রোজার ঈদে ৩দিন ছুটি । আমরা ছুটলাম মরক্কোর পথে। আমরা যেখানে থাকি (ওয়েস্টার্ন সাহারা) সেটা কাসাব্লাঙ্কা থেকে বিমানে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট দুরুত্বে। বিকালে ফ্লাইট ধরে আমরা ছুটলাম কাসাব্লাঙ্কা। আমাদের প্লান প্রথম দিন থাকবো কাসাব্লাঙ্কা, পরদিন চলে যাবো ট্যাঞ্জির, শেফশোয়ান (যাকে বলা হয় ব্লু মাউন্টেইন) আর পরদিন দুপুরে চলে আসব আমাদের নিজ গৃহে।

আমরা যখন আসলাম কাসাব্লাঙ্কা, তখন রাত প্রায় ৯টা বেজে ৩০ মিনিট। আমরা চলে আসলাম হোটেলে। হোটেলটা আমরা নিয়েছি ট্রেন স্টেশনের কাছে। কারণ পরদিন দুপুরে আমরা ট্রেন ধরে চলে যাবো ট্যাঞ্জির। সময় বাঁচাতেই ষ্টেশনের কাছে থাকা। হোটেলে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে বের হলাম রাতের খাবার খেতে। ট্রেন স্টেশনের কাছে হওয়াতে অনেক খাবারের দোকান আশে পাশে। একটা দোকানে বসে ভাবছি কি খাওয়া যায়। অবশেষে পাস্তা কারবোনারা অর্ডার করলাম। খাবার আসতে দেরি কিন্তু খেতে দেরি না। খেতে যেয়ে বুঝলাম আসলে আমরা অনেক ক্ষুধার্ত ছিলাম। খেয়ে আসে পাশে ঘুরে চলে এলাম হোটেলে। আসলে খুব টায়ার্ড, আর রাতও হয়ে গেছে তাই আজ কোথাও যাওয়া হবে না।

পরদিন সকালে আমরা বের হলাম ক্যাসাব্লাঙ্কায় অবস্থিত হাসান-২ মসজিদ দেখবার জন্য যেটি দাড়িয়ে আছে আটলান্টিক মহা সাগরের উপর। এটি আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহৎ এবং পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ মসজিদ।

এরপর ক্যাসাব্লাঙ্কা মলে উইন্ডো শপিং করে হোটেলে ফিরলাম। তিনটায় আমাদের ট্রেন, ট্যাঞ্জির যাবার। আমাদের হোটেলটা স্টেশনের পাশেই ছিল, তাই রুমে ঢুকে ব্যাগ নিয়ে চলে গেলাম ট্রেন ধরতে। ট্রেনে জার্নি করতে আমার খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে ট্রেন যখন ছুটে চলে। ট্রেন কখনো লোকালয় দিয়ে ছুটে চলছে কখনো সবুজ মাঠ দিয়ে। কেন যেন আমার কোন দিন মরক্কো ঘুরতে আসার কোন ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনেক আগেই আসা উচিত ছিলো এখানে, এত্ত সুন্দর। এখানে যেমন মরুভূমি আছে, তেমন মহাসাগরও পাশ দিয়ে চলে গেছে। সবুজ আছে আবার তুষারপাত ও আছে।

ট্যাঞ্জির নেমে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম হোটেলের জন্য। ট্রেন স্টেশন পাশেই অনেক শপিং মল। কিন্তু আমাদের হোটেলটা একটু দূরে নেয়া হয়েছে। কারণ আমরা সমুদ্রের পাশে হোটেল চাই।

হোটেলে ঢুকে মন ভালো হয়ে গেল। আমাদের ব্যালকনি থেকে আটলান্টিক দেখা যায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা। দেরি না করে আমি ছবি তুলে নিলাম সমুদ্রের। সত্যি আমি আসলে লেখে বোঝাতে পারবো না কতটা সুন্দর ছিল। রাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে শুনছি ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। পরদিন সকালে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা সিটি টুরে বের হলাম। কথা হল সে আমাদের ট্যাঞ্জির ঘুরিয়ে দেখাবে এর পর আর একটা ট্যাক্সি আমাদের সেফশোয়ান নিয়ে যাবে। আমরা দেখতে গেলাম “ হারকিউলিসের পায়ের ছাপ”, “হারকিউলিসের গুহা”, “লাইট হাউস” “জিব্রাল্টা প্রণালী”।

হারকিউলিসের গুহা

হারকিউলিসের গুহা (Caves of Hercules) কেপ স্পার্টেল, মরক্কোতে অবস্থিত। ট্যাঞ্জিরের ১৪ কিলোমিটার (৯ মাইল) পশ্চিমে অবস্থিত, জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ যা কিনা মরক্কো রাজার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ সংলগ্ন। গুহাটির দুটি খোলা অংশ রয়েছে, একটি সমুদ্রের দিকে এবং একটি স্থলে। সমুদ্রের খোলাটি “আফ্রিকা মানচিত্র” নামে পরিচিত। এটা বলা হয় যে ফিনিশিয়ানরা সমুদ্রের খোলা অংশের সৃষ্টি করেছিল যা সমুদ্র থেকে তাকালে আফ্রিকার আকার মনে হবে। দেয়ালে চোখের আকারে কিছু চিহ্নও রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় ফিনশিয়ানরা তৈরি করেছে, যা স্থানীয় এলাকার মানচিত্র।

গুহাটি নিজেই আংশিক প্রাকৃতিক এবং আংশিক মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট অংশটি বারবার লোকেরা বিভিন্ন সময় দেয়াল থেকে পাথরের চাকা কাটতে, মিলের পাথর তৈরি করতে ব্যবহার করতো। এইভাবে গুহাটি উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রসারিত হয়েছিল। এখানে বিনামূল্যে এবং অর্থপ্রদানের প্রবেশপথ রয়েছে। গুহায় প্রবেশ করতে জনপ্রতি ৫ মরোক্কান দিরহাম এবং গাইডের জন্য একটি ঐচ্ছিক অতিরিক্ত ৫ খরচ হয়, তবে অন্যান্য মুদ্রাও গ্রহণ করা হয়। আরো মজার কথা হল আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার হারকিউলিসের পায়ের ছাপ দেখিয়ে বলল, হারকিউলিসের এক পা জিব্রাল্টার প্রণালির এপাশে অন্য পা নাকি ও পাশে থাকত!

ক্যাপ স্পার্টেল বাতিঘর

ক্যাপ স্পার্টেল বাতিঘর (Mirador Cap Spartel) ট্যাঞ্জিয়ারের জনপ্রিয় হারকিউলিস গুহাগুলির কাছে অবস্থিত। এটি একটি ফ্যাকাসে বর্গাকার টাওয়ার। ভূমধ্যসাগর আটলান্টিকের সাথে মিলিত হওয়ার বিন্দুতে অবস্থিত, বাতিঘরটি ১৮৬৪ সালে সুলতান মুহাম্মদ চতুর্থের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল।

শেফশয়ান

শেফশয়ান শহরটি উত্তর-পশ্চিম মরক্কোর রিফ পর্বতশ্রেণীর পশ্চিম অংশে কালা পর্বতের পাদদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০মিটার (২,000 ফুট) উপরে অবস্থিত। শেফশয়ান নামটি, যার অর্থ ‘শিং দেখুন’। ‘শয়ান’ শব্দের অর্থ ‘ছাগলের শিং” এবং ‘শেফ’ শব্দটি ‘দেখায়’। উপজাতীয় ভাষায় নামটি শহরের উপর অবস্থিত পর্বতশৃঙ্গের চেহারা উল্লেখ করে। শেফশয়ান কে বলা হয় “নীল মুক্তো শহর”। কারণ প্রতিটি বাড়ি এখানে নীল এবং সাদা রঙ করা। এটি নিয়ে ও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। কেউ বলে মশার হাত থেকে বাচতে এই নীল রঙ করা, কেউ বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদীরা এখানে পালিয়ে আসে, তখন তারা এই রঙ করেন কারণ নীল তাদের কাছে পবিত্র রং, যা তাদের স্বর্গ এবং ঈশ্বর কে মনে করিয়ে দেয়। আবার অনেকে বলে পর্যটককে আকৃষ্ট করার জন্য এই রং করা এখন বাধ্যতামূলক। আমার যেদিন ওখানে গিয়েছিলাম সেটা ছিলো ঈদের আগের দিন। দেখলাম অনেকেই তাদের বাড়ি নিজেরাই রং করছে ঈদ বলে।

শেফশোয়ানে আমরা কিছু দোকান দেখলাম যেখানে হাতে বানান সাবান, লোশন, সহ অনেক কিছু আছে। এমন কি কিছু সুগন্ধি আছে যেগুলো কাপড়ের ভাজে রেখে দিলে সুন্দর গন্ধ হয়। সত্যি বলতে কি শেফশোয়ান আমার কাছে অপূর্ব সুন্দর লেগেছে যদিও খাড়া পাহাড়ে উঠতে কষ্ট হয়েছে!

আর বেশি কিছু লিখলাম না। আসলে লিখে আমি আসল সুন্দরকে আমি প্রকাশ করতে পারছি না। ঐযে বলে না? কিছু কিছু সুন্দর মনে গেঁথে যায়, ভাষায় বললে কম হয়!

(কিছু তথ্য উইকিপিডিয়া এবং স্থানীয়দের কাছে থেকে সংগ্রহ করা)