পাহাড়ের গা বেয়ে ইয়ারা রেঞ্জ বনভূমির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা ব্ল্যাক স্পার ড্রাইভ। মেলবোর্নের অনেক সুন্দর জায়গা এবং সেরা নৈসর্গিক ড্রাইভগুলির মধ্যে ব্ল্যাক স্পার ড্রাইভ অন্যতম।  হিলসভিল (Healesville) থেকে ম্যারিসভিল (Marysville) এর মাঝে মারুন্ডা হাইওয়ের (Maroonda Highway) প্রায় ২৮ কিমি লম্বা এই ড্রাইভটি। ইয়ারা রেঞ্জ বনভূমিতে পাওয়া যায় পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা ফুলের গাছ – মাউন্টেন অ্যাশ  (Eucalyptus Regnans)। এছাড়া এখানে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ট্রি ফার্ন।

মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে উৎসাহিত করা ও ভ্রমণে আগ্রহী করে তোলাই ঘুরুঞ্চির উদ্দেশ্য। সে ধারাবাহিকতায় ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আয়োজনে ২ এপ্রিল ২০২৩ ঘোরাঘুরির (বুশ ওয়াকিং) আয়োজন ছিল ব্ল্যাক স্পার ড্রাইভ পাশ ঘেসে মোরলি ওয়াকিং ট্রেকে।  এই আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন মেলবোর্নের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কয়েকটি পরিবার। যদিও রোজার কারনে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আরো অনেক পরিবার যুক্ত হতে পারেননি।

খুব রোদ ঝলমলে সুন্দর শরতের একটি দিন ছিল। সকালে ৯ ডিগ্রীতে তাপমাত্রা দিয়ে দিন শুরু হয় কিন্তু সকাল ১০ টা নাগাদ তাপমাত্রা ১৫ এবং মধ্যাহ্নর সময় ২২ ডিগ্রীতে পৌঁছে যা ছিল খুব আরামদায়ক।  আমাদের বুশ ওয়াকিং শুরু হয় ফার্নশ (Fernshaw) পিকনিক গ্রাউন্ড থেকে। ব্ল্যাক স্পার ড্রাইভ আর ওয়াটস (Watts river) নদীর পাশ দিয়ে চলছিলাম। প্রথম দিকে ব্ল্যাক স্পার ড্রাইভ থেকে আসা গাড়ির শব্দে সবাই বিরক্ত হচ্ছিলো কিন্তু ট্রেক ধরে কিছুক্ষন হাঁটার পর গভীর বন শুরু হতেই সব শব্দ মিলিয়ে গেলো। এসময় কলকল ধ্বনিতে ওয়াটস নদীতে বয়ে চলা পানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো।

একটানা পানি প্রবাহের শব্দ খুবই শ্রুতিমধুর। চলমান পানি প্রবাহের শব্দ আমাদের মনে প্রশান্তি এনে আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন পানি প্রবাহের শব্দ আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং যে শব্দ আমাদের কানে গেলে আমরা বিরক্ত হই সে শব্দগুলো পানি প্রবাহের শব্দের নিচে চাপা পড়ে যায়। গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে পানির শব্দ আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোনাল তরঙ্গগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ফলে একটি শান্ত প্রভাবের তৈরি হয়। আমরা পানি প্রবাহের শব্দ শুনতে শুনতে সামনে এগিয়ে গেলাম।

আজকের বুশ ওয়াকিং কিছু গাছ চেনানো হয় এবং বর্ণনা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও দুই ধরণের বুশ টাকার (bush tucker) বেড়ি নেটিভ প্রিকলি কারান্ট (Coprosma quadrifida) এবং নেটিভ রাসবেরির (Rubus Parvifolia) সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।। দুর্ভাগ্য, রোজা থাকার কারনে আগত ঘুরুঞ্চির  দল এই দুর্লভ বুশ টাকার ফুড পরখ করে দেখতে পারেন নি।

ট্রেক ধরে প্রায় ৩ কিলো পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমরা অনেক গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলাম তখন একটা ভেঙে পড়া গাছের কোটরে অনেকগুলো স্টিনক (stink) দেখতে পেলাম। আমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিলাম।  স্টিনকগুলো প্রথম দিকে আমাদের ভয় পেলেও কিছুক্ষন পর ছোট বাচ্চা সাইজের গুলো বাইরে এসে ছোট ছোট মাছির ধরার জন্য ছুটাছুটি করতে থাকলো। বড়ো গুলো গাছের কোটর থেকে আস্তে আস্তে মাথা বার করে আমাদের দেখতে থাকলো। আমরা সামনে আগাতে চাইলাম কিন্তু আমার ছেলে নোমান তো ওদেরকে রেখে যাবেই না। ফলে, আরো কিছক্ষন ওদের দেখে তারপর সামনে আগালাম।

আরো প্রায় কিলোমিটার পথ যাবার পর ঘন জঙ্গলের জন্য ট্রেকটি আর বোঝা যাচ্ছিলো না। আমরা সতর্কভাবে সাংকেতিক চিহ্ন খুঁজে পেয়ে সেগুলো দেখে পথ এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু এভাবে কিছুদূর যাবার পর সাথের আর কেউ সামনে এগুতে চাইলো না। মূলত এই ট্র্যাকটি ছিল গ্রেড ৩ (গ্রেডিং সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন) অর্থাৎ যাদের পূর্বে বুশ ওয়াকিং অভিজ্ঞতা আছে তাদের জন্য। আমরা একই পথে ধরে ফিরে এলাম।

ফার্নশ পিকনিক গ্রউন্ডে ফিরে এসে ঝকঝকে রোদ দেখে আমরা একটা পিকনিক টেবিলে গিয়ে বসলাম। রোজা থাকায় এবারে কোনো খাবারের ব্যাবস্থা ছিল না। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার পিকনিক ম্যাট বিছিয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। এর মাঝেই দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। আজ থেকে ডে লাইট সেভিং চালু হলো ফলে বিকেলের আলো এক ঘন্টা কমে গিয়েছে। বাড়ি ফিরে ইফতার ধরতে সবাই সময় হাতে নিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরলো ।