকে ২/৩ মাইল দূরে, তুমি কি নিশ্চিত মার্লিন ধরতে চাও? বলে সে নিরোর দিকে তাকায়, নিরো তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। আমি মনে মনে বলি তুমি আমার ছেলেকে চেনো না এখনো। মুখে বললাম মার্লিনই ধরতে চাই। বুড়ো মাঝি অক্টাভিও মাথা নেড়ে গিয়ারে দেয় চাপ। নৌকা চলতে শুরু করে মাঝ সমুদ্রে, উদ্দেশ্য ৪০ মাইল পর্যন্ত যাওয়া।
প্রশান্ত মহাসাগরের এই দিকটা বুড়ো অক্টাভিওর চেয়ে বেশি চেনে আর মাছ ধরে এমন কমই আছে। ঘন্টাখানেক পার হতেই, হটস্পটে যাওয়ার আগেই, আমাদের তিনটা বড়শির একটাতে কিছু একটা আচমকা দেয় টান। কিছুক্ষনের মধ্যেই মাছ নিয়ে আসি নৌকায়, প্রথম মাছ, একটা মাহি মাহি। লুইস জিজ্ঞেস করে “রাখতে চাও?” আমি বললাম প্রথম মাছ, খুব একটা বড়ও না থাক ছেড়ে দাও! কিছুক্ষন পর, আরেকটা মাহি মাহি, এবার একটু বড়, এবারে রেখে দিলাম যেন একেবারেই খালি হাতে বাড়ি ফিরতে না হয়।
যারা সমুদ্রে মাছ ধরেছেন তারা হয়তো জানেন, সমুদ্রে মাছ ধরাটা ঠিক নদীতে মাছ ধরার মতো নয়, সহজ কঠিন তুলনা করবো না। নদীতে আমরা মাছের সাথে প্রয়োজনে হাঁটি, এদিক সেদিক যাই পুরো কন্ট্রোল থাকে আর সমুদ্রে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে, দুদুল্যোমান নৌকায় পুরো খেলাটা খেলতে হয় হাত দিয়ে।
অক্টাভিও উপর থেকে তাকিয়ে দেখছে, লুইসও, ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেও এদের সামনে আমি দুগ্ধপোষ্য শিশু, অন্তত প্রশান্ত মহাসাগরের এই দিকটাতে। বুড়ো অক্টাভিও তার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল এক মার্লিন হটস্পটে। কিছুক্ষন পরই আমাদের একটা লাইনে ভীষণ টান, টান দিতেই দূরে মাছটা লাফ দিয়ে উঠলো। সেই মার্লিন, এখন আমার লাইনে। ১৫ বছরের মাছ ধরার অভিজ্ঞতা সব ঢেলে দিয়ে হলেও এই মাছ আমার নৌকায় তুলতে হবে। সাধারণত স্যামন আমি যেভাবে মাছ ধরি, স্টারজান যেভাবে ধরেছি ব্রিটিশ কলোম্বিয়ার নদীতে সেভাবেই খেলছিলাম। বুড়ো বিরক্ত হয়ে কী কী যেন বলছিল লুইসকে, বুঝতে পারিনি কারণ সে বিরক্ত বা রাগ হলে মনে হয় স্পেনিশ ছাড়া সামান্য ইংরেজী যেটা জানে সেটা ভুলে যায়।
আরো পড়ুন কোকো ক্রেটারে বাংলাদেশের পতাকা
লুইস আমাকে ইংরেজীতে বুঝিয়ে বললো, this is your once in a lifetime opportunity to land a Marlin, he is saying don’t do this, do that, lot of times it takes an hour or more to land one fish. Don’t rush. ওকে! ওকে! শখের মার্লিন ধরতে এসে বুড়োর গালি খেলাম এখন তাকে আমার দেখিয়ে দিতে হবে যে আমি novice না! তবে যা যা পরামর্শ দিলো মাথা পেতে নিলাম। ৩০ মিনিটের লড়াইয়ের পর মাছটা টেনে তুললাম নৌকায়, বৌ-বেটা (ঘুম থেকে উঠে) দেখছিল আমার আর মার্লিনের লড়াই। আমি মাছ নামিয়ে তাকালাম বুড়োর দিকে। বুড়ো মাথা নাড়লো।সেই সাথে মুচকি হাসি। নৌকায় ওঠার পর এই প্রথম বুড়োর হাসি দেখলাম।
কিছুদূর যেতে না যেতেই আবার এক লাইনে টান। আমি দৌড়ে গিয়ে ছিপ তুলে খেলতে খেলতে দেখি অন্যদিকে আরেক লাইনে টান। লুইস এসে নিলো এক ছিপ। লুইস কিছুই করবে না, ছিপ ধরে রাখা ছাড়া, সে বৌকে দিল এক ছিপ। নিরো সুন্দর কার সিট এ বসে আরাম করে দেখছে বাবা-মা দুজনই মাছ ধরছে। বুড়ো মাঝি অক্টাভিও উপর থেকে নৌকার স্টিয়ারিং ধরে হাসছে, হাসছে কেন বুঝলাম তখন, যখন দেখি আমাদের তৃতীয় লাইনেও আরেক মাছ। এ তো মুশকিল! বৌ তো মাছ ধরা দূরে থাক সারা জীবনে মাছ খেয়েও দেখেনি আমার সাথে পরিচয়ের আগে। এখন সে মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। যাই হোক, তিনটা মার্লিনের দুইটা আমরা নৌকার কাছে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। একটা চলে গেছে। যেহেতু আমাদের একটা মার্লিন আর দুইটা মাহি মাহি আছেই, ছেড়ে দিলাম প্রথমটা। দ্বিতীয়টা কাছাকাছি নিয়ে আসার পর বুড়ো অক্টাভিও বললো সে একটা মাছ নিতে চায়। আমি মনে মনে বললাম, ও এতক্ষন আমাকে চোখ রাঙিয়ে এখন আমার ধরা মাছই খেতে চাও? মুখে বললাম, অবশ্যই I will bring that fish for you!
(নিরোর ছবিটা ৭ ঘন্টা সমুদ্রে কাটানোর পর তোলা।)
মার্লিন ধরা হয়ে গেল, অক্টাভিও বললাম এবার নৌকা ফেরত নিয়ে চলো, তবে ফিরতে ফিরতে যদি… কিছু। …বলতে বলতেই বিশাল এক মাহি মাহি লাইনে আটকালো। এত বড় মাহি মাহি এখানকার স্থানীয়রাও খুব বেশি দেখে না। এরপর আরেকটা মার্লিন। সবচেয়ে অবাক করে দিয়ে ধরা দিলো এক ইয়োলো ফিন টুনা! ফিশারম্যানরা হয়তো ৫০ পাউন্ড বলবে তবে এটা ৩০ পাউন্ডের বেশি হয়তো হবে না। টুনা ধরার জন্য আমার বিশেষ পরিকল্পনা ছিল। তবে এই একদিনেই এতকিছু ঘটে গেল। ভোর থেকে ৭ ঘন্টা কিভাবে কাটলো যেন টেরই পেলাম না। এত কাছাকাছি টুনা দেখে বুড়ো অক্টাভিও খুশি। আমি কৌশল দেখিয়ে নিজেই টুনা টেনে তুললাম। বুড়ো এবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো আর ইংরেজিতে বললো- well done!
তীরে ফিরে নিরোকে জিজ্ঞেস করলাম- কী বাপ! কেমন এনজয় করলি। নিরো মুচকি হাসি দিলো। এই ছেলেটাকে বাংলা না শেখালে, বড় হয়ে কিভাবে পড়বে তার বাবার সাথে মার্লিন ধরার গল্প!
পড়ুন কাজী মামুনের আরো লেখা
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।
আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।