ফুলের রাজ্যের স্বর্গীয় অপ্সরী কে? আমার উত্তর হল ‘টিউলিপ’। এটা অবশ্য আমার নিজস্ব ভাবনাপ্রসূত। এ নিয়ে ভিন্নমতকে আমি শ্রদ্ধা করি কিন্তু আমিতো ‘টিউলিপোম্যানিয়া’য় বুদ হয়ে থাকা মানুষ। তাই রাখঢাক না রেখেই আমি টিউলিপ বন্দনায় মেতে থাকার দলেই থাকবো। দৃষ্টিনন্দন রুপসী এই ফুলটি অস্ট্রেলিয়ার বসন্তের আগমনী বার্তা এনেই ক্ষান্ত হয়না। বসন্তে হাজারো ‘টিউলিপ ম্যানিয়ায়’ আক্রান্ত অস্ট্রেলিয়াবাসীর শয়নে স্বপনে তাসমানিয়ার বিশ্বখ্যাত টিউলিপের ফার্ম ‘টেবলকেইপ টিউলিপ ফার্ম’ বার বার উঁকি দেয়।
বসন্তে অস্ট্রেলিয়াজুড়েই টিউলিপ বন্দনা চলে। এই টিউলিপ উন্মাদনা থেকে বাদ যায় না দ্বীপরাজ্য তাসমানিয়াও। রাজ্যের উত্তর পশ্চিমের উইনিয়ার্ডের টিউলিপ ফার্মের মোহনীয় রুপের যাদুতে যতটা সম্মোহিত হন দর্শনার্থীরা, মনে হয় না সেটা অস্ট্রেলিয়ার অন্য কোথাও সম্ভব। প্রকৃতির কোলজুড়ে থাকা মানুষের তৈরি এক টুকরো স্বর্গীয় বাগান যেন ‘টেবলকেইপ টিউলিপ ফার্ম’। অস্ট্রেলিয়ার অন্য রাজ্যের টিউলিপ উৎসবগুলোর মতো এখানে নেই লাল, নীল বাতির ঝা চকচকে কৃত্রিম আলো কিংবা মানুষকে আকৃষ্ট করতে বাহারি সব রাইডের সমাহার। তবুও এ ফার্মটি আমাকে বারবার হাতছানি দেয় অস্ট্রেলিয়ার বসন্ত উৎসবে।
টেবল কেইপের টিউলিপ ফুলের বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পড়ন্ত বিকেল কিংবা ভোরের আলোয় ক্ষেতের কিনারের লাইট হাউজ যার গাঁ ঘেষে থাকা সমুদ্রের নীল জলরাশি, পাখির কলকাকলি সব কিছু স্বপ্নের মতো। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেয়া যায়, চাইলে স্পর্শ করা যায়। সেটা এখানে না আসলে বুজতে পারতাম না। রুপসী টিউলিপে একধরনের ঘোর, মায়া, নেশা লুকায়িত থাকে। গ্রীক পুরানের সৌন্দর্যের রাণী মায়াবতী আফ্রোদিতির জন্য তখনকার দেবতারা যেমন তার মায়াজালে আচ্ছন্ন থাকত। টিউলিপের ভালোবাসার জালে, আমিও ধরাশায়ী।
টিউলিপের মায়াজালে স্বর্গসম মনে হয় ফার্মটি। টিউলিপের বর্ণাঢ্যতা উপেক্ষা করে ইহজগত ভুলতে সেদিন আমার লেগেছিল কয়েক সেকেন্ড মাত্র। ‘এ কি ভানুমতি, একি ইন্দ্রজালে’র মতো ঠিক কতক্ষণ আচ্ছন্ন ছিলাম জানিনা। যখন সম্ভিত ফিরে পেয়েছিলাম, তখন ক্যামেরা, ড্রোন নিয়ে ছবি তুলতেই পাগলপ্রায়।
টেবল কেইপ টিউলিপ ফার্মটি প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের শেষ অবদি সকাল ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত উপভোগ করার সুযোগ মেলে। তবে যাওয়ার আগে ফার্মের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে বিস্তারিত জেনে গেলে সবচেয়ে ভাল। ফার্মে প্রবেশ মুল্য পূর্ন বয়স্কের জন্য ১২ ডলার, স্টুডেন্টস ১০ ডলার আর শিশুদের জন্য ২ ডলার।
দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় টিউলিপ ফার্ম বলা হয় টিউলিপের এ ক্ষেতটিকে। ফার্মের অবস্থান যেখানে, সেখানে একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরির উৎস ছিল বিধায় জমির উর্বরতার কারনে টিউলিপের ফলনও ভালো হয়।
টিউলিপের আদিবাস মধ্য এশিয়ায় হলেও তুরস্কের সুলতান সুলেমনের যুগ থেকে টিউলিপ আভিজাত্যের প্রতিক হয়ে ওঠে। জানা যায়, টিউলিপের আভিজাত্য এবং আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পায় সুলতান সুলেমনের যুগে। সুলতান আর তার লোকজনের মনোরঞ্জনে টিউলিপের বহুল প্রচলন ছিল। টিউলিপ এতটাই জনপ্রিয় আর অভিজাত হয়ে উঠেছিল যে পরে তৃতীয় আহমেদের শাসনামলে আইন জারি করা হয় -টিউলিপ ফুল কেনাবেচা হবে শুধুমাত্র দেশটির রাজধানীতে। অন্যথায় কঠিন সাজার ব্যবস্থা।
মজার ব্যাপার হল, তুরস্কের সেই ‘টিউলিপোম্যানিয়ার’ বিশ্বায়ন কিন্তু হয়নি, যেটা হয়েছে তা হল ‘ডাচ টিউলিপোম্যানিয়া’র। নেদারল্যান্ডেস’র কোওকেনহপের (kaukenhof) বিশ্বখ্যাত টিউলিপ ম্যানিয়ার ছোঁয়া যারা পেতে চান, তারা অনায়াসে নিশ্চিন্তায় ঘুরে আসতে পারেন তাসমানিয়ার উইনিয়ার্ডের টিউলিপ ফার্ম থেকে। সেটা অন্তত খাঁটি দুধের স্বাদ, ঘোলে নয়, দুধেই মেটানোর মত হবে।
নানা রং আর ভিন্ন ভিন্ন জাতের টিউলিপের মাঠে বিশ্বখ্যাত ডাচ টিউলিপেরও দেখা মিলবে এখানে। টিউলিপের ক্ষেতের বসন্ত বাতাসে, সব বয়সী দর্শনার্থীর মনেও বসন্ত উঁকি দিবে এ নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই৷ টিউলিপ ক্ষেতে আসলে সেখানে পরিপাটি একটি ক্যাফেও পাবেন। মন চাইলে সেখানে এককাপ কফি পান মন্দ হবে না।
অস্ট্রেলিয়ার অন্য রাজ্য থেকে টেবল কেইপ টিউলিপ ফার্মে বেড়াতে এলে হোবার্ট এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে যাওয়া যাবে। গাড়িতে পৌছাতে সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘন্টা। দূরত্ব যাই হোক, টিউলিপের মোহনীয় সৌন্দর্য্যে সব ক্লান্তি দূর হবে অপরুপা টিউলিপের দর্শনমাত্রই। এ নিয়ে আমি বাজিকর হতে দ্বিধাহীন। স্বপ্ন দিয়ে মোড়া যেন পুরো টিউলিপ ফার্ম। প্রকৃতি যেন সৌন্দর্যের পুরো ডালিটা বসিয়ে দিয়েছে ফার্মের আনাচে-কানাচে। যে দিকেই তাকানো যায়, সে দিকেই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা অসাধারণ ছবি।
ছবি তুলতে বাঁধা নেই ফার্মে। তবে ড্রোন ফটোগ্রাফির জন্য পূর্বানুমতি লাগবে। কারো প্রাইভেসি যেন নষ্ট না হয় সেজন্য ক্ষেত মালিকের এ নিয়ম। টিউলিপের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে কখন যে সূর্য্য হেলে পড়ল টেরই পেলাম না। পশ্চিমাকাশে তখন কমলা রং এর আভায় মনে হচ্ছিল শিল্পীর পটে আঁকা এ যেন আরেক ভূস্বর্গ, নাম তার তাসমানিয়া।