পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আক্রান্ত কোভিড -১৯ ভাইরাস দ্বারা। আক্রান্তের ধরণটা শুধু ভিন্ন। মেলবোর্ন বাসীরা ঘর বন্দি ছিল ১১১ দিন লক ডাউনে। আমি হেলথ সেক্টরে থাকার কারণে ঘরে বন্দি ছিলাম না, কিন্তু প্রতিদিন রোগী দেখতাম মনে একটা ভয় নিয়ে আর সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগতো সারাদিন পর বাসায় ফিরতে। আমার দ্বারা বাসায় থাকা ছেলেরা যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। মনে হয় প্রতিদিনের এই অল্প অল্প ভয় আমার ভিতরে একটু একটু সাহসের সঞ্চার করেছে। আমি প্রায়ই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি।

বহুদিন থেকে সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনে আসছি ভিক্টোরিয়া স্টেটের মেলবোর্ন – সোরেন্টো (Sorrento) – কুইন্সক্লিফ (Queenscliff) – মেলবোর্ন রাউন্ড ট্রিপের কথা। কিন্তু দুই ছেলে নিয়ে কখনো সাহস করিনি। কিন্তু লক ডাউনে কোনো একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, কোভিড-১৯ পরিস্হিতি স্বাভাবিক হলে, এবার যাবই। অবশেষে শুরু করলাম রাউন্ড ট্রিপ জার্নি। সকালে বাসা থেকে ড্রাইভিং শুরু, মর্নিংটন পেনিনসুলা (Mornington Peninsula) , এঙ্চেন্টেড (enchanted) এডভেঞ্চার গার্ডেন, আর্থার সিট (Arthur’s seat) লিফ্ট চেয়ার, সরেন্টো-কুইন্সক্লিফ ফেরী, জিলং হয়ে রাতে বাসায় ফেরা – প্রায় ৩০০ কিমি রোড ট্রিপ। অনেকে হয়তো ভাবছেন, এটা কোনো ব্যাপার না, কিন্তু আমার জন্য এটাই ছিল প্রথম এতো লম্বা রোড ট্রিপ। লক ডাউনের পরে আমি এবং আমার ছেলেরা বেশ উপভোগ করেছি আমাদের এই রোড ট্রিপ। চলুন আমার সাথে ঘুরে আসি ৩০০ কিমি।

আমি সবসময় খুব প্ল্যান করে সব কিছু করি। ২ দিন আগে থেকেই সব প্ল্যান করে রেখেছি কখন, কোথায় যাব। গাড়িতে সব কিছু নিয়ে রওনা হই সকাল সকাল। প্রথম স্টপ এঙ্চেন্টেড এডভেঞ্চার গার্ডেন, পথে থেমেছি সেফটি (Safety) বিচে। মর্নিংটন পেনিনসুলা – ভিক্টোরিয়া স্টেটের একটি অসাধারণ সুন্দর জায়গা।আর এখানেই ২২ একর জায়গা জুড়ে অবস্হিত এঙ্চেন্টেড এডভেঞ্চার গার্ডেন। এটি পুরা দিন ধরে ঘোরার জায়গা। কিন্তু আমরা কাটিয়েছি প্রায় ৩-৪ ঘন্টা। ছেলেরা স্কুল থেকে আগে বহুবার জিপ লাইনিং করেছে , তাই ওটা বাদ দিয়ে আমরা বাকি গার্ডেনটা ঘুরে দেখলাম। খুব সুন্দর প্ল্যান করে তৈরী করা এই গার্ডেন।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আর্থার সিট লিফ্ট চেয়ার। ১৯৬০ সালে এই লিফ্ট চেয়ার শুরু হয়। ১ কিমি লম্বা জার্নি করতে সময় লাগে প্রায় ২০ মিনিট। ৩০৫ মিটার উপরে ওঠার সময় চোখে পরে মর্নিংটন পেনিনসুলার গভীর নীল সমুদ্র আর পাহাড়ের ভিতর দিয়ে যাওয়া আঁকা বাঁকা রাস্তা। টিকেট আগে কাটা থাকলেও লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। যাই হোক ৩০৫ মিটার উপরে বুক ভোরে ফ্রেশ বাতাস নিয়ে রওনা দিলাম সরেন্টোর দিকে।

এঙ্চেন্টেড এডভেঞ্চার গার্ডেন

ফেরীর ভেতরে

সরেন্টোতে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ফেরী ঘাটে রওনা দিলাম। আন্দাজ করেছিলাম যে এই ফেরী ঘাট বাংলাদেশের মতো হবে না, কিন্তু সৌভাগ্য ক্রমে ঘাটে যেতেই টিকেট লাইনে গাড়ী নিয়ে দাড়ানো মাত্রই ওয়ান ওয়ে টিকেট কেটে সোজা ফেরীতে। ওদের পার্কিং প্রসেস বেশ টেকনিক্যাল এবং নিখুঁত।

বাংলাদেশে আমি বহুবার ফেরীতে উঠেছি। কিন্তু ছেলেদের জন্য এটাই প্রথম অভিজ্ঞতা। গাড়ী পার্ক করে উঠে গেলাম উপুরে। ঘুরে ঘুরে ফেরীটা দেখার পর আমি বসলাম ভিতরে , কিন্তু ছেলেরা ঘুরে দেখছে। ঠিক তখনি ফোন করলো আমার ছোট বোন পার্থ থেকে। ওকে বললাম আমরা এইমাত্র ফেরীতে উঠেছি। ও বললো, “আপা, এখানে আরিচা ঘাটের মতো ভাত পাওয়া যাচ্ছে না?” মনে পরে গেলো, ছোট বেলায় নানী আর দাদার বাসায় যাওয়ার কথা। আরিচা ঘাটে গাড়ীতে লম্বা সময় লাইন বসে থাকা, ফেরিতে উঠে ঝাল মুড়ি খাওয়া, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে বসে আম্মার নিয়ে আসা পরোটা মাংস খাওয়া। কিন্তু এই ফেরীতে বসে আমি খেলাম এক কাপ কফি। ৪৫ মিনিটে পোঁছে গেলাম কুইন্সক্লিফ।

কুইন্সক্লিফ থেকে সোজা চলে গেলাম জিলং। বহুবার এসেছি এই শহরে। গাড়িতে একটু ঘুরে চলে গেলাম কাননিংহাম পিয়ার। আমার ফেরিস হুইল দেখালেই, শুধু চড়তে ইচ্ছে করে। ছেলেদের ইচ্ছে না থাকলেও, আমার জন্য ওরাও চড়লো ফেরিস হুইলেl তারপর ওয়েস্টার্ন বিচ ঘুরে এবার ফেরার পালা। গাড়ী চলছে ১০০ কিমি বেগে, আর আমি মনে মনে বেশ খুশী। অনেক দিনের একটি ছোট্ট ইচ্ছা পূরণের খুশি । আর ঠিক ওই মুহুর্ত্বে ফোন এলো আম্মার বাংলাদেশ থেকে। ছুটির দিনে আমি সাধারণত ২-৩ বার আব্বা-আম্মার সাথে কথা বলি। আজকে যেহেতু সকাল থেকে ফোন করিনি, তাই আম্মা চিন্তিত হয়ে ফোন করেছেন। আমি যেহেতু ড্রাইভ করছি, তাই ফোন ধরেছে আমার ছোট ছেলে, যার পেটে কোনো কথা থাকে না। সে খুব বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছে আম্মাকে আমাদের সারাদিনের ঘোরার। আমিও বুঝতে পারছি এপাশ থেকে যে আম্মার ব্লাড প্রেসার নিশ্চয়ই এতক্ষনে হাই হয়ে গেছে। যাই হোক ঠিকমতো বাসায় পোঁছে খবর দিলাম আম্মা আব্বাকে। ভাবতেই ভালো লাগে, আমি যত বড় হয়ে যাই না কেন, এখনো আব্বা আম্মা আমার জন্য সবসময় চিন্তা করেন। এই কোভিদ-১৯ এ, আমাদের মধ্যে অনেকেই হারিয়েছেন তাদের বাবা মাকে, আর সবচেয়ে বেশী কষ্টের হলো, ট্রাভেল রেস্ট্রিকশনের জন্য যারা যেতে পারেননি। এপারে এবং ওপারে থাকা সব বাবা মায়েদের জন্য অনেক দোয়া থাকলো।

৩০০ কিমি এই রাউন্ড ট্রিপের অভিজ্ঞতটা আমার জন্য একটা বড় এডভেঞ্চার। এবং তারপর থেকে আমি এখন প্ল্যান করি আরো দূরে যাবার, আরো চ্যালেন্জিং ট্রিপের।