সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে আমাদের ঘুরাঘুরির শুরু সূর্যাস্তর সময় থেকে। ছোটবেলায় শোনা জাপানের গল্প, আব্বার ব্যাবসায়িক জাপানী বন্ধুদের আমাদের বাসায় আশা যাওয়া, স্কুলে হিরোশিমার করুণ গল্প পড়া, শোকেসে রাখা জাপানী পুতুল, এমনকি আমার আলট্রাসাউন্ড (ultrasound) প্রফেশনের হাতেখড়ি জাপানী মেশিন Aloka তে – সেই দেশ জাপানে একবার তো যেতে হবেই। ছেলেদের VCE পরীক্ষা আর কোভিদ এর জন্য গত ৪ বছরে কোথাও যাওয়া হয়নি। তাই পরিকল্পনা করলাম জাপান ভ্রমণ হোক স্মরণীয়। আমার ৫০ বছর আর ছেলেদের ১৮ বছরের জন্মদিনের মাইলফলক সবকিছু একসঙ্গে উদযাপন করতে আমাদের জাপান ভ্রমণ। চলুন ঘুরে আসি জাপানে।
জাপান এমন একটি দেশ যেখানে অনেক কিছু বেশ আগে থেকে প্ল্যান করে, বুকিং দিয়ে, অগ্রিম টিকেট কিনে যেতে হয়। কাজেই, বেশ অনেক গুলো ওয়েব সাইট ঘাটলাম, ইনস্টাগ্রামে বেশ কিছু ভিডিও দেখলাম, আমার ২জন কলিগ যারা কিছুদিন আগে জাপানে ঘুরে এসেছে, তাদের কাছ থেকে কিছু টিপস নিলাম। তারপর প্লেনের টিকেট কেটে ছুটির এপ্লিকেশন জমা দিয়েই হোটেল বুকিং দিলাম। কাটলাম জাপানের রেল পাস (JR pass) আর মাউন্ট ফিজির ট্যুর বুকিং দিলাম। Universal Studio আর Disney Sea র টিকেট কিনলাম ওদের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট থেকে। যারা জাপানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, এই টিকেট গুলো বেশ আগে থেকেই কিনতে হবে। যাওয়ার আগের রাতে কিনলাম Ubigi e-SIM . আমি সব কিছু প্ল্যান করে করতে পছন্দ করি, তাই মোটামুটি প্রত্যেকদিনের প্ল্যান করে শুরু হলো আমাদের জাপান ভ্রমণ।

টোকিওর হানেদা (Haneda) এয়ারপোর্ট শহরের বেশ কাছে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার আগে JR অফিসে গিয়ে JR Pass activate করলাম, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য Suica কার্ড কিনলাম আর কিছু ডলার চেঞ্জ করলাম। যদিও জাপানের সব জায়গায় কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যায়, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় ক্যাশ পেমেন্ট দিতে হয়। হানেদা এয়ারপোর্ট থেকে সাবওয়েতে সোজা চলে গেলাম আমাদের প্রথম হোটেল মুজি গিনজার (Muji Ginza) একেবারে প্রাণকেন্দ্রে টোকিওর সবচেয়ে বিখ্যাত হোটেল মুজিতে। ছেলেদের পছন্দের হোটেল তৈরী জাপানের মিনিমালিস্টিক (minimalistic) স্টাইলে। ছিম ছাম সুন্দর গোছানো হোটেল দেখেই মন ভালো হয়ে গেলো। বিছানার পাশে দেয়াল জুড়ে বইয়ের শেলফ। কাঠ আর পাথরের সমন্বয়ে তৈরী এই হোটেল। হোটেলে চেকইন করেই বের হলাম আসে পাশের জায়গা ঘুরে দেখতে। রাতের আলো ঝলমলে পরিষ্কার পরিছন্ন সুন্দর শহর। গিনজা এলাকার জাঁকজমক বিল্ডিং আর লোকে লোকারণ্য রাস্তা – সব কিছুই খুব পরিপাটি। কাছেই নিশান ক্রসিং (Nissan Crossing), ওখানে নিশানের এক্সক্লুসিভ গাড়ী দেখে, রাতের খাবার খেয়েই হোটেলে ফিরে গেলাম। কেননা পরদিন থেকে শুরু হবে একটানা ঘোরাঘুরি।


আরো পড়ুন টোকিওর টুকিটাকি

মেইজি জিঙ্গু শ্রাইন, শিবুয়া
১০০ বছরের পুরোনো ৭০ হেক্টর জায়গা জুড়ে এই শ্রাইন (Shrine) হলো আমাদের জাপান ভ্রমণের প্রথম স্টপ। সকালের হালকা ঠান্ডা আবহাওয়া আর চারিদিকের সবুজ গাছে ঘেরা দেখার মতো একটা জায়গা। জাপানের সব শ্রাইনে ঢোকার আগে হাত আর মুখ ধুয়ে যেতে হয়। হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থাও বেশ চমৎকার। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমার ছেলে সাফওয়ানের মতো যারা স্ক্র্যাপবুক করতে পছন্দ করে, অবশ্যই একটা ডায়েরি সাথে রাখতে হবে। প্রত্যেকটা জায়গায় সুন্দর সুন্দর স্ট্যাম্প দেয়ার ব্যবস্থা আছে। সৌভাগ্যক্রমে ওখানে জাপানের ট্র্যাডিশনাল বিয়ে হচ্ছিলো। সবার সাথে দাঁড়িয়ে আমরাও ওদের বিয়ে দেখলাম। ট্র্যাডিশনাল কিমোনো (Kimono) পরে কি সিম্পল ভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো।
তাকেশিতা স্ট্রিট, হারাজুকু
টিনএজ ছেলেদের সাথে চলে গেলাম জাপানের টিনএজ স্ট্রিটে। এই স্ট্রিটের দুই পাশে শুধু দোকান আর খাবার জায়গা। টিনএজদের ড্রিম ওয়ার্ল্ড এই রাস্তা। জাপানে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্যারেক্টর (character) ক্যাফে আছে। এই সব ক্যাফেতে যেতে হলে আগে থেকে বুকিং দিতে হয়। ভাগ্যক্রমে কোনো বুকিং ছাড়াই আমরা জায়গা পেলাম সানরিও পমপম্পুরিন ক্যাফেতে (Sanrio PomPompurin Cafe)। খাবারের পরিবেশনা থেকে শুরু করে, ক্যাফের সাজসজ্জা সব কিছুই ছবির মতো সুন্দর।




আরো পড়ুন সূর্যোদয়ের দেশে

শিবুয়া স্ক্যাম্বল ক্রসিং
টোকিওর বিখ্যাত জেব্রা ক্রসিং, যেখানে প্রতিদিন ২.৪মিলিয়ন (২৪ লক্ষ) মানুষ রাস্তা পারাপার হয়। প্রতিবার ক্রসিংয়ে পার হয় ৩,০০০। আমরাও ২-৩ বার পার হলাম এই ক্রসিংয়ে। ক্রসিং এর চারপাশে যেন অসংখ্য মানুষের মেলা। ওখানেই দেখলাম প্রথম 3D বিলবোর্ড। আর দেখলাম সেই বিখ্যাত হাচিকো (Hachiko) স্ট্যাচু। এক বিশস্ত কুকুরের মালিক ছিল ইজাবুরো উয়েনো (Eizaburo Ueno), প্রফেসর টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি। প্রতিদিন ৩টার সময় কুকুর স্টেশনে আসতো প্রফেসরের জন্য। একদন প্রফেসর উনিভার্সিটিতে মারা যান। হাচিকো কুকুর পরবর্তী ১০ বছর প্রতিদিন ওই স্টেশনে প্রত্যেক দিন ৩টার সময়ে আসতো। যখন হাচিকো মারা যায় তখন, একজন আর্টিস্ট এই ব্রোঞ্জ স্ট্যাচু এখানে বানায়। মানুষ আর কুকুরের বন্ধুত্বের এক বিরল নিদর্শন এই স্ট্যাচু।
শিবুয়া পারকো
মারিও (Mario) আর পোকেমনের (Pakemon) দেশ জাপান। আয়ান এর পছন্দের এই দুই দোকানে না গেলেই নয়। ছেলেদের মাথা খারাপের জায়গা এইটা। ওখানেই জাপানের বিখ্যাত টেম্পুরা (Tempura) খেলাম। খুবই মজার খাওয়া।
আরো পড়ুন সূর্যোদয়ের দেশে – দু দশক পরে

মাউন্ট ফুজি
আমরা সকালে ৬:৩০টার মধ্যে রওনা দিলাম ট্যুর পিক আপ পয়েন্টে। সারাদিনের ট্যুর, গন্তব্য মাউন্ট ফুজি। প্রথম স্টপ আরাকুরায়মা সেনজেন পার্ক (Arakurayama Sengen Park)। এখন থেকে মাউন্ট ফুজির প্যানারোমিক ভিউ দেখা যায়। সকাল থেকে মেঘলা, মাউন্ট ফুজি দূর থেকে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। ৫ তলা প্যাগোডা অরে ছোট্ট একটা শ্রাইন দেখে রওনা দিলাম ঐশী পার্ক (Oishi Park)। ওখানে যেতে যেতে আকাশের মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। কাওয়াগুচি লেকের (Kawaguchi Lake) পাশে মাউন্ট ফুজি। এক অপূর্ব সুন্দর পাহাড়। মনে হচ্ছে খুব কাছে। লেক আর পাহাড় – এক সময় মনে হলো ছবি তোলা বাদ দিয়ে শুধু সৌন্দর্য্য উপভোগ করি। ট্যুর গাইড যখন আমাদের বাসে ডাকছিলো, তখন এই জায়গা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। কাওয়াগুচিকো ক্রাফট (Kawaguchiko Craft) পার্ক – এইখানে আমাদের দুপুরের বিরতি। এইটা কাওয়াগুচি লেকের অন্য পাশ। এখন থেকেও মাউন্ট ফুজি দেখা যাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে পাহাড়ের উপুরের মেঘ সরে যাচ্ছিলো। এখানেও লেকের পাশে বেশ কিছুক্ষণ হেটে রওনা দিলাম সাইকো ইয়াশি নো সাতো নেম্বা (Saiko Iyashi no Sato Nemba)। ট্রাডিশনাল জাপানীস গ্রাম। আহা কি সুন্দর গোছানো গ্রাম মাউন্ট ফুজির কোল ঘেঁষে। এখানে সময় বেশ কম ছিল। তারপরও হেটে হেটে গ্রাম আর মাউন্ট ফুজি দেখলাম। জাপান আশা সার্থক।
সেনসোজি মন্দির, আসাকুসা
টোকিওর সবচেয়ে পুরাতন বৌদ্ধ মন্দির। এখানে ঢোকার রাস্তাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। দুই পাশে সারি সারি সুভেনিয়ার শপ, আর প্রতিটা দোকানে ভিড় অনেক। টেম্পলের গেট বেশ সুন্দর। একেবারে ভিতরে ট্যুরিস্টদের যাওয়া নিষেধ। শুধুমাত্র যারা প্রার্থনা করতে এসেছে, তারাই ঢুকবে।




আরো পড়ুন মা ছেলের ঘোরাঘুরি

টোকিও স্কাই ট্রি
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার ৬৩৪ মিটার। এটার টিকেটও আমি আগেই কেটে রেখে ছিলাম। এখানে ২ রকম টিকেট কাটা যায়। টেম্বো ডেক (Tembo Deck) ৩৫০ মিটার আর টেম্বো গ্যালারি (Tembo Gallery) ৪৫০ মিটার। স্কাই ট্রির বাইরে থেকেও খুব সুন্দর আর ভিতর থেকে পুরো টোকিও শহর দেখা যায়। ৪৫০ মিটার উচ থেকে সূর্যাস্ত, দূরের মাউন্ট ফুজি আর রাতের আলো ঝলমলে শহর – অসম্ভব সুন্দর। স্কাই ট্রির নীচে শপিং সেন্টার আর রেস্টুরেন্ট। ওখান থেকে রাতের খাবার খেয়ে ফিরে গেলাম হোটেলে। জাপানে আশা অবধি প্রতিদিন প্রায় ২০,০০০স্টেপস হাটতে হচ্ছে। আমার জন্য এটা অনেক। এখানে সাবওয়ের কোনো তুলনা হয় না।
গিঞ্জা সেকো মিউজিয়াম
এই সুন্দর ৪তলা মিউসিয়াম দেখতে কোনো টিকেট লাগে না। খুব সুন্দর গোছানো তথ্যবহুল মিউসিয়াম। ১৮৮১ সালে ২১ বছরের কিন্টারো (Kintaro) শুরু করেছিলেন সিকো (Seiko) ঘড়ির ব্যবসা। Always One Step Ahead Of The Rest – এই চিন্তাধারা নিয়ে একাই গড়ে তুলেছেন সিকোর সাম্রাজ্য।


আরো পড়ুন কুইন্সটাউনে ভ্রমন

বুলেট ট্রেন
আমাদের জাপান ভ্রমণের ২য় পর্বের শুরু বুলেট ট্রেনে। JR pass আগেই একটিভ করা হয়েছিল তাই সোজা টোকিও স্টেশনে গিয়ে সিট কন্ফার্ম করে উঠে গেলাম বুলেট ট্রেনে। ঝকঝকে সুন্দর ট্রেন। প্লেনকেও হার মানিয়েছে বুলেট ট্রেনের সুযোগ সুবিধা। প্রায় ৪০০ কিমি দূরত্ব ২.৫ ঘন্টায় চলে গেলাম। মনেও হলো না ট্রেন ২৮৫ কিমি বেগে চলছে। জালানার পাশে বসে জাপানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম ওসাকা।
ওসাকা
জনসংখার দিক থেকে জাপানের ৩য় জনবহুল শহর। হোটেলে চেক ইন করে বের হলাম এখানকার বিখ্যাত দোটনবোরীতে (Dotonbori)। ওসাকার প্রাণকেন্দ্রে যেন মানুষের ঢল। খাওয়া দাওয়া আর শপিংএর কেন্দ্রস্থল দোটনবোরী। রাতের খাওয়া শেষ করেই হোটেলে, কেননা পরদিন আমাদের অনেক এনার্জির প্রয়োজন।

ইউনিভার্সাল ষ্টুডিও
সকালে উঠেই রওনা হলাম ইউনিভার্সাল ষ্টুডিও। এখানে ছেলেদের মূল আকর্ষণ মারিও ওয়ার্ল্ড (Mario World) এবং এটা দেখার ঝামেলাও অনেক। পার্কে ঢুকেই সোজা চলে যেতে হবে মারিও ওয়ার্ল্ডের সামনে। ওখানে চেক ইন দিয়ে সময় রিসার্ভ করতে হয় এবং ঠিক সেই সময়ে ঢোকা যাবে। বুঝলাম না কেন এত জটিল প্রক্রিয়া। সারাদিন বেশ সুন্দর সময় কাটিয়ে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম।
হিরোশিমা
ছোটবেলায় যখন হিরোশিমার গল্প পড়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল মানুষ কেমন করে এত নিষ্টুর হতে পারে। জেনে শুনে কেমন করে এইভাবে নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন করতে পারে। আর পুরো পৃথিবী যেন নির্বাক দর্শক। আজ প্রায় ৮০ বছর পরেও কোনো কিছুই বদলায় নি। বিশ্ব জুড়ে আজও নিরীহ মানুষ নির্যাতীত।
ওসাকা থেকে বুলেট ট্রেনে প্রায় ১.৫ ঘন্টার দূরত্বে হিরোশিমা। স্টেশনে নেমে আবার লোকাল ট্রেনে করে পৌঁছে গেলাম ফেরী ঘাটে। গন্তব্য হিরোশিমা বেতে (bay) অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ মিয়াজিমা (Miyajima)। ফেরী থেকে দেখা যায় পাহাড় ঘেরা সুন্দর মিয়াজিমা দ্বীপ আর পানির ভিতর দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত গ্রেট তোরি গেট (Great Torii Gate)। ১২০০ সালে নির্মিত ইতসুকুশিমা শ্রাইন (Itsukushima Shrine), একটি UNESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ফেরি থেকে নেমে শ্রাইনে যাওয়ার পথে দেখা যায় হরিণ, যারা নির্ভয়ে মানুষের মাঝে ঘুরাঘুরি করছে। এতো পুরানো শ্রাইন, কিন্তু এখনো এতো সুন্দর করে সাজানো। শ্রাইনের ভিতর দিয়ে যাওয়া যায় তোরি গেটের সামনে। এই দ্বীপের খুব নামকরা একটি খাবার হচ্ছে মমিজি মঞ্জু (Momiji Manju)। ম্যাপেল পাতার আকৃতিতে বানানো বীন জ্যাম দিয়ে তৈরী মিষ্টি ব্রেড। একটা ছোট্ট দোকান থেকে গরম গরম ভাজা এই সুস্বাদু ব্রেড আমরাও খেলাম। আবার যখন জাপান আসবো, এই দ্বীপে অবশ্যই এক রাত থাকবো।
হিরোশিমা অ্যাটমিক বোম ডোম (Bomb Dome) দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষী হয়ে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার। বিভিন্ন দেশে বহু মিউজিয়াম দেখেছি, কিন্তু হিরোশিমার পিস মেমোরিয়াল পার্ক (Peace Memorial Park) এর অভিজ্ঞতা একেবারে অন্যরকম। এত বড় মিউজিয়াম এত মানুষ, কিন্তু কোথাও কোনো শব্দ নেই। এটোমিক বোম এর হৃদয় বিদারক সব ছবি যেন সমস্ত পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করে ফেলেছে। কেউ কেউ নিঃশব্দে কাঁদছে আর মিউজিয়াম ঘুরে দেখছে। আমার ছেলেদের মন এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে, ওরা ওসাকা ফেরার পথে ট্রেনে চুপচাপ বসে থাকল।

আরো পড়ুন ইউরোপের রাজধানী বেলজিয়াম দেখা

ওসাকা ক্যাসেল এবং খাওয়া দাওয়া
১৫৮৩ সালে নির্মিত ওসাকা ক্যাসেল, জাপানে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে একটি। যদিও বাইরে ৫ তলা, কিন্তু ভিতরে ৮ তলা। প্রায় ১ মিলিয়ন পাথর দিয়ে তৈরী এই ক্যাসেল। পুরো ক্যাসেল পার্ক ২ বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে। ভিতরে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে প্রত্যেক তলায় বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখতে দেখতে একেবারে ৮ তলায় পৌঁছে উপর থেকে ওসাকা শহর দেখতে ভালই লাগল।
জাপান ভ্রমণ মানেই হাজার হাজার পা ফেলা (Foot Steps), শত শত সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা। এত ক্যালরি খরচের পরে খাওয়া দাওয়া না করলে কেমন হয়। আর জাপানের বিখ্যাত খাবার না খেলে তো জাপান আসাটাই বৃথা।
ছেলেদের সাথে নেটফ্লিক্সে এক ডকুমেন্টরি দেখে জানতে পেরেছি তোয়োজি চিকুমোটোর (Toyoji Chikumoto) সমন্ধে। খালি হাতে ব্লো টর্চের আগুন দিয়ে সে রান্না করে সমুদ্রের মাছ। ট্রেনে বাসে করে ওসাকার এক গলিতে গেলাম তার ছোট্ট রাস্তার পাশের দোকানে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সবাই এসেছে তার রান্নার পদ্ধতি দেখতে আর খেতে। লাইন দাঁড়িয়ে আমরাও তার রান্না খেলাম আর মুগ্ধ হলাম কোনো মশলা ছাড়া কি ভাবে এতো মজার খাবার হয়।
রাতে গেলাম জাপানের বিখ্যাত রমেন (Ramen) খেতে। দোটনবোরীতে পাওয়া গেলো হালাল রমেন-ইচিরন (Ramen- Ichiran)। সেখানেও প্রায় ১ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে বেশ অন্যরকম একটি রেস্টুরেন্টে খেলাম। সবার জন্য আলাদা আলাদা খোপ খোপ বসার জায়গা। সামনে পর্দা, যার ওপাশে কুক, সে পর্দা খুলে খাবার পরিবেশন করে।

আরো পড়ুন গ্রিসের অ্যাপোলো মন্দিরে

কিয়োটো আর বাশ ঝাড়
কিয়োটোর ট্রেন স্টেশন জাপানের ২য় বড় স্টেশন বিল্ডিং। ১৫ তলা এই স্টেশন থেকে সোজা চলে গেলাম আরাশিয়ামা ব্যাম্বো ফরেস্ট (Arashiyama bamboo forest)। আমরা রিকশা ভাড়া করে পুরো বাশ ঝাড় ঘুরে দেখলাম। আকাশ ছোয়া সারি সারি বাঁশ আর তার মাঝে সরু রাস্তা। রিকশার সাথে ফটোগ্রাফার রিকশাওয়ালা পেয়ে আমি বেশ খুশি। ইংরেজি না জানলে কি হবে, ছবি তোলার জন্য কোনো ভাষার প্রয়োজন নেই। রিকশা ভ্রমণ শেষে গেলাম কাছের মার্কেটে। প্রচুর ট্যুরিস্টের ভীড় আর চারিদিকের বিভিন্ন খাবারের সুঘ্রাণ।
সবশেষে গেলাম ফুশিমি ইমারী (Fushimi Imari) শ্রাইন। ৭১১ সালে নির্মিত এই শ্রাইনে আছে প্রায় ৫০০ কমলা রঙের Tটোরি গেট। এখানেও অনেক অনেক ট্যুরিস্টের ভীড়। দিন শেষে আবার ট্রেনে চড়ে ওসাকা। পরদিন আমাদের জাপান ট্রিপের শেষ পর্ব আবার টোকিওতে।

আরো পড়ুন শান্তা মনিকা

ডিজনি সি
জাপান ভ্রমণের শেষ ৪ দিন একটু আরাম করে ঘুরলাম। যেহেতু আগে হংকং আর লস অ্যাঞ্জেলসের ডিজনিল্যান্ড দেখা হয়েছে, তাই টোকিওতে আমরা ডিজনি সিতে গেলাম। ডিজনির থেকে সম্পূর্ণ অন্য থিমে তৈরী। সারাদিন রাইড চড়া, শো দেখা, খাওয়া দাওয়া করে বেশ ভালো সময় কাটিয়ে ডিজনি থিম ট্রেনে চড়ে হোটেলে।
ওদাইবা
টোকিও থেকে ২১ কিমি দূরত্বে একটি আর্টিফিশিয়াল দ্বীপ, শপিং আর এন্টারটেইনমেন্টের জন্য দেশি বিদেশী সবার খুব পছন্দের। রেইনবো ব্রীজের উপর দিয়ে মনোরেলে করে যেতে হয়। দ্বীপে নেমেই প্রথমে ছবি তুললাম গুন্ডাম (Gundam) স্ট্যাচুর সাথে। ফ্রান্সের সাথে জাপানের বন্ধুত্বের জন্য ওখানে আছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। যদিও নিউ ইউর্কের তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু ব্যাকগ্রউন্ডে রেইনবো ব্রীজ থাকতে ছবিতে বেশ সুন্দর লাগে। ছুটির দিন থাকাতে অনেক ফ্যামিলী ওখানে এসেছে সারাদিন কাটাতে। আমরাও দেখা করলাম আমাদের এক পরিচিতির সাথে ওখানেই। আমার মতো যারা ষ্টেশনারী পাগল, তাদের জন্য জাপান হলো স্টেশনারির স্বর্গ। ৭তলা ষ্টেশনারী দোকান ইতোয়া (Itoya) থেকে বের হয়ে আসাটা আমার জন্য খুব কষ্টের ছিল। সারাদিন এরকম বেশ কিছু স্টেশনারীর দোকানে ঘুরমলাম, কিছু কেনাকাটি করলাম।
টোকিও টাওয়ার
জাপান ভ্রমণের শেষ গন্তব্য টোকিও টাওয়ার। আইফেল (Eiffel) টাওয়ারের অণুকরণে তৈরী ৩৩২.৯ মিটার উঁচু টোকিও টাওয়ার জাপানের ২য় বৃহত্তম স্থাপনা। ২৪৯ মিটার উঁচুতে অবজারভেটরি ডেকে উঠে রাতের টোকিও শহর দেখলাম। আমাদের টোকিও ঘোরার অভিজ্ঞতা অসাধারণ। আধুনিকতা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমন্বয়ে একটি অসম্ভব সুন্দর দেশ। তাদের ভদ্রতা, অমায়িকতা আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোনো তুলনাই হয় না।
আরিগাতো গোজাইমাস (আপনাকে ধন্যবাদ) জাপান।
পড়ুন অনিতা আলীর আরো লেখা
বগা লেকের আসাধারণ ছবিটির বিনা শর্তে ব্যাবহারের অনুমতি দেবার জন্য হণ্টক রিপনের (Md Akram Hossain) কাছে ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিন টীম কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হলো।
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।
আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।