বরাবরই রেইন ফরেস্ট আমাকে অবাক করতো। এর আবহাওয়া ও প্রাণীবৈচিত্র আমার আকর্ষণের মূল জায়গা। জঙ্গল থেকে উঠে আসা জলীয় বাষ্প যা কিনা দেখতে অনেকটা মেঘের মতো, রেইন ফরেস্ট এর মূল আকর্ষণ। ডেইন্ট্রি রেইন ফরেস্ট সে ব্যাপারে অনন্য। যদিও আমরা বর্ষা মৌসুমের একেবারে শেষের দিকে গিয়েছিলাম কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছিল বর্ষা এখনো শেষ হয়নি। এই রোদ্দুর; এই বৃষ্টি। সাথে চিটচিটে গরম তো আছেই। মেলবোর্নে এ ধরনের আবহাওয়ার দেখা মেলা ভার। তাই আমরা (আমি ও আমার স্ত্রী) বর্ষার এই রূপ প্রাণ ভরে নিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এখানেই থেকে যাই।
আমাদের যাত্রা শুরু হয় ক্যানস এর নিকটবর্তী পাম কোভ (Palm Cove) নামক জায়গা থেকে। আমাদের ট্যুর গাইড বাসে করে আমাদের নিয়ে যায় মসমেন গর্জে (Mossman Gorge)। সেখানে আমরা সকালের নাস্তা সেরে চলে যাই মসমেন নদী দেখতে। এই মসমেন গর্জে আমাদের দেখা মেলে এক বিশেষ ধরনের গিরগিটির যার নাম Boyd’s Forest Dragon। সাথে আরো দেখা মেলে মাছ যা কিনা খানিকটা আমাদের কৈ মাছের মত দেখতে।
মসমেন গর্জ এর পরে আমরা রওনা হই ডেইন্ট্রি নদীর (Daintree River) উদ্দেশ্যে। এই নদী পার হয়েই আমাদের যেতে হবে কেপ ট্রিবিউলেশনের (Cape Tribulation) দিকে। কেপ ট্রিবিউলেশনই আমাদের শেষ গন্তব্য। ডেইন্ট্রি নদী রেইন ফরেস্টকে দুই ভাগে ভাগ করে; একটি হচ্ছে উত্তর আর অন্যটি দক্ষিণ। যদিও আমাদের ট্যুরের অংশ হিসেবে নৌকায় করে দক্ষিন থেকে উত্তরে পাড়ি দিয়েছিলাম কিন্তু লোকাল লোকজন ফেরিতে করে এই নদী পার হয়। এই নদীর উপর কোন সেতু নেই, ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। লোকাল সিটি কাউন্সিল চায় না এখানে কোন সেতু হোক। রেইন ফরেস্টএর অখন্ডতা বজায় রাখাই লোকাল সিটি কাউন্সিলের উদ্দেশ্য। যেন ভূমি দস্যুরা রেইন ফরেস্টের জায়গা দখল করতে না পারে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে উত্তরের পুরো অংশটাই অফ গ্রিড। এখানে যারা বসবাস করে তারা সবাই সোলার অথবা ডিজেল জেনারেটর এর উপর ভরসা করে। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও বেশ দুর্বল। যাই হোক, এবার আসি ডেইন্ট্রি নদীর গল্পে। এ নদীর চারপাশ ঘিরে রয়েছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।
নদী পারাপারের সময় বোট চালক আমাদের লবণাক্ত পানির কুমিরের দর্শনের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমার সুন্দরবন ঘোরা হয়নি। তাই এটাই প্রথম কুমির দর্শন প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে। কুমিরের দেখা পেয়ে বোটের সবাই আমার মত খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমরা একটি পুরুষ, একটি নারী ও একটি কিশোর বয়সী কুমিরের দেখা পেয়েছিলাম। এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখি, লবণাক্ত পানির কুমির হলেও এ কুমির কিন্তু মিঠা পানিতে ও বসবাস করতে পারে। তাই মাঝে মাঝেই এ সকল কুমিরের দেখা লোকালয়ে পাওয়া যায়। এটা সাধারণত তখনই হয় যখন এ সকল কুমির খাবারের সংকটে ভোগে। কোন এক মৌসুমে কুমিরের সংখ্যা খুব বেশি বেড়ে গেলে তখন এ সংকট দেখা দেয়। মজার আরো একটি বিষয় হচ্ছে , কুমির নিজেই ( বিশেষ করে মা-কুমির) এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। খাবারের সংকট দেখা দিলে ও কুমিরের সংখ্যার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হলে মা-কুমির তার নিজের সন্তানকে খেয়ে ফেলে।
নদী পার হয়ে আমরা রওনা দেই কেপ ট্রিবিউলেশন উদ্দেশ্যে। পথে একটি রেস্তোরাঁতে আমরা দুপুরের খাবার সেরে নেই। দুপুরের খাবার বেশ পরিমিত ও সুস্বাদু ছিল। খাবার শেষ করে আমরা সবাই বাসে উঠি। বাস এগিয়ে চলে আমাদের গন্তব্যের দিকে। যতই আমরা কেপ ট্রিবিউলেশনের দিকে আগাই ততই জঙ্গল ঘন হতে থাকে। বেশিরভাগ সময় জুড়েই বৃষ্টি আমাদের সঙ্গী হয়েছিল। হওয়াটাই স্বাভাবিক; কারণ, এ যে রেইন ফরেস্ট। যদিও আমরা বর্ষা মৌসুমের একেবারে শেষ দিকে গিয়েছিলাম তারপরও বৃষ্টির পরিমাণ দেখে অবাক হয়েছিলাম। বৃষ্টির সাথে অনভ্যস্ততা এর মূল কারণ। আমাদের ট্যুর গাইড/ বাস চালক বিভিন্ন ছোট ছোট ঝিরি (Creek) দেখিয়ে ভরা মৌসুমে এর উত্তাল হয়ে ওঠার গল্প বলছিলেন। যে রাস্তা ধরে আমরা অনায়াসে যাচ্ছিলাম, বর্ষা মৌসুমে সেই রাস্তা প্রায়শই বন্ধ থাকে। ছোট ছোট ঝিরি গুলোই এক একটি খরস্রোতা নদীতে রূপান্তরিত হয়। পানির তোরে গাড়ি ভেসে যাওয়া একেবারে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কেপ ট্রিবিউলেশন এ যখন পৌঁছলাম তখন আবার বৃষ্টি শুরু। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আমরা রওনা দিলাম নিকটবর্তী লুক-আউটের দিকে। লুক-আউটে পৌঁছে দেখা মিলে নীল সমুদ্র ও সাদা বালুর সৈকত। সৈকত ঘেঁষে বৈচিত্র্যময় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। বেশ কিছু গাছে ফুল ফুটেছে। ফুল ছাড়াও একটি বিশেষ জিনিসের দিকে আমার নজর পড়ে। যা কিনা এর আগে আরো বেশ কিছু গাছে আমি দেখতে পাই। ট্যুর গাইড এর সাথে কথা বলে জানতে পারি এর নাম এপিফাইট। এপিফাইট দেখতে অনেকটাই আগাছা বা পরগাছা বলে মনে হবে। কিন্তু আদতে তারা আগাছাও নয় পরগাছা ও নয়। নিচের ছবি দেখলে ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সহজ হবে। রেইন ফরেস্টে সূর্যের আলোর জন্য সকল প্রজাতির গাছের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা চলে। যে যত শক্তিশালী সে বেশি সূর্যের আলো, পুষ্টি ও পানির যোগান পাবে। স্বাভাবিকভাবেই দুর্বলরা কম সুযোগ-সুবিধা পাবে যেটা তাদের বৃদ্ধি, প্রসার ও বংশবিস্তারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই কিছু প্রজাতির গাছ (স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল) সবল গাছের উপরে বাসা বানানোর চেষ্টা করে। ছবি থেকে আপনারা বুঝতে পারছেন সেই বাসাটা মাটির নয় বরং সূর্যের কাছাকাছি। এই এপিফাইট কোনোভাবেই নির্ভরশীল গাছকে শোষণ করে না বা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। এমনকি সেই গাছের সাথে সূর্যের আলো, পুষ্টি বা পানির জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না। শুধু নিজের বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু সূর্যের আলো, পুষ্টি বা পানির প্রয়োজন তাই যোগাড় করার চেষ্টা করে। এই তথ্য পাওয়ার পর রেইন ফরেস্টের প্রতি আমার মুগ্ধতা আরো বেড়ে গেল।
এরকম অবাক হয়ে যাওয়ার মতো আরো অনেক গল্প রেইন ফরেস্টের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে। এই লেখা আপনারা যারা পড়ছেন তাদের সবার উদ্দেশ্যে আমার অনুরোধ থাকবে জীবনে একবার হলেও এরকম রেইন ফরেস্টে ঘুরে যাবেন। প্রকৃতির বিশালতা, রহস্যময়তা, ক্ষমতা, রুদ্রতা বা খামখেয়ালিপনার অনেক গল্প পড়েছি ও শুনেছি। এখানে ঘুরতে এসে তার কিছু অংশ অনুভব বা উপলব্ধি করার সুযোগ পেলাম। আমি সত্যি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান ভাবি এরকম অসাধারণ একটি রেইন ফরেস্ট ঘুরে দেখতে পাওয়ার সুযোগ পেয়ে। আর এই অনন্য সুযোগ করে দেওয়ার জন্য লেখার শেষ প্রান্তে আমি একান্ত ধন্যবাদ জানাই আমার স্ত্রী সেঁজুতি খানকে। এই ট্যুরটি ছিল ওর পক্ষ থেকে আমার জন্মদিনের উপহার।
এবার ফিরে যাওয়ার পালা। যাওয়ার পথে আমরা থামি একটি আইসক্রিম পার্লারে। আমি আইসক্রিমের খুব একটা ভক্ত নই। তারপরও ভিন্ন স্বাদের আইসক্রিমের লোভ সামলাতে পারিনি। এটা আমাদের ক্যানস ট্যুরের শেষ দিন বলা যায়। পরের দিনই আমাদের ফ্লাইট ধরতে হবে মেলবোর্নের উদ্দেশ্যে। বাসে করে যখন ক্যানস ফিরছিলাম তখন মনে হচ্ছিল আবার কবে আসতে পারবো এই অসাধারণ একটি জায়গায়! মন কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে; আর এটাই স্বাভাবিক। সব ভালোরই একটি শেষ আছে। সত্যি আশায় থাকবো, আবার একদিন ফিরে আসবো এই সুন্দর জঙ্গলে। জীবনানন্দের ভাষায় হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে …