জর্ডান ভ্রমণের তৃতীয় দিন। আজ যাচ্ছি দক্ষিন জর্ডান ভ্রমণে। প্রথম গন্তব্য মাদাবা শহর। তারপর আল-কারাক নামে অন্য একটি শহরেও যাবো। মাদাবা শহর বিশ্ব জুড়ে নাম কুড়িয়েছি প্রাচীন মানচিত্রের জন্য। বাজেন্টাইন সময়ের এই মোজাইক মানচিত্র, বিশ্বে খুঁজে পাওয়া পুরোনো মানচিত্র গুলোর মাঝে অন্যতম।
মাদাবাতে মোজাইকের মানচিত্র দেখবার পর একটু কফি বিরতি নিলাম। মাদাবা শহরের একটি রেস্টুরেন্টে খেলাম কুনাফা আর কফি। জর্ডান ভ্রমণে কেউ কুনাফার স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেটি হবার নয়। যদিও এটি ফিলিস্তিনের একটি মিষ্টি জাতিয় খাবার। অনেকের কাছে কুনাফাকে “প্যালেস্টাইন পেস্ট্রি” বলে খ্যাত। কিন্তু এখন জর্ডানে দারুন জনপ্রিয়।
আরো পড়ুন ওয়াদি রাম
গাইড ইয়াসির তাড়া দিচ্ছিল পরের গন্তব্যে যাবার জন্য। বাইরের তাপমাত্রার প্রদাহ থাকলেও মাদাবার মোজাইক মানচিত্র আর কুনাফা দারুন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সাথে পরের গন্তব্য দেখবার আকুলতা তো রয়েছেই । জর্ডানের প্রতি বাঁকে বাঁকে আমি বিস্মিত হয়েছি। এই সব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি এসে পৌঁছল আল-কারাক নামক একটি ছোট শহরের উপকণ্ঠে। গাড়ি থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম সামনে একটি অর্ধভগ্ন দুর্গ। নাম কারাক ক্যসেল (Kerak or al-Karak Castle)। কারাক ক্যাসেল একটি ক্রুসেডার ক্যাসেল। এর আগে আমি কখনও ক্রুসেডার ক্যাসেল দেখিনি। পুরো জর্ডান জুড়েই ১৫/২০টি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। কারাক ক্যাসেল সহ আমার ভ্রমণ লিস্টে রয়েছে মাত্র দুটি দুর্গ ভ্রমণ।
সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১,০০০ মিটার উপরে এই দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। এই ছোট্ট শহরটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছে এই দুর্গটি। মধ্যযুগীয় কারাক ক্যাসেল অভিমুখে এগুতে থাকলাম। কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়লো বাম দিকে একটি কামান বসানো রয়েছে। চোখ বুলিয়ে নিয়ে, সামনের কাঠের ব্রীজের দিকে গেলাম। ব্রীজ পার হবার সময় চোখে পরলো দুর্গের সামনের কৃত্তিম খালটি। পুর্বে নিশ্চয়ই স্থায়ী ব্রীজটি ছিল না।
ব্রীজ পার হয়ে মুল ফটকে প্রবেশ করলাম। বিশাল বিশাল পাথর খন্ড দিয়ে তৈরী হয়েছে দুর্গ। দুর্গের দেয়াল বেশ পুরু। ইয়াসির বললো প্রায় ৪০ ইঞ্চি পুরু দেয়ালগুলো। সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা উঠবার পর পেলাম হল ঘরের মত একটি স্থান । এমাথা ওমাথা দেখা যাচ্ছে। অর্ধচন্দ্র আকৃতির দরজা ও ছাদের আদল এখনও অটুট রয়েছে। ভেতর থেকে সামনে নজর রাখবার জন্য, তীর ও গোলা বর্ষণের ছোট বড় ছিদ্র গুলোই বলে দিচ্ছে এটি একটি দুর্গ।
ইয়াসির এই হল ঘরটির ব্যাখ্যা দিচ্ছিল – এখানে সৈনিক সমাবেশ হতো। সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেশ অনেকটা নীচে নেমে গিয়ে পেলাম হাজতখানা, কমান্ডারের বাসস্থান, রন্ধনশালা, জলাধার ও ছয় মাসের খানা মজুত রাখবার বেশ বড় গুদাম। এই স্থান গুলো সব মাটির নীচে ।
তবে দুর্গের অনেক স্থাপনাই একেবারে ধব্বংসপ্রাপ্ত। কিছু স্থানে পাথরের দেয়াল রয়েছে কেবল, কোন অবয়ব নেই। দেখে বোঝার উপায় নেই সেখানে কি ছিল আসলে। দুর্গের একদম উপর থেকে দেখছিলাম ডেড সী, পৃথিবীর সব থেকে নীচু স্থান। মনটা কিছুটা চঞ্চল হলো। কবে দেখবো ডেড সী! ছেলেবেলা থেকে ছবি দেখে এসেছি পানিতে মানুষ ভেসে রয়েছে। নিজে অভিজ্ঞতা নেবার খুব কাছাকাছি সময়ে আমি উপস্থিত।
ইয়াসিরের ডাকে ক্রুসেড ক্যাসেলে ফিরে এলাম। দুর্গের তিন দিকে খাড়া পাহাড় আর একদিকে শহর। মধ্যযুগে নিশ্চয়ই শহর এরকম ছিল না, বসতি কম ছিল কারন শহরের পথও দেখছি পাহাড় কেটে তৈরী। দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে এই দুর্গ আক্রমণ খুব সহজ ছিল না বোধ করি।
ক্যাসেলের চারদিকে হেঁটে কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল। দুর্গের একটি কোনায় বসে আমি আর ইয়াসির জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। আমরা ক্রুসেড যুদ্ধ নিয়ে আলাপ করতে করতে অল্প করে একটু ক্রসেডের ইতিহাসে প্রবেশ করি। ইসলামিক ইতিহাসে ক্রুসেড একটি গুরুত্বপুর্ন অধ্যায়। ক্রুসেড মূলত ধর্মযুদ্ধ। যার ধর্মীয় অনুমোদন দিয়েছিলেন পোপ দ্বিতীয় আরবান ও খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চ। বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে জেনেছি, ক্রুসেড একটি ফরাসী শব্দ। মুসলিমদের নিকট ক্রুসেডাররা ফ্রাংক নামে পরিচিত ।
আরো পড়ুন নাটোরে দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি পরিভ্রমণ
ক্রুসেড শুরু হয়, যখন সেলজুক তুর্কিরা বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করে কনসটান্টিনোপোল হতে জেরুজালেম ও দামেস্ক পর্যন্ত দখল করার পর হতেই। বাইজেন্টাইন রাজা প্রথম আলেক্সিস সমগ্র এশিয়া মাইনর হারাবার ভয়ে পোপের নিকট এ অঞ্চলে খ্রিস্টানদের অস্ত্বিত্ব বাঁচাতে সাহায্যের আবেদন করেন। তাঁর আবেদন ছিল খ্রিষ্টান শহর বলে দাবীকৃত কনসটান্টিনোপোল এবং জেরুজালেম উদ্ধার। শুরু হয় ক্রুসেড।
ক্রুসেড চলে প্রায় দুই শত বছর। এর মাঝে জেরুজালেম ও দামেস্ক বহুবার হাত বদল হয়। ক্রুসেড যুদ্ধের অঞ্চলটি ছিল তৎকালীন লেভান্ট, যা এখন বিশ্ব মানচিত্রে সিরিয়া, ইসরাইল, লেবানন এবং জর্ডান পর্যন্ত । গাইড বলছিল লেভান্ট অঞ্চলের মাঝে কারাস ক্যাসেলই সব থেকে বড়, আয়তনের বিচারে। এই কথার সত্যতা কতটুকু রয়েছে জানি না। ক্রুসেডাররা যুদ্ধের উপকরণ সংরক্ষন ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এই সব দুর্গ নির্মান করে। ইতিহাস মনে করছিলাম আর ভাববার চেস্টা করছিলাম ক্রুসেড যুদ্ধের সময় এই ক্যাসেল আসলে কতটা প্রানচঞ্চল ছিল। সাথে সাথে এটিও মনে হচ্ছিল, যুগে যুগে ধর্ম ও দেশ দখলের অভিপ্রায় থেকে কতই না প্রান ঝড়েছে। একবিংশ শতাব্দীতেও কি যুদ্ধের দামামা থেমেছে !!
কারাক ক্যাসেল নির্মান হয়েছিল ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে। সালাউদ্দিন আইয়ুবী ১১৮৯ অব্দে এই অঞ্চলে মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । সেসময় সালাউদ্দিনের প্রতিপক্ষ ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম রিচার্ড যিনি ইতিহাসে রিচার্ড দ্য লায়ন নামে পরিচিত। বীরত্বের কারণে ফ্রাংকরাই সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে সালাদিন দ্য গ্রেট নামে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে।
এবার ফেরার পালা, নীচে নেমে কাঠের ব্রীজ দিয়ে বেরুবার সময় আবার কামানের কথা মনে এলো। কাছে গিয়ে মধ্যযুগের কামানটি ছুঁয়ে দেখলাম। সেই কামানের সামনে নিজের একটি স্মৃতি না ধরে রাখার কারন নেই। ছবি তুলে দিয়ে ইয়াসির বললো , “Our next destination Mount Nebu“ !!
পড়ুন এলিজা বিনতে এলাহীর আরো লেখা
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।
আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।