মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে উৎসাহিত করা ও প্রকৃতি ভিত্তিক ভ্রমণে আগ্রহী করে তোলাই ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে নিয়মিত প্রকৃতি ভিত্তিক ভ্রমণ আয়োজন করে আসছে যা বাংলাভাষী প্রবাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। সে ধারাবাহিকতায় রবিবার ৭ জানুয়ারী, ২০২৪ আয়োজন ছিল ৮ কিলোমিটার বুশওয়াক। বছরের প্রথম আয়োজনটি ছিল মেলবোর্নের খুব কাছের ড্যানডেনং রেঞ্জ ন্যাশনাল পার্কে।
ড্যানডেনং রেঞ্জ ন্যাশনাল পার্ক একটি অসাধারণ সুন্দর এবং সুসজ্জিত বন। একটু তাকালেই বোঝা যায় খুবই দক্ষতার সাথে পার্কের ট্র্যাকগুলি তৈরী এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। এর পূর্ব পাশেই রয়েছে সিলভান জলাধার (Silvan Reservoir)। এখন থেকে মেলবোর্নে পানি সরবরাহ করা হয় বলে পূর্ব পাশের বনভূমিকে কঠোর নিয়মে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।






শুরুতেই গন্ডগোল!! পার্কের প্রবেশ পথে দেখা গেলো দরজা বন্ধ, কার পার্ক পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। ভেতরে যেতে বাধা নেই, কাজেই গাড়ি এখানে রেখে বাকী কিলোখানেক পথ হেটে যেতে যেতে হবে। তবে চমৎকার পাহাড়ি ঢালু রাস্তায় হাটতে ভালো লাগছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম ঢাল বেয়ে তো নামছি উঠতে খবর আছে …! মেঘলা আবহাওয়ায় গাছের সারি ভেদ করে হালকা আলোয় ফার্নের ঘন সবুজ পাতা খুব চকচক করছিলো।
এই আয়োজন মাত্র দুটি পরিবার যুক্ত হয়েছিলেন। আয়োজকেরা মাথায় হাত দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা কেও কথা রাখেনি…… আওড়াচ্ছিলেন। তবে, সকাল ৮:৩০ বাজতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত মানে যদি তোর ডাক শুনে কেউ…….গাইতে গাইতে আয়োজকরা হারিয়ে যান বনের গভীরে।
প্রবেশপথেই আমাদের স্বাগত জানালো কমলা রঙের মাশরুম। মরা গাছের গুঁড়িতে চকচকে সবুজ ঘন মসের পাশে মাশরুমটিকে খুব ফোটজেনিক লাগছিলো। এছাড়া, অনেক অনেক টুটসান গাছ দেখতে পেলাম। টুটসান (Hypericum androsaemum) পশ্চিম এবং দক্ষিণ ইউরোপের স্থানীয় গাছ। ইউরোপীয়ানদের হাত ধরে এদেশে প্রথমে শোভাবর্ধনে প্রবর্তিত হয়েছিল। পরবর্তি সময় গুরুতর কৃষি আগাছায় পরিণত হয়েছে। এটি শীতল, আর্দ্র বনে, ক্রিকের ভেজা এলাকা বরাবর এবং রাস্তার ধারে জন্মে থাকে। নরম-কাষ্ঠল ঝোপজাতীয় গাছে খুব সুন্দর হলুদ ফুল ফুটে। তবে এর ফল দেখতে আরো চমৎকার। এই উদ্ভিদের বীজ পাখি, শেয়াল এবং পানি দ্বারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বনে বেড়াতে গেলে আমরা নানা বুশ টাকার (bush tucker food) দেখতে পাই। টুটসান বুশ টাকার নয়, এই ফল বিষাক্ত।


বন-বাদাড়ে হাঁটাহাঁটি করলে বিচিত্র কিছুর দেখা মিলে। এবারে খুঁজে পেলাম অসাধারণ সুন্দর অস্ট্রেলিয়ান নেটিভ গ্রিন লিক অর্কিড (Prasophyllum lindleyanum)। এটি মূলত দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় স্থানীয় অর্কিডের একটি প্রজাতি। মসৃণ, টিউব-আকৃতির স্টেম/কান্ডে সামান্য পাতা এবং প্রায় বিশটি সবুজ রঙের ফুল হয়। ফুলের পাপড়ির ভেতর দিকে গোলাপী আভা সহ একটি সবুজ বা সাদা লেবেলাম থাকে যা পরাগায়নে সহায়তা করে। এই ফুলের রয়েছে হালকা সুন্দর সুবাস।
ছাড়াও খুঁজে পেলাম ফ্রেঞ্জ-লিলি (Thysanotus tuberosus) নামে পরিচিত একটি অস্ট্রেলিয়ায় স্থানীয় বহুবর্ষজীবী ভেষজ গুল্ম। এই গাছের পাতাগুলি আকৃতিতে রৈখিক এবং উপরের দিকে আড়াআড়ি অংশে গোলাকার। গাছটি ২০ সেমি থেকে ৬০ সেমি লম্বা হয় অর্থাৎ প্রায় মাটির সাথেই লেগে থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফুল ফোটে। কিন্তূ অনেকদিন এই ফুলটি নজরে আসেনি। যদিও তিনটি পাপড়িযুক্ত ঝিরিঝিরি প্রান্ত সহ বেগুনি রঙের ফুলটি শুধুমাত্র একদিনের জন্যই ফুটে। দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে রঙিন বন্য ফুলের মধ্যে এরা অন্যতম।
দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার পথ বুশওয়াকে এবার সাথে ক্যামেরা আনানি, মোবাইল দিয়েই ছবি তুলতে হলো। ক্যামেরাটাকে খুব মিস করছিলাম।


বুশওয়াকে গেলে নিয়মিত সবসময় যে গুলোর সম্মুখীন হতে হয় তা হলো জোঁক। বিশেষ করে ভেজা ভেজা, স্যাতস্যাতে এলাকায় গাছের পাতায় এগুলো লেগে থেকে। পাশ দিয়ে যাবার সময় গায়ে চলে আসে। অনেক সময় মাটিতেও থাকে। জোঁক মোটেও বিপদজনক কিছু নয়। তবে, বিশেষ কোনো কারণে সবাই জোঁক ভীষণ ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। সাথে আসা আসিফের গায়ে দুইবার জোঁক পাওয়া গেলো। ফুলহাতা জামা, লেগ প্রটেকশন, হুডি এগুলো পড়লে জোঁক এড়ানো সম্ভব। বাজারে নানা রকম স্প্রেও পাওয়া যায়।
এর মাঝে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দ্রুত পায়ে পথ শেষ করে বাড়ি পথ ধরলাম। পথে হ্যামার আরবোরেটাম, বৃষ্টির কারণে আর থামা হলো না। গাড়ি করে কিছুদূর আসার পর আসিফ ফোন দিয়ে বললো ও একটা টি রুমে থামতে চায়। পাহাড়ি পথে গাড়ি ঘোরাবার জায়গা ছিল না, বেশ এগিয়ে গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে টি রুমে আসলাম। নানা রকম লাঞ্চের মেন্যু থাকলেও আমরা কফি, জুস আর ২ রকমের কেক খেয়ে আবার পথে নামলাম।


আমাদের পরবর্তী বুশওয়াক ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে আর আমরা যাচ্ছি – লেক টালি কার্ং (Lake Tali Karng)। ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বুশওয়াকে কেবলমাত্র বুশওয়াক অভিজ্ঞ/অভস্ত এমন কেও যেতে পারবেন। এই বুশওয়াকে ২৬ কিলোমিটার হাঁটার পাশাপাশি ক্যাম্পে রাত্রিযাপন করতে হবে।
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানগুলো “ফ্রি ইভেন্ট” অর্থাৎ যে কেউ যোগ দিতে পারবেন। আমাদের পরবর্তী ইভেন্টগুলো সম্পর্কে জানতে ঘুরুঞ্চির ফেইসবুক গ্রুপের ইভেন্ট পেজে চোখ রাখুন। অনুষ্ঠান গুলোর সফল পরিকল্পনার স্বার্থে সবাইকে বুকিং করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।
আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।