রোজকার দিনের একঘেয়ে যাপন-চক্রে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা জীবনে ক্লান্তির ছাপ পড়া মুখে একটু সতেজতার জলের ঝাপটা দেওয়াও প্রয়োজন মাঝে মাঝে। প্রয়োজন একই নিয়মের বাইরে বেরিয়ে কিছু মুহূর্তের স্বাদ-আস্বাদন, যা আবার জীবনের পরবর্তী ইনিংসের জন্য লড়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। চেনা শহরের বা দেশের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকে এমন অনেক অচেনা বাঁক, যার স্নিগ্ধতা স্নান করিয়ে দিতে পারে শরীরের ভেতরে থাকা অদৃশ্য জগত’টাকে, জাগিয়ে তুলতে পারে নতুন ভোরে – কয়েকটা দিন নির্বিঘ্নে প্রকৃতির কোলে কাটানোর জন্য এমনই একটি জায়গা হতে পারে ঝাড়গ্রাম, কলকাতা থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১৮০ কি.মি.। হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠলে পৌঁছতে সময় লাগে মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েক। সবুজ পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য আর অনবরত দিগন্তের হাতছানি, পাহাড়ি নদী আর ঝর্ণার উচ্ছ্বাস, কিছু পুরোনো রাজবাড়ির গা ছমছমে পরিবেশ – এই সবকিছু নিয়েই প্রতিদিন জেগে ওঠে ঝাড়গ্রাম।

গত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে যাওয়া হয়েছিল ঝাড়গ্রামে, কাটিয়েছিলাম তিনদিন, দু’রাত। নিজেকে চেনার আরও একটা সুযোগ দিয়েছিল প্রকৃতি। সেখান থেকে ফিরে আসার পর ধরা দিয়েছিল কিছু লেখা, হয়তো কবিতা, বা হয়তো নয়, জানি না……
১.
শহরের পিঠে ব্যস্ততা বোঝা রাখা
ধুলোবালি জমে নাগরিক ক্লান্তিতে
বাঁচার অর্থ মানিয়ে গুছিয়ে থাকা
আলাদা আলাদা এককের শান্তিতে।
কালো ধোঁয়া ওড়ে রাস্তার ফুটপাতে
কৃত্রিম হাসি ঝুলে থাকে মুখে মুখে
ফ্লাইওভারের নিচে ভিখিরি’রা কাঁদে
বিভাজনী খেলা ধরা দেয় বহুরূপে।
আগুন আর ছাই পৃথক করাও দায়
শহরের বুকে এমনই ঝাপসা ত্রুটি
শরীর আর মন তাই হলে অসহায়
নিজেকে খুঁজতে প্রকৃতির কাছে ছুটি।
২.
ট্রেনের শব্দে চলমানতার গতি
স্টেশনে’রা থাকে অনড় অবস্থানে
একের পর এক পার হয়ে যাওয়া ক্ষতি
বেজে ওঠে দূরে অতিথি পাখির গানে।
দৃশ্যে’রা ছোটে প্রতি মুহূর্তে দূরে
কাছে থাকে শুধু বিস্মিত চোখদুটো
পথিকের মন চিরকালই ভবঘুরে
পথের গন্ধ বদলায় খুব দ্রুত।
জানালা বসানো দুই পৃথিবীর মাঝে
তুলে দিলে কাঁচ মিশে যাবে এক স্রোতে
বাইরের হাওয়া রঙিন আবেগে সাজে
পাহাড়ের বুকে সবুজ পৃথিবী ফোটে।

৩.
দূর থেকে ডাকে নীরবে দিগন্তে’রা
গাছপালা মেশে মেঘের আবর্তনে
এক একটা পথ নির্জনতায় ঘেরা
বিমোহিত মন অজানা সম্মোহনে।
এখানে থাকে না অস্থিরতার রীতি
এখানে ঢোকে না যান্ত্রিকতার প্রথা
এখানে কেবল একটাই শুধু নীতি
আয়নার সাথে নিজেদের সখ্যতা।
পাথুরে পথের পিচ্ছিল আবরণে
লেখা থাকে ক্রমে উত্তরণের লিপি
অচেনা সূত্র পড়ে থাকে কোণে কোণে
আমরা সেখানে স্বাভাবিকতাকে শিখি।
৪.
আল্যার্ম লাগেনা, পাখির গানই পারে
ভোরের জন্ম কানে কানে এসে বলতে
প্রতিধ্বনি’রা ফিরে আসে চিৎকারে –
শব্দেরা চায় পায়ে পায়ে হেঁটে চলতে।
যেই চোখ থাকে ভিড় ঠাসা যানজটে
সেই চোখ যেই খোলা প্রজাপতি দ্যাখে
বসে থাকে দেহ পাহাড়ি নদীর তটে
মনের জানালা খুলে যায় একে একে।
ছবি ভেসে ওঠে হৃদয়ের ক্যানভাসে
তুলি হয়ে ওঠে ভাবনা’রা দলে দলে
স্বাধীন পাখিরা মুক্ত বাতাসে ভাসে
আকাশের বুকে কাব্য লিখবে বলে।
৫.
সন্ধ্যের বুকে সীমাহীন দৃষ্টিতে
তারার মিছিলে উৎসব অনুষ্ঠিত
আগুনের আঁচে উষ্ণতা জমে শীতে
বেজে ওঠে সুর, নিরাকার সংগীতও।
চারদিকে ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা
মাঝখানে কিছু শরীর থাকলো বসে
প্রয়োজনে কিছু নিস্ফল চলাফেরা
দোষী হবে কেউ অন্যের করা দোষে:
এটাই তো গোটা পৃথিবীর সংলাপে
লেখা থাকে শুধু আলাদা আলাদা নামে
হাঁটতে হাঁটতে আমরা জীবন বাঁকে –
কিছু ভালো দিন কিনি সময়ের দামে।
Post Views: 111