ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের ট্রাভেল সেমিনার – ধারাবাহিক রিপোর্ট

যারা এই আলোচনা অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখার সুযোগ করে উঠতে পারেননি তারা এই লিংক  থেকে রেকর্ড দেখে নিতে পারেন।

ঘুরুঞ্চির আয়োজনে গত ২০ নভেম্বর মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত হলো ট্রাভেল ফটোগ্রাফি বিষয়ে এক অনলাইন আলোচনা। যাতে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের দু’জন আলোচিত ট্রাভেল ফটোগ্রাফার আজিম খান রনি ও বাদল সরকার।

আজিম খান রনি

বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য ট্রাভেল এবং ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার। কাজ করছেন বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের সাংবাদিক/ভিডিওগ্রাফার হিসেবে। তিনি প্রফেশনালি ফটোগ্রাফি শুরু করেন ২০১৪ সাল থেকে। গেলো সাত বছরে পাঁচ শতাধিক পুরস্কার জিতেছেন গ্লোবাল ফটোগ্রাফি কম্পিটিশন এ। দেশি বিদেশী প্রায় তিন শতাধিক গণমাধ্যমে তাঁর ছবি নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে বিবিসি, সিএনএন অন্যতম। তাঁর ছবি দিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নামি দামি নানান প্রতিষ্ঠান ক্যালেন্ডার ও প্রকাশনা বানিয়েছে।

বাদল সরকার

মূলত একজন ট্রাভেল ও ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার। তাঁর ছবি তোলার আগ্রহের বিষয় হলো স্ট্রিট ফটোগ্রাফি ও প্রান্তিক মানুষ। বাচ্চাদের নিয়ে তাঁর পঞ্চাশটিরও বেশি ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২০০র বেশি আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি কম্পিটিশনে জয়ী হয়েছেন।

ঘুরুঞ্চি আয়োজিত সেমিনারে এই দুই আলোকচিত্রী মতামত দিয়েছেন ট্রাভেল ফটোগ্রাফি নিয়ে। মেলবোর্ন থেকে চিত্রশিল্পী মিতা চৌধুরীর সঞ্চালনায়, তারা দুইজনই কথা বলেছেন ট্রাভেল ফটোগ্রাফির আদ‍্যপান্ত।

আগে হোক প্রকৃতি দেখা

ভ্রমণের আলোকচিত্র কেমন হওয়া উচিত এই বিষয়ে বাদল সরকার বলেন, ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্যই নতুন কিছু দেখা ও উপভোগ করা। প্রকৃতিকে উপভোগ করা। এই উদ্দেশ্যে সফল হলে তারপরে আমরা চেষ্টা করি এই স্মৃতিগুলোকে ছবিতে ধরে রাখতে। ছবিতে ওই সময়ের স্মৃতি ও আবেগ তুলে ধরার জন্য ভ্রমণ উপভোগ করা খুবই জরুরি।

ছবির যেনো গল্প থাকে

বাদল সরকারের মতে ট্রাভেল ফটোগ্রাফি তে আগে গল্প থাকা উচিত তারপরে সেই গল্প থেকে ছবি আসা উচিত। ট্রাভেল ফটোগ্রাফির গুরুত্ব এই যে আমরা যা দেখলাম, যা উপলব্ধি করলাম তা সবাইকে দেখাতে পারি। সেই সাথে যেই জায়গায় ভ্রমণ করা হলো সেই জায়গাকে প্রমোট করা, ওই এলাকার জীবন যাত্রাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা।

সময়, স্থান নির্বাচন যেনো সঠিক হয়

আজিম খান রনির মতে, আমরা নিজেদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যেই ফটোগ্রাফি করি, তাই ট্রাভেল ফটোগ্রাফি । এর জন্য আমাদের যে অনেক পথ পারি দিতে হবে তা নয়। এই ধরণের ফটোগ্রাফির জন্য বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন কোন সময়ে ছবিটা তোলা হলে পারফেক্ট ছবি আসবে। যেই ইভেন্ট কাভার করতে যাওয়া হয়, সেটা নিয়ে পড়াশুনা করতে হয়। কোন সময়ে, কোন সিজন এ গেলে ভালো ছবি পাওয়া যাবে, সেই জায়গায় কিভাবে যেতে হবে এ সব কিছু মাথায় রাখতে হয়। ট্রাভেল ফটোগ্রাফির মধ্যে পোর্ট্রেট, লাইফস্টাইল, ডেইলি লাইফ, কালচার, এরিয়াল ফটোগ্রাফি এ সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত।

ক‍্যামেরা ও নিজের নিরাপত্তা সবার আগে

ট্রাভেল ফটোগ্রাফি করার সময় আমরা অনেক সময় সাবধানতার বিষয়টা মাথায় রাখিনা, যেমন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, কোনো ইভেন্ট কাভার করতে গেলে সেই জায়গার নিয়ম কানুন, বাধ্য বাধকতা ইত্যাদি। অনেক সময় কোন ধর্মীয় অথবা সামাজিক অনুষ্ঠান এ ছবি তুলতে যেয়ে হয়তো কোনো ভুল করে ফেলি যেটা সেই অনুষ্ঠানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাই অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যেই জায়গায় যাওয়া হচ্ছে সেটার কোনো ক্ষতি যেন আমরা করে না ফেলি। সেটা প্রকৃতি হোক, ইভেন্ট হোক অথবা কোনো ফেস্টিভ্যাল। সেই জায়গায় পরবর্তীতে ছবি তোলায় যেন কোনো বাধার সৃষ্টি না হয় এই বিষয়টা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সেই সাথে, যেহেতু ট্রাভেল ফটোগ্রাফারদের অনেক দামি ইকুইপমেন্ট ক্যারি করতে হয়, তাই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

বন্ধুকে নিন সাথে, জানিয়ে রাখুন নিজের অবস্থান

সাথে এক-দুইজন মানুষ রাখা উচিত যেন কোনো কারণে বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া যায়। যেখানে ছবি তুলতে যাওয়া হচ্ছে সেখানে অবশ্যই সবার সাথে মার্জিত ব্যবহার করতে হবে, কারো সাথে উগ্র ভাবে কথা বলে যাবেনা। সেই এলাকার মানুষের সাথে কমিউনিকেট করতে হবে যেন কোনো আপত্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন না হতে হয়।

বাদল সরকার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বললেন, ট্রাভেল ফটোগ্রাফির সময় ফটোগ্রাফার অনেক সময়েই ছবি তোলায় মগ্ন হয়ে বিপদজনক পরিস্থিতিতে পরে যেতে পারে, তাই সব সময় অন্তত একজনকে জানিয়ে রাখা উচিত যে আমি ছবি তুলতে কোথায় যাচ্ছি। তাহলে বিপদে পড়লে কেউ একজন জরুরি পদক্ষেপ নিতে পারবে। সেই সাথে ছবি তোলার সময় শুধু ক্যামেরার লেন্স এ চোখ রাখলে চলবেনা, আসে পাশের পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অবলোকন করতে হবে, কোনো পরিস্থিতিতেই সঙ্গ ছাড়া হওয়া যাবেনা ।

জানুন ছবির কম্পোজিশন

ভালো ছবি তুলতে কেমন কম্পোজিশন করতে হবে জানতে চাইলে বাদল সরকার জানালেন, আমাদের তিনটি লেয়ার এ দক্ষতা আনতে হবে। লোয়ার অ্যাঙ্গেল , মিড অ্যাঙ্গেল এবং টপ অ্যাঙ্গেল। কোনো জায়গায় ছবি তুলতে যাওয়ার আগে যথেষ্ট রিসার্চ করে যেতে হবে। সেখানে মানুষ কি করে, ওই এলাকার আগের কোনো ছবির রেকর্ড আছে নাকি এসব দেখে গেলে সুবিধা হয়। যেকোনো সাবজেক্ট কে খুব নিচু অ্যাঙ্গেল থেকে বা অনেক উপরের অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলার প্র্যাক্টিস করতে হবে। কারণ মানুষের চোখ সবকিছুই মিড অ্যাঙ্গেল এ দেখে অভ্যস্ত। সেখানে অ্যাঙ্গেল চেঞ্জ হলে ছবির ডাইমেনশন বদলে যায়। একই ছবি সাধারণ ভাবে তোলা হলে হয়তো তেমন বিশেষ কিছু মনে হবেনা কিন্তু অ্যাঙ্গেল চেঞ্জ করা হলেই সেটা নতুন মাত্রা পায়।

জানতে হবে নিয়ম কানুন

আজিম খান রনি মনে করেন আমাদের ছবি তোলার নিয়ম কানুন জানতে হবে। কিন্তু জানার পরে চেষ্টা করতে হবে নিজের মতো করে ছবি তুলতে। কিছু নিয়ম ভাঙতে, যেন নতুন কিছুর সৃষ্টি হয়। তিনি মনে করেন খারাপ ছবি বলতে কিছু নেই। একই ছবি একেকজনের চোখে একেকরকম ভাবে ধরা দেয়। তাই ছবি তোলাতে যত নতুনত্ব আনা যাবে ততো ভালো কিছু সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরী হয়। একটি ছবি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল এ, বিভিন্ন ফ্রেম এ তোলা প্রাকটিস করতে হবে। এরপর সেখান থেকে সবচেয়ে ভালোটি বেছে নেয়া যায়।

অনেক থেকে অল্প ভালো

কোথাও ঘুরতে যেয়ে নিজের ছবি তোলার ব্যাপারে তাঁরা বললেন, প্রথমে যেই জায়গায় ঘুরতে যাওয়া হয়েছে সেটা উপভোগ করে নেয়া ভালো। তারপরে অবশ্যই নিজের ছবি ও তোলা যাবে। সেক্ষেত্রে জায়গাটা দেখে নেয়ার কারণে কোথায় ছবি তুললে ভালো হবে সেটার ও ধারণা তৈরী হয়ে যায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে অনেক ছবি তোলার চেয়ে ভালো মানের অল্প ছবি তোলা শ্রেয়।

রংকে দিন প্রাধান‍্য

ছবি তোলার ক্ষেত্রে ন্যাচারাল কালার এর উপর প্রাধান্য দিতে পছন্দ করেন বাদল সরকার। তাঁর মতে আমরা চোখে যা দেখি, তাই ক্যামেরায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত ট্রাভেল ফটোগ্রাফারদের। সাদা,সবুজ আর হলুদ এই রংগুলোকে একটু প্রাধান্য দিয়ে ম্যানেজ করতে হয় ফটোগ্রাফিতে।

মোবাইল ফটোগ্রাফী মন্দ নয়

মোবাইলে ছবি তোলার ব্যাপারে তাঁরা বললেন, এখন মোবাইল এর ক্যামেরার মান, প্রযুক্তিগত নতুনত্ব এতো উন্নতমানের যে ডি এস এল আর এবং মোবাইল ক্যামেরার ছবিতে খুব বেশি পার্থক্য থাকেনা। মোবাইলে কম্পোজিশন এর অনেক সেটিং এখন দেয়াই থাকে। যেমন ছবি তোলার ক্ষেত্রে যেই রুল অফ থার্ড কে প্রাধান্য দেয়া হয়, তাও অনেক মোবাইলের সেটিং এ দেখা যায়। তাই ছবির কম্পোজিশন যদি ঠিক থাকে, তাইলে মোবাইলেও অনেক আর্টিস্টিক ছবি তোলা সম্ভব।

স্থান সাথে মিলিয়ে নির্বাচন করুন গিয়ার

ট্রাভেল ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলার জন্য সাথে যথেষ্ট পরিমান গিয়ার ক্যারি করতে হয়, বিশেষ করে কয়েক রকমের লেন্স, ড্রোন এবং মোবাইল। তবে অতিরিক্ত জিনিস না নিয়ে যেগুলো দিয়ে সব কিছু মোটামুটি কাভার করা যাবে তাই সাথে নেয়া উচিত। সেই সাথে কি ধরণের ছবি তোলা হবে, কোন এলাকায় ছবি তোলা হচ্ছে এসব কিছু যদি আগে থেকে প্ল্যান করা থাকে তাহলে কোন কোন গিয়ার নিতে হবে তা ঠিক করে নেয়া যায় আগে থেকেই । এই পেশায় টেকনোলজির সাথে সব সময় তাল মিলিয়ে চলতে হয় বলে তাঁরা মনে করেন। সময়ের সাথে ক্যামেরার টেকনোলজিতে অনেক পরিবর্তন আসে, তার সাথে দ্রুত পরিচিত হওয়াটা একটা চ্যালেঞ্জ। যেমন বর্তমানে মিররলেস ক্যামেরার ব্যাপারে তাঁদের উভয়েরই মতামত এতে ছবি তোলা অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। ছবিতে ফোকাস, শিফট মিস হওয়াটা অনেক কমে গিয়েছে। ছবির কোয়ালিটিও আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে।

ট্রাভেল ফটোগ্রাফারদের অনেক ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলতে হয়। পেশাটা সহজ নয় মোটেও। ভালো ছবি তুললে অনেক সম্মান ও পুরস্কার ঠিকই মিলে কিন্তু সেই ছবি তোলার পিছনের গল্প, পরিশ্রম অজানাই থেকে যায়। তবুও এখানে প্রাপ্তি-ই বেশি বলে মনে করেন তাঁরা।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ঘুরুঞ্চির প্রধান সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমদ। তিনি অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব‍্য দেন। অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন ঘুরুঞ্চির সম্পাদক প্যানেলের সদস‍্য মাহবুব স্মারক