মা বলেন, আমার পায়ের নিচে নাকি চাকা লাগানো! তাই নাকি স্থির থাকা হয় না। কথা সত্যি। সেই ভয় থেকেই ত গাড়ি কিনি না। কেননা, গাড়ি কিনলে ঘর ভাড়া করে আমার থাকা হবে না। আমি নিজেকে বলি “ঘুরুঞ্চি”। সুযোগ পেলেই উধাও।

অনেকে বলেন, গাড়ি ছাড়া নাকি ঘোরা যায়না। আমার মনে হয়,  ইচ্ছে থাকাটা আসল। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে কত কত জায়গায় গিয়েছি তার হিসেব নেই।আমি বেড়ানোর জন্য আগে থেকে জায়গা ঠিক করি না। গুগল ম্যাপে খুঁজে খুঁজে জায়গা বের করি।

গত পাঁচ বছরের অস্ট্রেলিয়া জীবনে, ৮ বার নিউ সাউথ ওয়েলস্, ২ বার কুইন্সল্যান্ড, ১ বার ক্যানবেরা ও ১ বার এডেল্যাডে গিয়েছি। আর মেলবোর্ন-ভিক্টোরিয়ার অলি-গলি পাকস্থলি ঘোরা শেষ। তবুও কোথায় যেন কী বাকি রয়ে যায়…

করোনা সংক্রমণের পিক সময়টা আমার জন্য ছিলো ভীষণ কষ্টের। মেলবোর্নের লকডাউনে মনে হত, কেউ যেন আমার হাত-পা বেঁধে রেখেছে। তাই বর্ডার ওপেন হতেই ডিসেম্বরে নিউ সাউথ ওয়েলসে দিলাম ভোঁ দৌড় । বন্ধু-বান্ধব-কাজিন ওখানে বেশি থাকার সুবাদে, খাওয়া-থাকার চিন্তা নেই। আর ঘোরা যায় ইচ্ছা মতন। গুগল ম্যাপে দেখে নিলাম নেলসন বে বেশ সুন্দর জায়গা। ব্যাস্! রওনা হয়ে গেলাম সকাল সকাল। সিডনী থেকে বেশ লম্বা ড্রাইভ।

সিডনী গেলে যথারীতি প্রচুর আড্ডা আর ঘোরাঘুরির কারণে সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম। বন্ধু আমার গাড়ি চালাচ্ছিলো। চালকের পাশে বসে যাত্রীর নাকি ঘুমাতে নেই। তাতে চালকেরও নাকি ঝিমুনি আসে। আর আমার চোখে তখন দিন-দুনিয়ার সমস্ত ঘুম। কি বিপদ! কখন যে দু-চোখের পাতা একহয়ে গেছে আমি জানিনা। মুহূর্তেই ধ্রিম-ধ্রাম গানের উচ্চ শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বলি, এসব কি হলো…? বন্ধু জানায় আমি নাকি টানা ত্রিশ মিনিট নাক ডেকে ঘুমিয়েছি। প্রচন্ড বাজে কথা, আমি ১০০% শিওর আমি ৩০ সেকেন্ড ঘুমিয়েছি!

যা হোক, পথে দু’কাপ কফি খেয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে আমরা নিউ ক্যাসল এসে পৌঁছালাম। এবার একটা ছোট বিরতি। সাথে আমার ৮ বছরের মানব-ছানা। ঈমান তার নাম। সে আবার আমার সব যাত্রার সাথী। ছোট্টবেলা থেকে মায়ের সাথে ঘুরেঘুরে সে বেশ মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। কে জানে বড় হলে কি বলবে।

নিউ ক্যাসল বড় শহর, কিন্তু সিডনীর তুলনায় ছোট। ভালো লাগলো পুরনো-ছোট শহর দেখতে। সবার মধ্যে একটা ঢিলেঢালা ভাব। কোন কাজে তাড়া নেই।

এসব দেখতে দেখতে আমরা নেলসন বের দিকে ধাবিত হলাম। ১ ঘন্টা পর পৌঁছালাম গন্তব্যে। দূর থেকেই সাদা বালুরাশি চিকচিক করছে। দেখে ভালো লাগছিলো। আমার দুবাই ভ্রমণের কথা মনে পড়লো। গাড়ি পার্ক করে আমরা হেঁটে হেঁটে উটের পিঠে চড়ার জন্য হাজির হলাম।

ভাবছিলাম, এই উটগুলোকে সঠিকভাবে যত্ন করা হয় কিনা? বেচারিরা রোদের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ট্যুরিস্ট হিসেবে আমাদের একটা দায়িত্ব থেকে যায়। ট্যুর গাইডকে বিস্তারিতভাবে জিজ্ঞেস করলাম ও তাদের ডক্যুমেন্টও দেখতে চাইলাম। তারা অবাক হলেও সব উত্তর সঠিক ভাবেই দিয়েছিলো। এর মাঝে বেশ দীর্ঘ লাইন আর রোদের প্রচন্ড তাপে আমার ছেলে ও আমার দু’জনের  ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে থাকে। কিন্তু নেলসন বে আসলাম আর উট পিঠে চড়লাম না… এটা মানতেও কষ্ট হচ্ছিলো।

যাক, সময় হলো উটের পিঠে চড়বার। কিন্তু মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরঘুর করছিলো। আচ্ছা এত টাকা দিয়ে যে টিকেট নিলাম, কিন্তু উট যদি আমাকে নিয়ে উঠতে না পারে? যদি চার হাত-পা ছড়িয়ে লেটা দিয়ে বসে পড়ে?? কি একটা বেইজ্জতি হবে তখন!

ইয়া নফসি করে উটের পিঠে কোনমতে উঠলাম ছেলেকে নিয়ে। তারপর বেঁকিয়ে-তেড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো সেই উট। ট্যুর গাইড পরিচয় করিয়ে দিলো সেই উটের নাম ছিলো “কোল”। আমি আর ঈমান তারস্বরে বললাম “হাই কোল”! এবার মরুভুমির রাজা চললেন হেলে দুলে। আমার মাথায় ঘুরছে “হঠাৎ বৃষ্টি”র ছায়াছবির গান…

“সোনালী প্রান্তরে, ভ্রোমরার গুন্জনে…দখিনা পবনে তে অন্ধ আবেগে থাকে না মন ঘরে…”

উটে চড়া শেষ। “কোল” কে বিদায় দিয়ে আমরা শ্বেত-শুভ্র বেলাভূমিতে ফটোগ্রাফি করলাম। বন্ধু তার ড্রোনটাকে ভোঁ ভোঁ করে এদিক ওদিক ঘোরালো।

এবার ৩ ঘন্টা ড্রাইভ করে আবার সিডনী ফেরার পালা। ফিরতি পথে আর ঘুম পায়নি। উটের পিঠে চড়ার দারুন অভিজ্ঞতা মনে করে ব্যাপক ভালো লাগছিলো। ও হ্যাঁ! উট বেচারা যে আমাকে পিঠে নিয়ে পপাত ধরনীতল হয়নি, তাতেই আমার পয়সা উসুল!