ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের ট্রাভেল সেমিনার – ধারাবাহিক রিপোর্ট
সেঁজুতি খান, মেলবোর্ন
যারা এই আলোচনা অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখার সুযোগ করে উঠতে পারেননি তারা এই লিংক থেকে রেকর্ড দেখে নিতে পারেন। https://fb.watch/guUUbEEHv5/
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আমন্ত্রণে গত ৯ অক্টোবর পরিবেশ, প্রকৃতি ও পাখি বিষয়ে অনলাইন আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন জনাব ইনাম আল হক এবং তারেক অনু।
জনাব ইনাম আল হক একাধারে একজন পাখি বিশেষজ্ঞ, পর্যটক, লেখক এবং সর্বোপরি উত্তর মেরু এবং এন্টার্কটিকা জয়ী প্রথম বাংলাদেশী পর্যটক। একসময় বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর মূল আগ্রহ এবং গবেষণা পাখি নিয়ে। পাখি দেখতে তিনি বাংলাদেশের বন জঙ্গল থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। তিনি বাংলাদেশের ৭০০ প্রজাতির পাখির প্রমিত বাংলা নাম তালিকা প্রকাশ করেছেন যা জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণীকোষ বিজ্ঞান এর ২৬ তম বিভাগে তিনি বাংলাদেশের ৬৫০ প্রজাতির পাখির পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছেন যা একটি অসাধারণ উদ্যোগ।
ঘুরুঞ্চি সেমিনারে আরো যোগ দিয়েছিলেন তারেক অণু। বয়সে নবীন কিন্তু অভিজ্ঞতায় হৃদ্ধ একজন প্রকৃতি প্রেমিক। তিনি একজন অনুসন্ধানী ভ্রমণকারী, সাত মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত ৩ টি বই রয়েছে। দুটি ভ্রমণ বিষয়ক বই এর পাশাপাশি ‘বাংলাদেশের পাখির ফিল্ডগাইড’ বইটি যৌথ ভাবে লিখেছেন ইনাম আল হক ও তারেক অণু।
তারেক অণুর কাছে আমরা জানতে চাইলাম প্রকৃতির কোন কোন উপাদান তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তিনি বললেন, প্রকৃতির সব কিছুই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন প্রকৃতির কাছাকাছি থাকি তখন গাছপালা, পাখি, নদী, ঝর্ণা সব কিছুই সমান গুরুত্ব বহন করে। এই সব কিছু মিলেই প্রকৃতি। এর একটি ছাড়া আরেকটি অচল। পাখি গবেষক হিসেবে তাঁদের পরিবেশ, ল্যান্ডস্কেপ এর দিকে বিশেষ নজর দিতে হয় বোঝার জন্য যে, কোন ধরণের পাখি কোন ধরণের পরিবেশে থাকে।
প্রকৃতিকে চোখ মেলে দেখা বলতে কি বুঝায় এমন প্রশ্নে ইনাম আল হক বলেন, তাঁর মতে আমরা যখন কোনো কিছু দেখি কখনো কখনো তা আমাদের শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়। আর সেটাই সবচেয়ে মূল্যবান দেখা। জীবনে অল্প কিছু সুযোগ হয়, যখন আমরা শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা বা দৃশ্যের মুখোমুখি হই। তাঁর কাছে সেটাই জীবন মাপার মাপকাঠি। আমরা যাই দেখতে যাই, সেটা দেখে যদি আমাদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে তাহলেই সেটা সত্যি আমাদের জীবনে স্মরণীয় এবং মূল্যবান ।
ইনাম আল হক আরো বলেন, বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে মানুষের প্রকৃতির প্রতি অবহেলা চরম আকার ধারণ করেছে। আমাদের অতিথির কাছে আমরা জানতে চাইলাম এই পরিস্থিতিতে প্রকৃতি কি মানুষের প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠতে পারে ? ইনাম আল হক বললেন, তিনি এটা মোটেও বিশ্বাস করেন না যে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে পারে। তিনি মনে করেন প্রকৃতি একটি নিয়মে চলে কিন্তু প্রকৃতির ইচ্ছে বলতে কিছু নেই। সব কিছুই একটি চলন্ত প্রক্রিয়া। প্রকৃতির কোনো কিছুতেই কোনো অসুবিধা নেই, অসুবিধা আছে মানুষের। আমরা যদি প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটাই , ভবিষ্যতে আমাদের অসুবিধা হবে। তাই আমরা যদি বলি প্রকৃতি বিরূপ হবে, তার মানে প্রকৃতির পরিবর্তনে আমাদের অস্তিত্ব ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রকৃতিকে রক্ষা না করলে মানুষের মুক্তি নেই। প্রকৃতিকে ভালো ভালোবাসতে হবে।
ইনাম আল হক জানালেন, বাংলাদেশে পাখি সংরক্ষণ বিষয়ে অনেক কঠিন আইন রয়েছে। কিন্তু আইন এর প্রয়োগ এর চেয়েও তিনি মনে করেন বাংলাদেশের সামাজিক শক্তি অনেক বেশি শক্তিশালী। বাংলাদেশের মানুষ পাখি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে, পাখি সংরক্ষণ করতে চায়। আমাদের মূল দূর্বলতা হলো সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তথ্যের অভাব। এসব ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ফলে প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও আমরা ফলপ্রসূ কিছু করতে পারছিনা।
সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশ এর জন্য ক্ষতিকর অনেক ভুল করে যাচ্ছি। আমাদের অনেকেরই যথেষ্ট জ্ঞান নেই এইসকল বিষয়ে। উদাহরণ স্বরূপ তিনি বললেন, বাংলাদেশের মানুষ হয়তো কোনো একটি প্লাস্টিক ডাস্টবিন এ ফেলেই দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু সেটা ডাস্টবিন এ ফেলাতেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। আমরা কিনছি বলেই সেটা ব্যবহার হচ্ছে আর শেষ পর্যন্ত ডাস্টবিন এ যাচ্ছে। কিন্তু সেটা মাটিতে মিশতে লেগে যাবে ৫০,০০০ বছর। সুতরাং এই দীর্ঘ সময় কিন্তু আমরা প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যাচ্ছি। এর মধ্যে এই প্লাস্টিক এর কারণে হয়তো কিছু পাখি মারা যাবে, মাছ মারা যাবে। এসবের দায়িত্বও কিন্তু আমাদের নিতে হবে। মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত আর অভ্যাস এর কারণেই এই ক্ষতি হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলোতে অনেক বছর আগেই বিভিন্ন ধরণের বর্জ্যের জন্য ভিন্ন বিন দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা আজও সব ধরণের বর্জ্য এক জায়গাতেই ফেলছি। এই জায়গাতেও আমরা অনেক বছর পিছিয়ে আছি। আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির বর্জ্য পৃথকীকরণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। কিছু বছর পরে দেশে উন্নয়নের সাথে হয়তো আর টোকাই ও পাওয়া যাবেনা এই বর্জ্য পৃথক করার জন্য। তখন আসলেই আরো বড় সমস্যা দেখা দিবে।
ইনাম আল হক মনে করেন এ ক্ষেত্রে দায়টা মূলত আমাদের মতো সুশীল সমাজের। আমাদেরকেই এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, দায়টা তাদেরও। কারণ একসাথে বেশি মানুষের কাছে জ্ঞান ও তথ্য পৌঁছে দেবার এটা একটা ভালো মাধ্যম। সুতরাং সেটাকে উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। যেন আমাদের পরিচিত বন্ধু মহলে কথা গুলো ছড়াতে পারে। এভাবে ছড়াতে ছড়াতেই একদিন এটা প্রশাসনের নজরেও আসবে আর তারা সঠিক পদক্ষেপ নিবে।
পাখির প্রতি ভালোবাসার শুরুর ব্যাপারে ইনাম আল হক বললেন, একদম শৈশব থেকেই তাঁর পাখির সাথে পরিচয়। তাঁর বাবা মা খুবই পশুপাখি ভালোবাসতেন। তাঁরা ছোটবেলা থেকেই ইনাম আল হক কে পাখির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেখান থেকেই এই ভালোবাসার শুরু যা তিনি এখনো লালন করেন। পাখির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এন্টার্কটিকা, উত্তর মেরু তে ভ্রমণ করেছেন। তিনি মনে করেন কোনো কিছুর সাথে এই জীবনের জন্য জড়িয়ে যাওয়া খুবই ভাগ্যের বিষয়।
পাখির প্রতি ভালোবাসার শুরুর ব্যাপারে ইনাম আল হক বললেন, একদম শৈশব থেকেই তাঁর পাখির সাথে পরিচয়। তাঁর বাবা মা খুবই পশুপাখি ভালোবাসতেন। তাঁরা ছোটবেলা থেকেই ইনাম আল হক কে পাখির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেখান থেকেই এই ভালোবাসার শুরু যা তিনি এখনো লালন করেন। পাখির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এন্টার্কটিকা, উত্তর মেরু তে ভ্রমণ করেছেন। তিনি মনে করেন কোনো কিছুর সাথে এই জীবনের জন্য জড়িয়ে যাওয়া খুবই ভাগ্যের বিষয়।
অণু জানালেন পাখির প্রতি ভালোবাসাটা অনেকটা বিস্ময় বোধ থেকে। পাখির উড়ে বেড়ানোটা তাঁর কাছে অনেক বিস্ময়কর লাগতো। সেইসাথে তাদের বিভিন্ন রঙের পালক তাঁকে বিস্মিত করে। ধীরে ধীরে বিচিত্র ধরণের পাখির ব্যাপারে তিনি জানতে শুরু করেন। পাখি যে আমাদের প্রকৃতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সদস্য তা জানতে পারেন। পাখি না থাকলে এই পৃথিবীর সকল গাছ পালা এবং শীঘ্রই মানুষ ও আর টিকে থাকতে পারবেনা এই জিনিসগুলো জানতে পারেন। এ সব কিছুই তাঁকে প্রতিনিয়ত পাখির ব্যাপারে আরো জানতে আগ্রহী করে তোলে। তাঁর জীবনের একটি অন্যতম ঘটনা জনাব ইনাম আল হক এর সাথে পরিচয় হওয়া। তাঁর সাথে দেশে বিদেশে ঘুরে তিনি কিভাবে প্রকৃতি কে বিরক্ত না করে শুধুমাত্র পাখি দেখার আনন্দ থেকে পাখি দেখা যায় এবং সেই সাথে পাখি নিয়ে গবেষণা করা যায় তা শিখেছেন। এসব অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর পাখি দেখার আনন্দ এবং মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে।
পাখির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের যত্নশীলতা ও সহনশীলতার বিষয়ে ইনাম আল হক জানালেন, এক্ষেত্রে সম্প্রতি অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে মানুষ হয়তো পাখি দেখলে কাছে যেয়ে ধরতে চাইতো অথবা অতি উৎসাহী হয়ে কিছু দিয়ে আঘাত করে উড়িয়ে দিতো। কিন্তু এখন বিভিন্ন মিডিয়া তে আলোচনার সূত্রে মানুষ পাখির প্রতি, প্রকৃতির প্রতি আরো যত্নশীল হয়েছে। তাদের ক্ষতি না করে কিভাবে সহাবস্থান করা যায় তা চেষ্টা করছে।
শিশু কিশোরদের পাখি ও পরিবেশের প্রতি আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে ইনাম আল হক মনে করেন শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বড়। স্কুল গুলোতে পরিবেশ শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিশুরা শিক্ষকের কাছ থেকে অনেক কিছুই সহজে শিখতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যথার্থ ট্রেনিং এর ও ব্যবস্থা করতে হবে প্রশাসনকে।
তারেক অণু মনে করেন তরুণদের পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখার জন্য সবার আগে পরিবেশ সম্পর্কে জানতে হবে। এর গুরুত্বটা বুঝলে তারা অনেক বেশি ভালোবাসা নিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ এর কাজে এগিয়ে আসতে পারবে।
ইনাম আল হক জানালেন পাখি দেখার জন্য তাঁর অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ অস্ট্রেলিয়া একটি বিশাল বড় দ্বীপ যার প্রাণিবৈচিত্র তাঁকে সব সময়েই টানে। অস্ট্রেলিয়া তে এমন অনেক প্রজাতির পাখি রয়েছে যা হয়তো পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সুতরাং একজন পাখি প্রেমী হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ তাঁর কাছে খুবই আরাধ্য।
মেলবোর্ন থেকে আয়োজিত এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মিতা চৌধুরী। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ঘুরুঞ্চির প্রধান সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমদ ও সম্পাদক প্যানেলের মাহবুব স্মারক।