ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ ছোট দেশ কাতারে যাওয়া। কাতারে এটা আমার প্রথম ভ্রমণ। এখানে পেট্রোডলারের ঝনঝনানিতে বেড়ে উঠা সুইচ্চ অট্টালিকা ছাড়াও যে দেখার অনেককিছু আছে সেটা বিশ্বকাপ দেখতে না গেলে কোনোদিন জানাই হতো না। বিশ্বের নানা প্রান্তের পযর্টকদেরকে আকৃষ্ট করার
জন্য কাতার নিজেকে সাজিয়েছে তুমুলভাবে। তবে সেটা নিজেদের সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে নয়। মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটক স্বর্গ বলে পরিচিত দেশ আরব আমিরাত যেখানে স্উুচ্চ অট্টালিকা, বিশাল বিশাল শপিং মল আর কৃত্রিম সাজে পুরো দেশটাকে মুড়ে ফেলেছে পর্যটক টানার জন্য সেখানে কাতার সুউচ্চ অট্টালিকা, সাগর বুকে নতুন শহর তৈরি করলেও ভুলে যায়নি নিজেদের সংস্কৃতি। তাই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পর্যটন কেন্দ্র সব জায়গাতেই ছিল কাতারের নিজস্ব সংস্কৃতির উপস্থিতি। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে গিয়ে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে কাতার দেশটাকে ভালো লাগার এটা অন্যতম একটি কারণ!
ঘর থেকে এক পা ফেলিয়া
ঘর থেকে দুই পা ফেলিয়া দেখার জন্য চক্ষু মেলিয়া মানুষ ভ্রমণে যায়। আর ঘর থেকে অনেক পা ফেলে তিন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কাতারে আমার বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই। বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে আমি কাতার দেশটাকে দেখবো আর সেই সুযোগে ঘুরে আসবো মধ্যপ্রাচ্য আর আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। কাতারে আমি দুই পা নিয়ে যেতে পারিনি, গিয়েছি এক পায়ে। আমার জন্য তাই পঙতিমালার লাইনটি হবে- ঘর থেকে এক পা ফেলিয়া! বিষয়টা বিস্তারিত বলি- দুই পা ফেলিয়া ভ্রমনে যাওয়ার স্বপ্ন বুঁনতে বুঁনতে কাতারে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে মারাত্মক এক সড়ক দূর্ঘটনায় আমি শয্যাশায়ী। এক পা আর এক হাত পুরোটা ব্যান্ডেজে মোড়া।
চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ- বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরাম করতে হবে একমাস। তারপর বাকি সবকিছু। কিন্তু যে মানুষ বিশ্বকাপ আর মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছে বছরখানেক ধরে, সবগুলো দেশে যাওয়ার জন্য যার সব বিমান টিকেট, সবগুলো দেশে যার ফ্ল্যাট-হোটেল বুকিং বাবদ অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে এতগুলো টাকা বিনিয়োগ করে রাখা- তাকে কি আর চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ ঘরে আটকে রাখতে পারে। তারপর আবার আমি গরিব দেশের মানুষ, দেশে কামানো টাকায় ঘুরাঘুরি করি, নিতান্তই মধ্যবিত্ত। গরিবের যেরকম ঘোড়া রোগ থাকে, আমার সেইরকম ঘোড়া রোগ হচ্ছে ঘুরাঘুরি। যেখানে বিছানা থেকে নামাই আমার নিষেধ সেখানে আমি কাতার যাওয়ার জন্য নানা অজুহাত দিয়ে পরিবারকে রাজি করিয়ে ফেলি। এক্ষেত্রে আমার জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে আভির্ভূত হয় আমার দুই বন্ধু কামরুল আর মেমন। কামরুল আমার সাথেই বাংলাদেশ থেকে বিশ্বকাপ দেখতে যাবে আর মেমন কাতারের তরুণ শিল্পপতি ব্যবসায়ী। দুজন আমার স্ত্রী’কে এটা বুঝিয়ে ফেলে যে ওরা থাকতে আমার কোনো সমস্যাই হবে না, আমার সব দায়িত্ব ওদের।
অবশেষে আমি স্বপ্নের চেয়ে বড় এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে হুইলচেয়ারে করে ঘর ছাড়লাম কাতারের উদ্দেশ্যে, কখনোবা এক পায়ে হেঁটে ক্র্যাচে ভর দিয়ে। যেহেতু হাত পায়ে ব্যান্ডেজে মোড়া তাই এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে বিমান সব জায়গাতেই বিশেষ সুবিধা পেলাম। ঢাকা থেকে দোহার ফ্লাইট ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। বিমানে উঠার পর আমি তরুণী বিমানসেবিকাকে বললাম- আমার পা লম্বা করে টানিয়ে রাখতে হবে, তাই কিছু বালিশের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। বিমানসেবিকা সেই যে গেলো আর ফিরে এলো না। আমি অনেক কষ্টে বসে বসে তখন ভাবছি ছয় ঘন্টার ফ্লাইট কিভাবে পাড়ি দিবো, পায়ে তো ইতিমধ্যে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে।
বিমান টেকঅফ করার পর যখন নিরাপদ একটা দুরত্বে আকাশে উঠে গেছে, সিটবেল্ট বেঁধে রাখার বাতি নিভে গেছে তখন সেই তরুণী বিমানসেবিকা আমার কাছে এসে উপস্থিত। সে আমার জন্য বালিশের ব্যবস্থা করেছে, তবে আমি যেখানে বসে আছি সেই ইকোনমি ক্লাসের সিটে না। আমার অবস্থা দেখে তার মনে হয়তো একটা মায়া জেগেছে, তাই সে ফ্রি’তে আমার জন্য বিজনেস ক্লাসে একটা সিটের ব্যবস্থা করেছে। যেখানে আমি পা ঠিকমতো টানিয়ে বালিশে দিয়ে রাখতে পারবো। বিজনেস ক্লাসের সিটে বসার পর অতি বিনয়ে অভিভূত আমি মেয়েটিকে যখন ধন্যবাদ জানাই, তখন সে আমাকে জানায়- এই অবস্থায় ঠিকমতো হাঁটতে পারে না একজন মানুষ হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে যাচ্ছে এটা তার কল্পনার অতীত। আমার বিশ্বকাপ যাতে উপভোগ্য হয় সেই শুভকামনাও সে আমাকে জানাতে ভুল করেনি। এই যে আমি এক পা নিয়ে, কখনো হুইলচেয়ারে কখনো ক্র্যাচে ভর দিয়ে নতুন এক দেশে নতুন এক এক্সপেরিয়েন্স নিতে যাচ্ছি, তার পেছনে ছিল একটাই সাহস- প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস আর তীব্র ইচ্ছেশক্তি! মানুষের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই এটা আমি এবার নিজেকে দিয়ে নিজেই দেখেছি!
কাতারের পর্যটন, কাতারের সংস্কৃতি
বিশ্বকাপ ফুটবল দিয়েই কাতার বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে নতুন এক পরিচয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। বিশ্বকাপের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা যেন ঘুরাঘুরি করার গন্তব্য হিসেবে কাতারকে বেছে নেয় সেজন্য কোনো কমতি করেনি কাতার সরকার। নিজেদের পর্যটন আর নিজস্ব সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে তুলে
ধরার জন্য্য তাই বিশ্বকাপের সময় তারা নিয়েছে নানা উদ্যোগ। আমাদের দেশে গ্রাম্য মেলায় ফেরিওয়ালা যেভাবে তার পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে ঠিক সেভাবে কাতার তাদের সবগুলো পর্যটনকেন্দ্র, ঐতিহ্যবাহী স্থান, জাদুঘর, স্থানীয় বাজার, সমুদ্রসৈকত, সুইচ্চ অট্টালিকার ঝকঝকে নতুন শহর সবকিছুর পসরা সাজিয়ে তারা মেলে
ধরেছিল বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য। আমি যেহেতু কাতারে একমাস ছিলাম তাই বিশ্বকাপের খেলা দেখার পাশাপাশি ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো কাতার জুড়েই। ঘুরাঘুরি শুরু করেছিলাম সউক ওয়াকিফ থেকে। আরবে বাজারকে বলা হয় সউক। আর কাতারের এই সউক ওয়াকিফ হচ্ছে তাদের সবচেয়ে পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী বাজার। দোহা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এই বাজারটি আতর, পারফিউম আর অ্যান্টিক সামগ্রীর জন্য বিখ্যাত।
এই বাজারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- এই বাজারে বেশিরভাগ দোকানই বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের লোকজনের। তাই বাজারে ঢুকতেই অনেক বছর দেখা হয় না এমন অনেক মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, একজন ডেকে এনেছেন আরেকজনকে। তারপর কেউ কেউ পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নতুন কোনো এক প্রবাসী বাংলাদেশির সাথে। সউক ওয়াকিফের পর ঘুরতে গিয়েছি কাতারা গ্রামে, যেটাকে ওরা বলে কাতারা কালচারাল ভিলেজ। কাতারের নিজস্ব সংস্কৃতির মেলবন্ধনে নানা আয়োজনে অসম্ভব সুন্দর করে ওরা সাজিয়ে রেখেছে কাতারা গ্রামটিকে। এই গ্রাম আবার আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের মতো না, এখানে আছে অসম্ভব সুন্দর একটি সমুদ্রসৈকত, বেশ কয়েকটি পাঁচ তারকা হোটেল, ক্যাফে রেস্তোরা আর কাতারি স্থাপত্যের পুরনো কিছু নিদর্শন। এরপর কাতারে ঘুরে বেরিয়েছি ওয়াকরা সউক, ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, দোহা কর্নিশ, মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম, অ্যাসপায়ার পার্ক, আল বিদা পার্ক, জুবারা ফোর্ট, বাজপাখি হসপিটাল, লুসাইল শহর, লুসাইল মেরিনা, পার্ল আইল্যান্ড, সিমাসিমা সৈকত, ইনল্যান্ড সমুদ্রসৈকত, আল মারুনা সৈকত, পুরনো দোহা বন্দর, কাতার জাতীয় মসজিদ, কাতারের মরুভূমি সহ আরো বেশ কয়েকটি জায়গায়। এগুলো একেকটি জায়গা নিয়ে লিখতে গেলে বিশাল একেকটি লেখা লিখতে আলাদা আলাদা করে। কাতারের সবগুলো দর্শনীয় স্থান, পর্যটনকেন্দ্র, মিউজিয়াম, মরুভূমি আর সৈকত যেখানে গিয়েছি সেখানেই আভিজাত্য, চাকচিক্যের পাশাপাশি ছিল কাতারের নিজস্ব সংস্কৃতির ছোঁয়া। আর নিজেদের এই সংস্কৃতিকে কঠোরভাবে রক্ষা করতে গিয়েই তারা বিশ্বকাপের সময় স্টেডিয়াম এলাকায় অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় নিষিদ্ধ করেছিল। এই নিয়ে পশ্চিমারা জাত গেল গাত গেল রব তুলেছিল ঠিকই কিন্তু কাতার তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি একটুও! একদিন স্টেডিয়ামে আমার পাশে বসা খেলা দেখা দুই কাতারি তরুণীকে এই নিয়ে আমি প্রশ্ন করেছিলাম- কেন স্টেডিয়ামে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করা হলো? অ্যালকোহল তো বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে? তখন সেই দুই তরুণী আমাকে জানিয়েছিল, কাতারে নারীদের নিরাপত্তা তাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। স্টেডিয়ামে অ্যালকোহল পানের সুযোগ দিলে যে কেউ মাতলামি করতে পারে, নারীদের নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে, অনাকাঙ্খিত যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে- তাই কাতার সরকার আগে থেকেই অ্যালকোহল এখানে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। যাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কাতারে ঘুরতে আসা নারীরা নিরাপদে খেলা দেখতে পারে, কাতারে সহজে নিরাপদে ঘুরতে পারে। কাতার যাওয়ার আগে পোষাক পরার বাধ্যবাধকতার কথা অনেকের মতো আমিও শুনেছি। কিন্তু কাতারে গিয়ে কাতার ভ্রমনের পুরোটা সময় আমি হাফপ্যান্ট পরে ঘুরেছি, একদিন শুধু জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম কাতারিদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক তুফ পরে। সৈকতে মেয়েদেরকে বিকিনি পরে শুয়ে থাকতে দেখেছি। ইউরোপে বা পূর্ব এশিয়ার দেশে পর্যটকরা যেভাবে স্বল্প পোষাকে ঘুরে বেড়ায় সেভাবে কাতারের বিভিন্ন জায়গায় নানা দেশের নারী পুরুষকে স্বল্প পোষাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কোথাও কারো কোনো সমস্যা হয়নি, কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
আন্তরিকতা আর আতিথেয়তায় প্রাণবন্ত প্রবাসী বাংলাদেশীরা
বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারিরা আন্তরিকতা আর আতিথেয়তার সর্বোচ্চ করেছে। যেখানে যার যা প্রয়োজন তার সব আয়োজনই করে রেখেছিলো কাতার। বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য কাতারের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ছিল একেবারে ফ্রি। যেখানে যাওয়া দরকার শুধু মেট্রো অথবা বাসে উঠলেই হবে- ভাড়া দেওয়ার কোনো দরকার নেই। এছাড়া খেলা উপলক্ষে পুরো কাতারজুড়েই নানা ধরনের উপহারের ব্যবস্থা ছিল। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনে তো দর্শকদেরকে গুটি ব্যাগে নানা ধরনের ব্যতিক্রমী উপহারসামগ্রী দিয়ে পুরো বিশ্বকেই চমকে দিয়েছে কাতার। আতিথেয়তায় কাতারিরা যদি সেরা হয়, তবে কাতার প্রবাসী বাংলাদেশীরা তারমধ্যে সবচেয়ে সেরা! এমনিতে আন্তরিকতায় তো বাংলাদেশীদের জুড়ি মেলা ভার। যেখানেই গিয়েছি, যার সাথে দেখা হয়েছে তার একটাই আবদার- সময় করে তার সাথে একবেলা খেতে হবে! সবার আগে এখানে বলতে হয় আমার কলেজ জীবনের বন্ধু মেমনের কথা। নিজের একটা গাড়ি আর ড্রাইভার তো সে সার্বক্ষণিক আমার সাথে দিয়েই রেখেছিলো। এর বাইরে তার স্ত্রী কতবার যে কতকিছু রান্না করে খাইয়েছে তার হিসাব নেই। পিঠা থেকে শুরু করে, সিলেটের সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস রান্না করে আমাদের রসনা তৃপ্ত করেছেন ভাবি। যতবার মেমনের বাসায় গিয়েছি ততবারই মনে হয়েছে আমরা দেশে নিজের বাড়িতে আছি, বাড়ির রান্না করা খাবার খাচ্ছি। এত এত জায়গা থেকে দাওয়াত ছিল যে সব জায়গায় যেতেও পারিনি। এমন হয়েছে যে আমার বন্ধু কামরুলের এলাকার একজন তার বাসায় যেতে পারিনি বলে দুইদিন বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসে আমাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। আরেকজনকে আমরা চিনি না, অথচ তিনি কিভাবে যেন খবর পেয়েছেন আমরা বাংলাদেশ থেকে খেলা দেখতে কাতারে গিয়েছি। তারপর থেকে তিনি আমাদের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে বারবার ফোন করেছেন যাতে তার বাসায় একবার যাই। অবশেষে তার দাওয়াত রাখতে আমরা ওয়াকরা ভিলেজে এক শুক্রবারে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সে এক বিশাল আয়োজন আমাদের জন্য করে রেখেছেন তিনি আর তার স্ত্রী। ভদ্রলোক কাতারে উচ্চ পর্যায়ে চাকরি করেন। আমরা তার বাসায় গেলে দেশ থেকে যাওয়া কয়েকজনের সাথে দেখা হবে, দেশের কথা হবে- এটাই ছিল আমাদেরকে তার বাসায় দাওয়াতের মূল কারণ। ঠিক তেমনি একদিন কাতারের দূর্গম মরুভূমির সিমসিমা এলাকা থেকে কামরুলের দাওয়াত এলো। যারা দাওয়াত করেছেন তারা সবাই কামরুলের গ্রামের মানুষ। একটা কথা না বললেই নয়, আমার কাছে মনে হয়েছে কাতারে যত প্রবাসী বাংলাদেশী থাকেন তার অর্ধেকই মনে হয় কামরুলের গ্রামের। এত এত মানুষ প্রতিদিন তার সাথে দেখা করতে আসতো, এত এত মানুষ তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত করতো যে আমি মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম যে আমি কি কাতারে আছি, নাকি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় আছি। এবার ফিরে আসি সেই মরুভূমির দাওয়াতের গল্পে। মরুভূমি থেকে যারা আমাদেরকে একবেলা খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেছেন তারা সবাই কাতারিদের খামারে গবাদি পশু লালনপালন আর কৃষিকাজ করেন। মরুভূমিতে ঘুরতে যাওয়ার হাতছানি আর প্রবাসী শ্রমিকদের সত্যিকারের জীবন দেখতে আমরা সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। সেখানে তারা থাকেন ধু ধু মরুভূমিতে, চারদিকে কোথাও কেউ নেই এমন পরিবেশ। শীতের দিনেও আমাদের সেখানে গিয়ে গরম লেগেছে। আর গরমের দিনে তাদের অবস্থা কি হয় সেটা সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারবেন। খুব অল্প বেতনে চাকরি করেন তারা, কাতারের শহরগুলোতে যাওয়ার সুযোগও খুব একটা তারা পান না। বাংলাদেশে হয়তো তারা এরচেয়ে ভালো একটা জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু ঐ যে প্রবাস জীবনের হাতছানি, মুঠো মুঠো টাকার স্বপ্ন তাদেরকে নিয়ে এসেছে এমন এক জীবনে। কাতারে যত জায়গায় গিয়েছি আন্তরিকতা আর আতিথেয়তায় এই মরুভূমিতে দিনযাপন করা মানুষগুলোই আমার কাছে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। কারণ, তারা আমাদের জন্য যে আয়োজন করেছেন তা ছিল তাদের সামর্থ্যরে চেয়েও অনেক বেশি!
সুগন্ধীর এক বাংলাদেশী সাম্রাজ্য
মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ সুগন্ধী পছন্দ করে। সুগন্ধীই যেন তাদের জীবনের সব। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুগন্ধী পছন্দ মনে হয় কাতারি মানুষের। কত ধরনের, ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্রের সুগন্ধী যে কাতারে পাওয়া যায় সেটা হয়তো গুণে শেষ করা যাবে না। গত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক থেকে সিলেট অঞ্চলের বড়লেখা উপজেলার মানুষ
কাতারে এসে সুগন্ধীর ব্যবসা শুরু করেন। সিলেটের মানুষই মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন কাতারের পুরো সুগন্ধীর বাজার। প্রথমদিকে তারা বড়লেখা থেকে আগর কাঠ এবং আগর কাঠের নির্যাস থেকে তৈরি আতর আর পারফিউম তৈরি করে কাতারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতেন। এখন অবশ্য সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে ব্যবসার ধরন। তাই কাতারে তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশীরা এসে সুগন্ধী আমদানি করছেন জার্মানি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ভারত থেকেও। এরমধ্যে কেউ কেউ সুগন্ধী বিক্রি করেই কাতারে শিল্পপতি হয়ে গেছেন। আমার বন্ধু মেমন তাদের একজন। তার ভিআইপি পারফিউম এখন কাতারের একটি স্বনামধন্য সুগন্ধী ব্র্যান্ড। কাতারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায়
বিশাল ফ্যাক্টরিতে চলে ভিআইপি পারফিউমের কর্মযজ্ঞ। এতকিছুর পরও সেই আদি বড়লেখার আগর কাঠ আর আগর কাঠের নির্যাসের তৈরি সুগন্ধীর কদর এখনো রয়ে গেছে কাতারে। কাতারে বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই যেহেতু সুগন্ধী ব্যবসায়ী তাই সেখানে ঘুরতে গিয়ে যার সাথে দেখা হয়েছে যার বাসায় গিয়েছি সে-ই ব্যাগ ভর্তি করে আতর আর পারফিউম দিয়েছে। দেশের ফেরার পর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যদি নষ্ট না হয় তাহলে বাকি জীবনে মনে হয় আর পারফিউম কিনতে হবে না!