২০১৫ সালে আমার প্রথম নেপাল আসা হয়, হিমালয় রেঞ্জ এর পর্বতমালার সাথে তখনি প্রথম মুখোমুখি, যদিও অনেক দূর থেকে। পোখারা থেকে ২ দিন ট্রেকিং করে আমরা প্রথমে পৌছাই অস্ট্রেলিয়া ক্যাম্প-এ (সি লেভেল থেকে প্রায় ২,৫০০ মিটার উপরে)। ভোর পাঁচটা বাজলে গাইড ডেকে তুললো – স্যার, আকাশ একদম পরিষ্কার, হিমালয়ের উপর সূর্যোদয় দেখার এই সুযোগ! ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী সবাইকে ডেকে তুললাম – বাইরে তখন শূন্যের কয়েক ডিগ্রী নিচে তাপমাত্রা, তাড়াহুড়ায় ওরকম কাপড় চোপড়ও না পরে চলে এসেছি কিন্তু পর্বতমালাকে সচক্ষে দেখার সুযোগ পেয়ে সব ভুলে গেলাম, একটা অনন্য অভিজ্ঞতা। সূর্য তখন একের পর এক পর্বতগুলিকে জাগিয়ে তুলছে – অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাকালু , লাহাটসে ….তারপরে যেন পালা এলো এভারেস্টের যদিও এভারেস্ট ছিল সবার পিছনে!

রেফারেন্স: realitymaps (২০২৩), https://mount-everest3d.com/3d-map/ সর্বশেষ আপডেট ২৬/০৭/২০২৩
আমাদের গাইড বারো দিনই আমাদের সাথে ছিল এই নেপাল ভ্রমণে – ওরই কাছ থেকে কিছু কিছু ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করলাম এভারেস্ট নিয়ে – কতদূর/কিভাবে উঠা যায় বা অন্য কি অপসন আছে ইত্যাদি, মনে মনে কিছু হিসাবও করে রাখলাম!
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে এল একটা সুযোগ – ফ্যামিলিকে বলাতে প্রথমেই না শুনতে হলো, শেষ পর্যন্ত রাজি করলাম, কন্ডিশন একটাই – জাস্ট বেস ক্যাম্প পর্যন্ত ট্রেকিং করা যাবে। ছেলে (Rashique) একটু বেঁকে বসলো তাকেও নিতে হবে, শর্ত দিলাম একটা ফ্রেন্ড কে জোগাড় করার জন্য যদিও শেষ পর্যন্ত আমি একাই বুকিং দিলাম – ডিসেম্বরের ৯ তারিখে নয় জনের এক গ্রুপের সাথে!
মাউন্ট এভারেস্ট প্রায় ৮,৮৫০ মিটার উঁচু, এর চূড়ায় (সামিট) উঠতে হলে চারটি ক্যাম্প পার হতে হয় – ক্যাম্পগুলো হচ্ছে রাত্রে থাকার জন্য। বেস ক্যাম্প যারা ট্রেকিং করে (আমাদের মতো), তারা ৫,৪০০ মিটার যাওয়ার পরে আবার ব্যাক করে, আর যারা সামিট-এ উঠতে চাই তাদেরকে যেতে হবে all the way (আরো চারটি ক্যাম্প তারপর সামিট – ৮,৮৫০ মিটার)। উপরের ছবিটি এবং নিচের ভিডিওটি দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে:
ডিসেম্বরের ৭ তারিখ রাত দশটায় কাঠমুন্ডু পৌঁছাই, পরের দিন ছিল বিশ্রাম, শপিং আর টীম মিটিং। আমার সময়টা ছিল খারাপ, শীত শুরু হয়ে গেছে আর শীত মানেই রক্ত হীম করা শীত। রেন্টাল দোকান থেকে তাই ভাড়া করলাম স্লিপিং ব্যাগ আর ডাউন জ্যাকেট।
ট্রেকিং কোম্পানি আমাদের প্রত্যেককের জন্য বরাদ্দ করলো ১৫ কেজি ওজন যেটা আমরা একটা duffel বাগে ভরে পোর্টারকে দিলাম – প্রতি দুই জনের জন্য ছিল একজন পোর্টার সুতরাং সে বহন করতো প্রায় ৪০ কিলো ওজন তার পিঠে। আর আমরা একটা ব্যাকপ্যাক-এ আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ট্রেকিং এর সময় বহন করতাম যেটার ওজন ছিল প্রায় ৮/৯ কিলোর মতো।
৯ তারিখ ভোর ৪ টার সময় উঠে নাস্তা খেয়ে সোজা এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে একটি ১২ সিটের সেশনা তে করে পৌঁছলাম লুকলা (Lukla) এয়ারপোর্টে (৪৫ মিনিটের ফ্লাইট)। লুকলা কে বলা হয় ওয়ার্ল্ডের মধ্যে ভীতিকর এয়ারপোর্ট। প্রায় ১০ মিটার চওড়া একটা স্ট্রিপ এর মধ্যে সেশনা ল্যান্ড করে, দুই পাশে খাড়া পর্বত, একটু ভুল হলেই হয় এস্পার না হয় ওস্পার! ১,৯৫৩ তে হিলারি যখন এভারেস্ট জয় করেন তখন লুকলা পৌঁছাতে তার সময় লেগেছিলো প্রায় একমাস, আর আমরা পৌঁছে গেলাম ৪৫ মিনিটের এর মধ্যেই।
আমাদের ট্রেকিং গাইড এর সাথে পরিচয়ের পর ব্রেকফাস্ট আর চা-কফির পর্বটা শেষ করলাম। তারপরে শুরু হলো সেই কাঙ্ঘিত পদযাত্রা। অফ সিজন হওয়াতে আসে পাশে আর তেমন কাউকে দেখলাম না। শুধু আমরা ১৫ জন হেটে চললাম জঙ্গল, পর্বত সবকিছুর মধ্যে দিয়ে। কিছুক্ষন পর পরে দৃশ্য বদলে যেতে থাকে, স্থানীও লোকজন মাঝে মাঝে হাত নাড়িয়ে আমাদের শুভ কামনা করলো। পর্বত এলাকায় মানুষের জীবন অনেক কঠিন, কাঁধের উপরে ১৫/২০ কিলো ওজন নিয়ে একেক জন খাড়া রাস্তা দিয়ে হেটে চলছে তাদের গন্তব্যস্থলে। একটি অদ্ভুত অনুভূতি মনকে ছুঁয়ে গেলো – বাচ্চা ছেলেমেয়েরা শুয়ে আছে বাড়ির উঠোনে, পাশে কুকুর শুয়ে আছে তাদের সাথে, অনেকের কোলের উপরে, সামাজিকভাবে যেন একই তাদের অবস্থান!
দুপুর আর রাতের খাবার সারলাম একটি টিহাউসে (teahouse) – ডাল, ভাত আর সবজি দিয়ে। যদিও ডাল ভাত আমার প্রিয় খাবার, তবুও একটু মন খারাপ হলো যখন গাইড বললো নেক্সট ৯/১০ দিন আমাদের এভাবেই চলবে – নো মিট। মাংস আসার একমাত্র উপায় কাঠমান্ডু থেকে কারণ পর্বত এলাকায় পশু জবাই নিষিদ্ধ, (লোকাল বৌদ্ধ সংস্কৃতি)। ট্রান্সপোর্টের সময় মাংস নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে দুরুত্ব আর সময়ের জন্য। ডাল ভাতের একটা সুবিধা হচ্ছে সাপ্লাই আনলিমিটেড – অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই যত ইচ্ছা খাওয়া যায়।
প্রথম রাতেই টের পেলাম ঠান্ডা কি জিনিস! স্লিপিং ব্যাগ এর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলাম কিন্তু গরম হচ্ছিনা কোনোভাবেই। সারারাত এপাশ ওপাশ করলাম। নতুন জায়গা, অপরিচিত রুমমেট (এক ইন্ডিয়ান ডাক্তার), তারপরে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা! আমার ঘুম এমনিতেই কম, সুতরাং প্রথম রাত বলা যায় একরকম জেগেই থাকলাম।

পরদিন গন্তব্যস্থল নামচি বাজার (Namchi Bazaar) – travellers, trekkers আর climbers কাছে এটা হচ্ছে সাংগ্রিলার সমতুল্য। নামচি বাজার প্রাণবন্ত এক শহর। চারিদিকে বৌদ্ধ প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজানো। ট্রেকিং এর বিবেচনায় আমাদের জন্য এটি একটি অন্যতম কঠিন দিন। তিনটি সাসপেনশন ব্রিজ পার হতে হয় আমাদের, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং দর্শনীয় হিলারি (Hillary) সাসপেনশন ব্রিজ। এই ব্রিজের উপর ঘটে একটি মজার ঘটনা – ছবি তুলতে তুলতে আমি যখন অর্ধেক রাস্তায়, তখন লক্ষ্য করি অন্যদিকে থেকে নেমে আসছে এক দল ইয়াক (Yak – তিব্বত এবং চীনের স্থানীয় প্রাণী)। আমার তখন ২টি অপশন, হয় ফিরে যাওয়া নতুবা ব্রিজের তারের সাথে লেপ্টে থাকা যাতে ইয়াকগুলো আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। দ্বিতীয় অপশনটা বেছে নিলাম নাক, কান বন্ধ করে। ইয়াকগুলো পাশ নিয়ে যাবার সময় ওদের গায়ের গন্ধ, নিশাঃস আর গলার ঘন্টির আওয়াজ এত স্ট্রং ছিল যে নিজেকে মনে হলো আমি ওদেরই অংশ।
নামচি বাজারে দুইদিন থাকতে হলো উচ্চতার সাথে অভস্ত হওয়ার জন্য। টেকনিকটা হলো বেশি উচ্চতায় পৌঁছানোর পর আবার নিচে নেমে আসা এবং নিম্ন উচ্চতায় ঘুমানো। আমাদের শরীর এভাবেই অভস্ত হয়। সমস্ত ব্র্যান্ডের দোকান এখানে আছে তার সাথে আছে রেস্টুরেন্ট আর হোটেল, বিকেল বেলায় ১০ ডলার দিয়ে শাওয়ার করলাম, মনে হলো মাথা থেকে একটা ভারী বোঝা নামলো।
এর পরের দিনগুলো কাটলো এভারেস্টকে সামনে রেখেই। যত আগাচ্ছি, তত এভারেস্টকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। প্রতিদিন আমরা ১০/১২ কিলোমিটার করে ট্রেক করছি আর উপরে উঠছি, এর মাঝে একটা পার হলাম, জায়গাটি এতটাই প্রশান্তিকর, মনে হলো দুইদিন ওখানে থেকে তারপর যাই।
চার পাশের প্রাকতিক সৌন্দর্যের এখন জানি কোনো তুলনা নেই, সমস্ত শারীরিক কষ্ট যেন চোখ মেলাতে অনেকটা লাঘব হয়। গাইড দুই জন সবসময় আমাদেরকে পর্বতগুলো চেনানোর চেষ্টা করতো – পৃথিবীর ১৪টা সবচে বড় পর্বতের ১০টি এই হিমালয়ান রেঞ্জ এর ভিতরে, আর এরাসবাই ৮,০০০ মিটারের উপরে। তবে মাঝে মধ্যে আমা দাবলাম (Ama Dablam ৬,৮১৪ মিটার) কে দেখে মনে হতো এটা এভারেস্টের চেয়েও উঁচু। কিন্তু কথায় যে বলে দিল্লী দূর অস্ত, এভারেস্টও সেই ব্যাপার।

লোবুচে (Lobuche – প্রায় ৫,০০০ মিটার) পৌছানোর আগে পার হয়েছি অদ্ভুত সুন্দর একটি কবরস্থান। এখানে রয়েছে কিছু শেরপাদের কবর যারা এ পর্যন্ত হিমালয়ান এক্সপেডিশন-এ জীবন হারিয়েছে। একটার পর একটা পাথর সাজিয়ে কবরগুলি পিরামিড এর মতো করা হয়েছে, আর প্রেয়ার ফ্ল্যাগ আর চারদিকের পর্বতমালা যেন এদেরকে পাহারা আর আর্শীবাদ করছে অবিরত। আমার মনে একটাই অনুভব হলো – শেষ বিশ্রামের জন্য এর চেয়ে কোনো ভালো জায়গা হতে পারেনা!
Altitude sickness এর প্রথম ধাক্কা পেলাম এখানেই, ঘাড়ের কাছে আর মাথার ভিতরে মনে হল একটা shooting pain। জোরে জোরে নিঃস্বাস নেয়ার চেষ্টা করছি আর একটু একটু পানি মুখে দিয়ে ঢোক গিলছি। গাইডকে বলাতে সে আস্বস্ত করলো যে এর পরের ২ ঘন্টা আমরা নিচে নেমে যাবো প্রায় ২০০ মিটারের মতো, সুতরাং আমি এখনকার চেয়ে ভালো বোধ করবো। টিহাউসে পৌঁছাবার পর আমার ডাক্তার রুমমেট আমাকে একটা ট্যাবলেট খেতে সাজেস্ট করলেন। যে কোনো ওষুধের প্রতি আমার সব সময় এলার্জি তবে ওর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত একটা খেয়ে নিলাম। ফল হলো মারাত্মক, সারারাত সিলিং এর দিকে চেয়ে আছি, ঘুমের ছিটে ফোটাও চোখে এলোনা। যদিও ব্যাথা আর নাই কিন্তু ঘুম না হওয়াতে মেজাজ আমার তখন চরমে।
পরদিন আমাদের ডি ডে (D Day), গন্তব্যের এতো কাছে এসে মেজাজ ঠিক রাখা আরো জরুরি। তাই যতই খারাপ লাগছিলো ট্রেকিং এর সময় , মনে ততই উৎফুল্লু ভাব নিয়ে আসলাম। ট্রেকিং এর দিক থেকে এটা দ্বিতীয় কঠিনতম দিন, এই জায়গাটা বেশ পাথুরে, তাই ট্রেকিং পোল ব্যবহার করে প্রতিটা স্টেপ আগাতে থাকলাম। এতো উচ্চতায় বাতাসের প্রেসার কম (প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ)। তাড়াহুড়া করা মানে মূল্যবান এনার্জি খরচ করা। মাউন্টেন এনভিরনমেন্টে যেটা সবচে দরকার তা হলো মানিয়ে যাবার ক্ষমতা। ফিটনেস থাকতেই হবে, কিন্তু সহ্যশক্তি না থাকলে বেশি দিন টেকা যাবেনা। একবার অসুস্থ হওয়া মানেই সবকিছুর সমাপ্তি – হেলিকপ্টারে করে সোজা কাঠমন্ডু।



অবশেষে বেস ক্যাম্প এর দেখা মিললো – প্রায় ১০০ মিটার নিচে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দেখা যাচ্ছে, আমরা উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না পাথরের জন্য। বেস ক্যাম্পে এসে ক্লাইম্বাররা অবস্থান নেন কিছু দিনের জন্য যাতে সামনের কঠিনতম দিনগুলোকে মোকাবিলা করতে পারেন। এখানে কিন্তু আমরা কোনো ক্যাম্প দেখলাম না কারণ এখন অফ সিজন। আমাদের গ্রুপের সবাই দাঁড়িয়ে গেলো একটা বড়ো পাথরের উপর ছবি তোলার জন্য, আমি খুঁজতে থাকলাম পাথরের নিচে কোনো বাংলাদেশের পতাকা পাওয়া যায় কিনা। শেষ পর্যন্ত একটা অস্ট্রেলিয়ান ফ্ল্যাগ পেলাম। সেটা জড়িয়ে কিছ ছবি তুললাম। আমরা তখন এভারেস্টের খুব কাছে কিন্তু সরাসরি চূড়া দেখা একটু কষ্টকর তবুও ক্যাম্প ১ এর ট্রেকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খুম্বা গ্লাসিয়ারের (Khumbu Glacier) উপর, কেন জানি একটু শিউরে উঠলাম এক অজানা আতঙ্কে।
বেস ক্যাম্পে ঘন্টা খানেক সময় কাটানোর পর আবার শুরু হলো। প্রায় ২ ঘন্টা ধরে ট্রেকিংকরে টিহাউসে পৌঁছে জিনজার টি খেয়ে শুরু করলাম কালাপাথর ক্লাইম্বিং (প্রায় ৪০০ মিটার উঁচু )। এখন থেকে পুরো হিমালয়ান রেঞ্জ এর উপরে পরিষ্কার সূর্যাস্ত দেখা যায়। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। মনে হয় এভারেস্টে আগুন জ্বলছে। আর ওদিকে পাল্লা দিয়ে তাপমাত্রা কমছে। চোখের পাতা দুটো মনে হচ্ছে বরফ হয়ে যাবে। পরের তিনদিন গেলো আমাদের নামতে। যদিও ৫,৮০০ মিটার উঠে ছিলাম ৭ দিনে, কিন্তু সেই একই রুট দিয়ে নেমে আসতে সময় নিলো মাত্র ৩ দিন।
কাঠমুন্ডু পৌঁছে একটা হট শাওয়ার নেয়া পর মনে হলো – oh, what a feeling!!
লেখাটি অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে প্রকাশিত পূজা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।