আমার স্ত্রীর খুব শখ আর স্বপ্ন ছিলো অষ্ট্রেলিয়ার তথা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবাল দ্বীপগুলোর একটা যেটা, গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ দেখা। এই রীফ হচ্ছে সমুদ্রের পানির নীচে প্রবাল প্রাচীর, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, কোরাল নামক সামুদ্রিক জীবের মৃত অংশাবশেষ। মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে যে কটি বড় প্রাকৃতিক নিদর্শন দেখা যায় জিবিআর (গ্রেট ব্যারিয়ার রীফের সংক্ষেপ) তার মধ্যে অন্যতম। যদিও তার শখের লিস্ট খুব বেশী নয় এবং সবই পুরন যোগ্য, এইটা বড় দুটোর একটা এবং খরচের দিক থেকে দ্বিতীয়। অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে বেশ বড় সময় কাটালেও এটা দেখার সামর্থ্য হয়নি। সবাই বলে এটা নাকি সপ্তম প্রাকৃতিক আশ্চর্যের একটি। আবার শুনেছি মরার আগে কেও প্রথম সারির দশটা জিনিস দেখতে পরিকল্পনা করলে, এটা নাকি তার মধ্যে পড়বে। তাই মনে হলো পরিকল্পনা করি, কারন এখানে অষ্ট্রেলিয়া থেকে এটা যদি না দেখতে পারি তা কেমন হয়। তোড়জোড় শুরু হল। আমাদের এক বন্ধু পরিবার যোগ দিতে রাজি হোলো। ভ্রমন একা করার চেয়ে বন্ধুদের সাথে করতে বাড়তি আনন্দ জোটে। বন্ধু পত্নী তথা আমাদের ভাবী জানালেন প্রবাল নাকি ব্লীচ হয়ে নষ্ট হতে হতে একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই তার আগেই আমাদের দেখে আসা উচিত।

আমার স্ত্রীর আগ্রহে আমরা সবাই রাজী হলাম। সে মহা উৎসাহে হোটেল খুঁজলো। আমাদের ছেলেমেয়েরা লেগে গেলো পরিকল্পনা করতে কি কি করতে হবে বা করা যাবে মোটামুটি বাজেটের মধ্যে। তারপর একদিন সেই বিমান ভ্রমনের সময় ঘনিয়ে এলো। মেলবোর্ন থেকে কেয়র্নসের দুরুত্ব তিন হাজার কিলোমিটারের উপর। বিমানে সাড়ে তিন ঘন্টার কাছাকাছি। আমরা বিকালে হোটেলে পৌঁছালাম এয়ারপোর্ট থেকে উবারের মাধ্যমে গাড়িতে। হোটেলটি ছিলো এপার্টমেন্ট যা প্রতিদিন কর্মীরা পরিচ্ছন্ন করে দেয়। বিকেলের মধ্যে আমরা সেন্ট্রাল শপিং সেন্টার থেকে টুকটাক দরকারী বাজার করে আনলাম। ম্যাপ দেখে রাস্তাঘাটের ওরিয়েন্টেশন বোঝার চেষ্টা করলাম। কেয়র্নসের একদিকে গ্রেট ব্যারিয়ার রেন্জ পর্বতের অংশ মাউন্ট হুয়িটফিল্ড আর একদিকে গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ, সেজন্যই এখানকার পর্যটন শিল্পের প্রতি বছরের ব্যাবসায়িক মূল্য পঁচিশ হাজার কোটি টাকা। অনেক হোটেল, মোটেল, ট্যুর গ্রুপস্, মানুষের কাজ, চাকুরী এই পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত।

এই সময়টাই এখানে গরম আবহাওয়া। অনেকে অষ্ট্রেলিয়ার দক্ষিনে যখন শীতের সময় জুন জুলাই মাসে, তখন উত্তরে ট্রপিকাল গরম আবহাওয়ায় বেড়াতে যায়। আমাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা শেষ হলো এসময়ে তাই গরম হলেও আমাদের এই সময়টা বেছে নেয়া ছাড়া উপায় ছিলো না।

হোটেলের রিসেপসনে খোঁজ নিতে গেলে কেয়র্নসের বড় বড় আকর্ষণ গুলির মধ্যে বললো – জিবিআর, কুরান্ডা সিনিক রেলওয়ে, ট্রপিকাল রেইন ফরেষ্ট যার ওপর থেকে রোপওয়ে দিয়ে নামতে হয় তথা স্কাই ওয়ে – এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের জংগলে এবং এক সময় পাহাড়ের পাদদেশে। আরো আছে কুমিরের চিড়িয়াখানা ও কুমির চাষের জায়গা, কোয়াড বাইক – চার চাকার শক্তিশালী ইন্জিন চালিত গাড়ী চালানো উঁচুনিচু রাস্তায়, ঘোড়ায় চড়া ইত্যাদি যেগুলো আমরা করেছিলাম। আশপাশে অনেক সুন্দর সুন্দর সমুদ্র সৈকত আছে, যেমন পোর্ট ডগলাসের ফোর মাইল বিচ।

আজ ভোর সকালে এসপ্লানাডের সমুদ্র তীরের ধার ঘেসে কাঠের পাটাতন বা প্রমিনেড বোর্ড ওয়াক ধরে হাঁটছিলাম। ডেভিড নামের এক বুড়ো ভদ্রলোক এসে আলাপ শুরু করলো গত নভেম্বর মাসে এক মহিলাকে আর তার আরো কিছু মাস আগে এক বৃদ্ধা মহিলাকে লকেয়র্নস্ উত্তর অন্চলে সবচেয়ে বড় শহর, আশপাশ মিলিয়ে লোকসংখ্যা দুলাখের মত। শহরটা ছোট হলেও বেশ গোছানো, আর্ট গ্যালারি, যাদুঘর, লাইব্রেরি অন্য সব শহরের মতো এখানেও রয়েছে। আমরা বিশেষ ভাবে সাজানো নাইট মার্কেটেও গিয়েছিলাম। ব্যারোন নদী শহরের উত্তর পাশে আর চায়নাম্যান ক্রীক বা খাল দক্ষিন দিক দিয়ে কোরাল সাগরে মিশেছে। নদীগুলো ও সাগরের সাথে মিলন স্থানের মোহনায় জোয়ার ভাটা পরিস্কার ভাবে দৃশ্যমান। আমরা একবার সন্ধায় আরেকবার সকালে ভাটার সময়ে বড় এলাকা জুড়েই মাড ফ্ল্যাট দেখলাম যেখানে বিভিন্ন জলজ বা উভচর প্রানী দৌড়াদৌড়ি ও কাদা পানির মধ্যে উঠানামা করছে। পুরো কাদা মাখা ভুমিতে কিছু ম্যানগ্রোভ জাতের গাছের চারা দেখলাম প্রাকৃতিক ভাবেই হচ্ছে। অত্যন্ত নৈসর্গিক পরিবেশে সেখানে সুর্যোদয় দেখেছিলাম এক ভোরে।

বনাক্ত পানির পাঁচ মিটার লম্বা কুমির ধরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলেছে। এই কুমির গুলো সাত মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। সে দুজনকেই নাকি চিনে। সে এখানে তিরিশ বছর আগে মেলবোর্ন থেকে এখানে এসে স্থায়ী হয়েছে। এখন পেনশন পায় আর বিনে পয়সায় লোকেদের এখানকার ইতিহাস, লিজেন্ড, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বেড়ায়। তার হাতে কম্বল ব্যাগের পোটলা দেখে আমার ধারনা সে একটু ভবঘুরে টাইপের লোক তবে খারাপ নয়। সে অাগে কুমিরের পিছনে ঘুরত এবং কিছু ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বললো। একবার কুমিরের তাড়া খেয়ে ম্যানগ্রোভ জংগলে গাছে উঠতে গিয়ে দেখল খুবই পিচ্ছিল গাছ। কোনো রকমে ডাল ধরে ঝুলে ছিলো। তার কথায় কুমির তার ভিতর থেকে যীশু খৃষ্টকে বের করে আনছিলো। এটা অনেকটা আমাদের দেশের হায় আল্লাহ কি হবে টাইপের ভাষা প্রকাশের মত, এখানকার লোকেরা যেভাবে প্রায়ই বলে বিপদের সময়ে।

প্রথম মেয়েটি নাকি তার বিশেষ কোনো দিন পালন শেষে মদ পান করেছিলো। তারপর তার ছেলে বন্ধুর কোলে চেপে কোমর উঁচু পানিতে কিছু প্রতিজ্ঞা ও ইচ্ছা প্রকাশ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু কুমির সেখানে আগে থেকে ওঁত পেতে ছিলো। কুমিরের শরীরের গঠনের কারনে ও অনেক সেন্সর থাকায় পানির উপরিভাগ কোনোরকম নড়াচড়া ছাড়াই পানিতে চলাচল করতে পারে। নিমিষেই কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটিকে তার বয়ফ্রেন্ডের দুহাতের উপর পানিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় কুমির সেখান থেকে তড়িৎ গতিতে নিয়ে যায়। আর কোনোদিন তাকে পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় বৃদ্ধা মহিলা লাঠি ধরে পানির কিনারে হাঁটছিলেন। ডেভিডের সাথে দেখা হতে ও জিজ্ঞেস করেছিলো তোমাকে তো এখানকার মনে হচ্ছে না। মহিলা বলেছিলেন ক্যানবেরা থেকে এসেছেন। ডেভিড সাবধান করেছিল পানির বেশী ধারে না হাঁটতে। পরে শুনলো ঐ বৃদ্ধাকে কুমির ধরে নিয়ে গিয়েছে। দুর পাহাড় দেখিয়ে বললো ওখানে ইয়ারাবা আদিবাসীরা বাস করে। তাদের কুমির পানিতে আছে কিনা তা পরিক্ষা করার অভিনব পদ্ধতি আছে। একটা কুকুরকে তারা বারংবার ছুঁড়ে ফেলবে পানিতে। যদি কুমির থাকে সে কুকুরের উপর হামলা করবে। যদি কুকুর অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসে তবে কুমির নেই ঐ জায়গাটাই। তখন মানুষ পানিতে নামে। তারা বড় একটা কুমির শিকার করেছিলো যেটার পেটের মধ্যে মানুষের হাত পাওয়া গিয়েছিলো।

এই শহরে আদিবাসীদের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশী। যদিও দুর উত্তর কুইন্সল্যান্ড রাজ্যে নতুন অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে, সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে তবুও আদিবাসী দের এখনও বেশ কিছু সমস্যা আছে। আমরা শহরের কেন্দ্রে আর্ট গ্যালারি দেখে আসছিলাম যেখানে তাদের জীবন যাত্রাকে অঙ্কন চিত্রে দেখানো হয়েছে। এদের কেও কেও আদিবাসীদের মধ্য থেকে এসে অনেক বিখ্যাত আঁকিয়ে হয়েছে।

শহর দেখে আসার সময় দেখলাম এ্যমবুলেন্স কর্মীরা একজন পন্চাশোর্ধ লোককে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে শুয়ে থাকবে না এবং এক পর্যায়ে প্রথমে পুরুষ সেবা কর্মী ও পরে মহিলা কর্মীর সাথে ধস্তাধস্তি করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কয়েকজন লোক এসে তাকে ছেড়ে দিতে বলল, তখন সেবা কর্মীরা তাকে যেতে দিলো। সে স্লিপারের মধ্যে পা গলিয়ে টলতে টলতে চলে গেল রাস্তা ধরে। বোঝাই যাচ্ছে অতিরিক্ত মদ পান করে রাস্তায় লোকদের বিরক্ত করতে পারে এজন্য তাকে হাসপাতাল বা কোনো সেবা কেন্দ্রে নেয়ার চেষ্টা হতে পারে। পুলিশ হস্থক্ষেপ করলে বিষয়টি সংবেদনশীলতার মূল্যে ঝুঁকিপুর্ন হতে পারে। পরে লোকটাকে দেখলাম আরো কজন আদিবাসী বালক ও যুবকের সাথে মিলে আড্ডাবাজি করছে রাস্তার পাশে। এদের কাওকে কাওকে নিয়মিত কাজের পরিবেশে আনা কষ্টকর।

সন্ধায় রাস্তায় দেখলাম আদিবাসী বয়স্ক মহিলারা মাতাল অবস্থায় চিল্লাচিল্লী ও ঝগড়াঝাটি করছে। এটাই তাদের সময় কাটানোর সাধারন নিয়মিত জীবন। কিছু এলাকা একটু রাফ মনে হোল।এরা পর্যটকদের তেমন কিছু না করলেও সামাজিক ভাবে অপ্রীতিকর দৃশ্য। ডেভিড বলছিলো একদিন সে পার্কে বসা এক আদিবাসী মহিলাকে হ্যালো বলতেই সে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না, কারন তাদের কেও কখনো হ্যালো বলে না। তারপর সেই পরিবার ডেভিডকে তাদের পরিবারে দাওয়াত দিয়ে তাবুতে নিয়ে মদ আর মুরগীর মাংসের খাবার দিয়েছিলো, কম্বল শেয়ার করেছিলো। ডেভিডের অনুভুতি ছিলো বলল, তার নিজেকে তখন রাজা রাজা মনে হচ্ছিল।

জোয়ারের সময় পানি একেবারে হাঁটার রাস্তার ধারে চলে এসেছে। কিছু ম্যানগ্রোভের চারা গজিয়েছে। এগুলো তুলে অন্য জায়গায় সরিয়ে লাগানো হয় নিয়মিত ভাবে যাতে পর্যটক দের দৃষ্টির বাধার কারন না হয়। ওখানে কুমির বাস করে এরকম সতর্ক বার্তা রয়েছে যে কুমিরের আক্রমণে আহত হওয়ার সম্ভাবনা বা মৃত্যু হতে পারে। তাই পানি থেকে দুরে থাকতে বলা হয়েছে। ইংরেজীতে ড্যান্জার, জার্মান ভাষায় আকতুং ও আরো কয়েকটি ভাষায় ও রয়েছে। আমরা কুমির কে নিয়ে বিভিন্ন ভীতিজনক উত্তেজনাপূর্ণ বিনোদন মূলক কাজ ও কৃত্তিম চাষ করা হয় এমন জায়গায় গিয়েছিলাম।

ট্যুর গাইড অনেক তথ্য দিলো কিভাবে মূলত চামড়ার জন্য ধাপে ধাপে ডিম চুরি করে তা করা হয় কৃত্তিম ভাবে। কুমিরের মাংসের ও চাহিদা আছে। যে লোকটি খুব বড় একটা লবন পানির কুমিরকে নিয়ে বিভিন্ন খেলা দেখালো সে বলল কেনো যে জার্মান ভাষায় লেখা হয়েছে, যেখানে একজন মাত্র জার্মান মেয়ে পর্যটক কে কুমির ধরেছিলো একবার। তাও গাইডের দোষে কারন গাইড বলেছিলো সেখানে কুমির নেই তাই সাঁতার কাটা যাবে। সিংহভাগ আক্রান্ত লোকেরা স্থানীয় অধিবাসী, সে বলল। যাহোক কুমির বিষয়ে অনেক চমকপ্রদ তথ্য দিলো এবং মেসেজটা দিলো যে কুমিরের দেশে চলাফেরার সাধারন জ্ঞান প্রয়োগ করতে হবে নিরাপত্তার জন্য, সেটা কুমিরের জন্য ভালো আর নিজের জন্যও। সেও কিছু উদাহরণ দিলো সাধারন ভূলের কারনে কিভাবে অনেকেই কুমিরের খাবার হয়েছে।

প্রথম দিনই আমরা প্রবাল দ্বীপ দেখেছিলাম। পানির নীচে ডুবুরী দের যন্ত্র পাতি, অক্সিজেন মুখোশ ব্যবহার করে হেটেছিলাম সাগর তলদেশে। আমি চিন্তা করছিলাম এতো মাত্র মিটার পাঁচেকের নীচে, তাহলে আমরা যে এর এক হাজার গুন গভীরে পাঁচ  হাজার মিটার নীচে খনিজ আহরনের গবেষনা করি সেটা না কেমন জায়গা। গভীর বিস্ময়ে দেখেছিলাম মাছের সারি সারি দল ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রানীকূল। আমি বেশ ছোটবেলায় “আরেক জগত সাগর মালা” নামে একটি চমৎকার বই পড়েছিলাম, হতে পারে আমার জীবনে প্রথম পাঠ্যবইয়ের বাইরে সেটা একটা যেটা আমাকে বই পাঠে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। লেখকের নাম মনে নেই তবে বইটির অনেক বিষয় বস্তু এখনও ভালোই মনে আছে। মানুষ নাকি এখনও পাঁচ ভাগের বেশী সাগর সম্পর্কে জানতে পারেনি। সাগরে হিমালয়ের চেয়েও উঁচু পর্বত মালা রয়েছে, ঘোড়া মাছ নিয়ে অনেক তথ্য ছিলো। এ সত্যিই এক গভীর রহস্যের সাগর।

দ্বিতীয় দিন পাহাড়ের উপর দেড়শ বছরের পুরোনো রেল লাইন বেয়ে পনেরটা মানুষের হাতে তৈরী টানেলের মধ্য দিয়ে দুশ মিলিয়ন বছরের পুরোনো রেইন ফরেষ্ট দেখতে দেখতে প্রায় বারোশ ফুট উপরে উঠেছিলাম। গাছগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জংগলের গাছের মত বন্য আম, জাম, নিম, কড়ই, হিজল, তমাল, গাব, কদম, কৃষ্নচুড়া, অনেক কমন লতা পাতা গাছের মত গাছ দেখেছিলাম। আমি কুইন্সল্যান্ড সরকারের কাছ থেকে এই জংগলের গাছের তালিকা অনুরোধ করে আনিয়েছি কদিন আগে। তাতে সাইজিজিয়াম, ডেলোনিক্স ইত্যাদি জেনাসের গাছ পেয়েছি তবে প্রজাতি ভিন্ন।

তারপর পাহাড়ের উপরের কুরান্ডা শহরটা বেড়িয়ে, ব্যারন নদীতে নৌকার উপর থেকে আমাজান বনের চেয়েও পুরোনো প্রায় দুশো মিলিয়ন বছরের আগের রেইন ফরেষ্ট দেখেছিলাম। কিছু লোকেরা সেই সত্তুরের দশকে আন্দোলন করেছিলো এই জংগল জাতীয় উদ্যান ঘোষনা করে সংরক্ষন করার জন্য। সেই লোকদের অনেক সময় হিপ্পি মনোভাবের মানুষ ধরা হয় যারা এই শহরে বসবাস করে অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখে। প্রধান মন্ত্রী বব হকের আমলে এই এলাকার অনেক বড় জংগল ন্যাশনাল পার্ক ঘোষনা করা হয়। ন্যাশনাল পার্ক আর স্টেট ফরেষ্টের তফাত হলো ন্যাশনাল পার্কে লগিং বা গাছ কাটা নিশিদ্ধ। শুধু সংরক্ষনের জন্য ব্যাবস্থাপনা করতে হয়। স্টেট ফরেষ্ট বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যাবস্থাপনা করা হয়। আমি বিশ বছর আগে বোরাল নামে কোম্পানীর দেয়া আমার স্কলারশীপের আওতায় সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পিএইচডির গবেষনার সময়ে এই সব প্রাকৃতিক বন থেকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ইউক্যলিপটাস গাছ কেটে লগ সংগ্রহ করে সমিলে কিভাবে কাঠের তক্তা বানিয়ে কিলনে শুকিয়ে ঘরবাড়িসহ ফার্নিচার শিল্পে ব্যাবহার করতে তা নিয়ে অনেকদিন অবধি কাজ করেছিলাম।

এখন এই ঘরবাড়িসহ ফার্নিচার শিল্পের কাঠের চাহিদার প্রায় পুরোটাই আসে মানুষের হাতে লাগানো রেডিয়াটা পাইন নামের গাছ থেকে যেটার উপর আমার পিএইচডি পরবর্তী গবেষনার কর্মক্ষেত্র ছিলো নিউজিল্যান্ডের রোটোরুয়া বন গবেষনা ইন্সটিটিউটে। পরবর্তীতে সিএসআইআরও তে এই দুই বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন গবেষনায় কাটাতে হয়েছিলো। তাই নিউজিল্যান্ড ও অষ্ট্রেলিয়ার জংগল আমার কাছে নতুন কিছু নয়, আমি নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়াতে কিছু রেইন ফরেষ্ট দেখেছি, তবে কেয়রন্সের রেইন ফরেষ্ট বেশ আলাদা।

আসার সময় ঐ ঘন রেইন ফরেষ্টের গাছের ক্যানোপির একটু উপর দিয়ে রোপওয়ে দিয়ে নেমেছিলাম। নীচে দৃশ্য ছিল সত্যিই অবর্ননীয়, সবুজের সমারোহ যাকে বলা যায় জৈব বৈচিত্র্যের বাজার। ওখানে আমার কর্ম প্রদানকারী অষ্ট্রেলিয়ান সরকারের বিজ্ঞান সংস্থা সিএসআইআরও এর রেইন ফরেষ্ট সম্পর্কে জানার জন্য একটি আকর্ষনীয় শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে।

পরদিন ছেলেময়েরা এ্যাডভেন্চার করেছিল অষ্ট্রেলিয়ান কৃষকদের ছেলেমেয়েদের জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। প্রচন্ড রোদ গরমে কোয়াড বাইক নিয়ে মাঠ ঘুরে দেখে আসতে হবে ফসল এবং গরু বাছুর ঘোড়া ভেড়া সব ঠিক আছে কিনা। বেশ পরিশ্রমের কাজ এখানকার কৃষকদের, সবদেশের কৃষকদের মতোই যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের শহুরেদের খাদ্য যোগায়।আখ থেকে চিনি ও ফলমূল উৎপাদন কৃষকদের প্রধান দ্রব্য। আমরা তাজা ফলমূলের বাজার রাসটি্স মার্কেট থেকে বিভিন্ন জাতের আম, আনারস, দেশী কলা, ড্রাগন ফল, লিচু, তরমুজ ইত্যাদি কিনেছিলাম। ডাবের পানি, নারিকেল, আখের রস ও মিশানো ফলের রস খেয়েছিলাম।

আমি এরই মধ্যে ঘুরেছিলাম খুব সুন্দর ভাবে সাজানো পুরোনো প্রাকৃতিক উদ্ভিদ উদ্যান। আমি অন্তত এক ডজনের উপর ভাল ক্যাটাগরির বোটানিক গার্ডেন দেখেছি। কিন্তু আজকের টা সবচেয়ে ভালো এবং বেশ বড়। একটানা তিন ঘন্টা হেঁটেছিলাম সল্ট ওয়াটারের কুমির থাকতে পারে এমন নদীর কিনারে ম্যানগ্রোভ বনের ধারে ধারে। খুব ভালো সময় কেটেছিলো। এখানে রেইন ফরেষ্ট এবং অষ্ট্রেলিয়ার আদি ভুমি গোন্ডোওয়ানা ল্যান্ড থেকে আজকের অবস্থায় আসা পর্যন্ত উদ্ভিদের অভিযোজন দেখানো হয়েছে। অনেক লম্বা কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেটে হেটে দেখা যায় এসব লতাপাতা জড়ানো গাছগুলো। বেশ কয়েক ধরনের গার্ডেন রয়েছে এখানে মশলা, হার্ব ও ফল থেকে শুরু করে। একটি ৭৩ বছর বয়সী সেগুন গাছ দেখলাম।

এখানে আমার এক সতীর্থ বাংলাদেশী বনবিদ স্থানীয় জেমস্ কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষট ডক্টরাল গবেষক। সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর রেইন ফরেষ্ট ক্যাম্পাস ঘুরে দেখালো যেখানে ট্রপিকাল বন ও প্রানী নিয়ে বড় গবেষনা কেন্দ্র রয়েছে। ওখানে আমার কর্ম প্রদানকারী অষ্ট্রেলিয়ান সরকারের বিজ্ঞান সংস্থা সিএসআইআরও এর বেশ কয়েকটি গবেষনা দল রয়েছে। সেখানকার সহকর্মীদের অনেকের সাথে কথা হোল। এক সহকর্মী মজা করছিলো আর বলল এই অফিসটা ফাঁকা, তুমি চাইলেই নিতে পারো। ওরা উত্তর অষ্ট্রেলিয়াতে সম্পদের ব্যবহার, সম্ভাবনা ও ট্রপিকাল পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষা নিয়ে গবেষনা করে। কুইন্সল্যান্ড সরকার, সিএসআইআরও ও জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে উদ্ভিদ হারবেরিয়াম সংরক্ষন ও তদারকি করে। পরে আমরা একটি ৬৬ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দেখতে গেলাম পাহাড়ের মধ্যে।

আরেকটু সময় থাকলে ম্যানগ্রোভ জংগলের ভিতর দিয়ে হাঁটার ইচ্ছা ছিলো তবে কুমিরের ভয় আছে। ম্যানগ্রোভ বনান্চলের মধ্যে অবকাঠামো ও নিবীড় পর্যটন শিল্প করতে গেলে কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার তার অনেক কিছুই সরকারে দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি সংগঠন সমুহ একসাথে করছে। একসময় প্রায় দেড়শ বছর আগে পুরো এলাকাটাই ছিলো ভেজা ম্যানগ্রোভ বন।  তারপর বন পরিস্কার করে রেললাইন, রাস্তাঘাট, শহর, অবকাঠামো সব নির্মাণ ও তৈরী করা হয়েছে।

এ ভ্রমন থেকে আমার বেশ কিছু শিক্ষা হলো। সাসটেইনেবিলিটি বা নিবীড় তত্ত্ব ও এর প্রয়োগ, টেকসই উন্নয়ন এর সবই গভীর ভাবে বোঝার সুযোগ এখানে আছে। আমরা কুমির ছাড়াও সবচেয়ে বিষাক্ত টাইপ্যান সাপ, অজগর, কোয়ালা, ক্যাঙ্গারু ও ওয়ালাবি, অষ্ট্রেলিয়ান পাখি ক্যাসোয়ারী, উমব্যাট, বড় গুইসাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রানীর খাওয়ানো, ও তাদের সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ জুকিপার বা রক্ষকদের কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছিলো। তারা সবাই একটা সাথে নিয়ে যাওয়ার মতো বিশেষ তথ্য দিয়েছিলো। সেটা হচ্ছে বন্যপ্রানী, জংগল, পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে কিভাবে নিরবছিন্ন ভাবে মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যা দেখেছি, দেখছি, বা পেয়েছি এরকম পরিবেশটা যেন রেখে যেতে পারি, যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা করতে পারে আমাদের মত, আমরা যেন তাদেরকে তাদের সেই অধিকার থেকে বন্চিত না করি। এর জন্য প্রয়োজন চলমান গবেষনার মাধ্যমে প্রানী ও গাছগুলো, পরিবেশ, প্রতিবেশ সম্পর্কে জানা, সামষ্টিক জ্ঞান বৃদ্ধি, পরিকল্পনা ও প্রয়োগ ঠিক করা, সবার মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো, মানুষের গন সচেতনতা ও শিক্ষা বাড়ানো।

এ ভ্রমন থেকে আমার বেশ কিছু শিক্ষা হলো। সাসটেইনেবিলিটি বা নিবীড় তত্ত্ব ও এর প্রয়োগ, টেকসই উন্নয়ন এর সবই গভীর ভাবে বোঝার সুযোগ এখানে আছে। আমরা কুমির ছাড়াও সবচেয়ে বিষাক্ত টাইপ্যান সাপ, অজগর, কোয়ালা, ক্যাঙ্গারু ও ওয়ালাবি, অষ্ট্রেলিয়ান পাখি ক্যাসোয়ারী, উমব্যাট, বড় গুইসাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রানীর খাওয়ানো, ও তাদের সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ জুকিপার বা রক্ষকদের কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছিলো। তারা সবাই একটা সাথে নিয়ে যাওয়ার মতো বিশেষ তথ্য দিয়েছিলো। সেটা হচ্ছে বন্যপ্রানী, জংগল, পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে কিভাবে নিরবছিন্ন ভাবে মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যা দেখেছি, দেখছি, বা পেয়েছি এরকম পরিবেশটা যেন রেখে যেতে পারি, যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা করতে পারে আমাদের মত, আমরা যেন তাদেরকে তাদের সেই অধিকার থেকে বন্চিত না করি। এর জন্য প্রয়োজন চলমান গবেষনার মাধ্যমে প্রানী ও গাছগুলো, পরিবেশ, প্রতিবেশ সম্পর্কে জানা, সামষ্টিক জ্ঞান বৃদ্ধি, পরিকল্পনা ও প্রয়োগ ঠিক করা, সবার মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো, মানুষের গন সচেতনতা ও শিক্ষা বাড়ানো।

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো বায়ু, পানি ও শক্তির বিশেষ গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা কারন আমরা এগুলোর গ্র্যান্টেড ধরে নেই। মাঝে মাঝে ‘নিয়ার ডেথ’ বা মরার কাছাকাছি যাওয়ার অভিজ্ঞতা ভাবা উচিত। আমি যখন অক্সিজেন মুখোশ টা নিয়ে নিশ্বাস নেয়া প্র্যাকটিস করছিলাম এবং একটু পানির নীচে গিয়েছিলাম তখন বুঝেছিলাম বাতাস ও এর অক্সিজেনের গুরুত্ব – জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে সেই মুখোশটা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি অক্সিজেন প্রদান কারী প্রিয় বৃক্ষরাজীর প্রয়োজনীতা স্বরন ও অনুভব করলাম। এটাই তখন জীবন বাঁচানোর অবলম্বন, একমাত্র লাইফ লাইন। এটা সত্যি সৃষ্টিকর্তা যার যখন মৃত্যু লিখে রেখেছেন তখন সেখানেই হবে তবে এই অবলম্বন গুলো আমাদেরকে দিয়েছেন। এত পানির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি তবুও এই পানি প্রচন্ড লবনাক্ত। পৃথিবীতে সুপেয় পানির পরিমান মোট পানির মাত্র তিন ভাগেরও কম। আমাদের পরিস্কার সুপেয় পানির কথা ভাবা উচিত বাড়তি মানুষদের জন্য। পানির সুষ্ঠ ব্যাবহার, পুনব্যবহার, সংরক্ষন আর দূষন না করার জন্য। আর ওখানে আমাদের ফিরে আসার আগে আগে তাপ প্রবাহ শুরু হয়েছিলো। আমরা শুনেছিলাম কুমির চাষের জায়গায় জংগলে বেলা একটার সময় নাকি ৪৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। ৪২ ডিগ্রী তাপমাত্রা কেয়নর্সের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সব জায়গায়ই ভিতরে সার্বক্ষনিক শীতাতোপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও বৈদ্যুতিক পাখা চলছিলো। এজন্য শক্তির চাহিদা ও ব্যবহার সহজেই অনুমেয়। হোটেলের পুরো ছাদটা জুড়েই সোলার বা সৌর প্যানেল বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য।

দেশে দেশে সমাজে সমাজে বায়ু, গাছপালা, প্রানীকুল, পরিবেশ, প্রতিবেশ, পানি, শক্তি আর প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠ ও নিবিড় ব্যবহার, পুন:ব্যবহার, সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া আমাদের মানব জাতির ভবিষ্যত অন্ধকার, এটা আমরা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবো ততটাই আমাদের সবার সামগ্রিক মংগল নিশ্চিত হবে।