এক দেশের বুলি আর এক দেশের গালি। এইরকম একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনি। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের একটা বৃত্তি পেয়ে চীনের জুডিশিয়াল সিস্টেম, রাজনীতি, সভ্যতা, দর্শন নিয়ে পড়াশোনার কাজে কয়েক সপ্তাহের জন্য চীন গিয়েছিলাম তখন একটা শব্দ শিখেছিলাম যেটা বাংলাদেশে/ভারতে খাবার হিসেবে জানি। কিন্তু চীনে সেই একই শব্দ দিয়ে তারা একটা দিক নির্দেশ করে! ‘নান’ শব্দটি দিয়ে আমরা এক প্রকার রুটিকেই বুঝি। কিন্তু চীনে ‘নান’ (南  – Nán এই চিহ্নটা যেখানে থাকবে সেখানে দক্ষিণ নিয়ে কিছু বলছে) বলতে বুঝায় দক্ষিণ। জিং মানে রয়াল বা রাজসিক। যেমন চীনের নানজিং Nánjīng শহর। নানজিং শহর মানে দক্ষিণের রাজসিক শহর।
 
নানজিং একসময় চীনের রাজধানী ছিল। আর চীনের বর্তমান রাজধানী বেইজিং শহর। বেই (北 Běi  এই চিহ্নটা যেখানে থাকবে সেখনে উত্তর নিয়ে কিছু একটা বলছে) মানে উত্তর। বেইজিং (北京 Běijīng) শহর মানে উত্তর এর রাজসিক শহর। 京 এই চিহ্নটা যেখানে থাকবে সেখানে বেইজিং নিয়ে কিছু বলছে। যেমন বেইজিং এ গাড়ির নাম্বার প্লেট এ এই চিহ্নটা দেখা যাবে। তবে এই নান, বেই এবং জিং এর উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বুঝাবে! ম্যান্ডারিন ভাষায় উচ্চারণ একটা বড় বিষয়। ম্যান্ডারিন হচ্ছে চীনের মান ভাষা। অনেকটা বাংলাদেশের নদীয়া/শান্তিপুরী বাংলা ভাষার মত। বাংলায় যেমন একেক অঞ্চলে একেক উচ্চারণ, শব্দচয়ন তেমনি চীনেও একেক অঞ্চলে একেক উচ্চারণ। তাই চীনের সরকার একটা মান ভাষা নির্ধারণ করে দিয়েছে যেটাকে ম্যান্ডারিন বলে। এই ম্যান্ডারিন ভাষায় বেইজিং অঞ্চলের উচ্চারণ এর প্রাধান্য রয়েছে। শাংহাই ও বেইজিং এর মানুষ যদি একজন আর একজনের শহরে প্রথমবারের মত যায় তাহলে তাদের কমিউনিকেট করতে সমস্যা হবে। অনেকটা বাংলাদেশের রংপুর এর কেউ যদি চট্টগ্রাম যায় প্রথমবার কিংবা চট্টগ্রাম এর কেউ রংপুর যায় প্রথমবার তাহলে তাদের পরস্পরের কথা বুঝতে সমস্যা হওয়ার মত।
 

আবার চীনের দক্ষিণে গুয়াংজু (বিশেষত গুয়াংডং প্রদেশ ) কিংবা হংকং এলাকার ভাষাকে ক্যানটোনিজ ভাষা বলে। এটাও চীনের ভাষা। অনেকটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এর ভাষার মত। চট্টগ্রাম এর ভাষাকে কি বাংলা বলবেন নাকি ভিন্ন একটা ভাষা বলবেন? আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে ম্যান্ডারিন ভাষা হচ্ছে দুই রকম। একটা পুরোন আর একটা সিম্পলিফাইড ভার্সন। অনেকটা বাংলা ভাষার সাধু এবং চলিত রূপ এর মত! ম্যান্ডারিন এর পুরোনো রূপ জটিল। তাই বর্তমানে অধিকাংশ জায়গায় সিম্পলিফাইড ভার্সনই ব্যবহার করা হয়।

 ম্যান্ডারিন ভাষার সাথে পৃথিবীর বাকী ভাষাগুলোর একটা বিশাল পার্থক্য হল ম্যান্ডারিন হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র বেঁচে থাকা হাইরোগ্লিফিকস ভাষা। চিহ্ন দিয়ে লেখা ভাষা। এখনো বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে তারা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে। প্রতিটা বিষয়ের জন্য এক একটা চিহ্ন রয়েছে। সেই চিহ্ন দিয়ে শুধু সেই বিষয়টাকেই বুঝাবে। এক একটা চিহ্নই এক একটা শব্দের মত! তাই হাজার হাজার চিহ্ন রয়েছে। আর ঠিক সে কারণেই চীনের ভাষা শিখাটা একটু কঠিন। আবার উত্তর-পূর্ব (এখন অবশ্য অনেক জায়গায়ই থাকে) চীনের মানুষ আমরা যাদের মাঞ্চু পিপল বলে জানি তাদের লিখিত রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাঞ্চুদের লিখিত রূপ অনেকটা মঙ্গোলিয়ানদের লিখিত রূপ এর মত। মাঞ্চু ভাষাটা উপর থেকে নিচের দিকে (Verticle) পড়তে হয়! বাংলায় আমরা বাম থেকে ডানে পড়ি কিংবা আরবিতে ডান থেকে বামে পড়তে হয়। এই মাঞ্চু ভাষা ডান-বাম বাদ দিয়ে একদম উপর-নিচ পড়া শুরু করেছে! আগেই বলেছি মাঞ্চু স্ক্রিপ্ট মঙ্গোলিয়ান স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে যার প্রি-ইসলামিক উইঘুর স্ক্রিপ্ট (Pre-Islamic Uyghur script) এর সাথে সংযোগ রয়েছে। এই মাঞ্চু পিপলরাই চীন শাসন করেছে গত কয়েকশত বছর (Qing dynasty 1636-1912)। চীনের শেষ সম্রাট ছিল এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মাঞ্চু (Manchu) থেকে। অনেকটা সে কারণেই তাকে উৎখাত করা সহজ হয়েছিল অন্যান্য কারণের সাথে। যদিও হান চাইনিজরা সেটা স্বীকার করতে চায় না আলাপ আলোচনায়।

আর একটা মজার বিষয় না বললেই নয়। আমরা জানি চীনের প্রাচীর তৈরী করা হয়েছিল মঙ্গোলিয়ানদের হামলা থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্য। চীনের প্রাচীর কে সেই সময়ের সবচেয়ে বড় ডিফেন্স প্রজেক্ট হিসেবে ভাবতে পারেন। মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটা কারণ ছিল। তার মাঝে বর্তমানের মত করে বর্ডার কন্ট্রোল ( অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্প এর ওয়াল তোলার মত। তাই ওয়াল তোলা নতুন কিছু নয়।), জাপানিজ জলদস্যুর হাত থেকে রক্ষা, হান চাইনিজদের মাঞ্চু পিপলদের সাথে মিশতে না দেওয়া। যদিও চীনের প্রাচীর শেষ রক্ষা করতে পারেনি হান চাইনিজদের। মাঞ্চু পিপলরা ঠিকই ওয়াল এর ডিফেন্স ভেঙ্গে দিয়ে বেইজিং দখল করেছিল এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত চীন শাসন করেছে। অবশ্য মাঞ্চু পিপলরাই প্রথম চীনের প্রাচীর ভেদ করেনি এর আগে মঙ্গোলিয়ানরাও সফল হয়ে ছিল। আমরা ইতিহাস এর পাতা থেকে জানি যে মঙ্গোলিয়ান চেঙ্গিস খান এর নাতি কুবলাই খান (Kublai Khan) চীন শাসন করেছিল এবং ইউয়ান ডায়নাস্টি ( Yuan Dynasty 1271-1368) এর প্রতিষ্ঠা করেছিল বেইজিং এর উপর। তাই ওয়াল তুললেই যে মানুষকে আলাদা রাখা কিংবা মিশতে না দেওয়া যাবে সেরকম নয়। অন্তত ইতিহাস আমাদের তাই শিখায়। আমরা বার্লিন ওয়াল এর কথা জানি আর চীনের প্রাচীর এর কথাও জানি। কোনটাই দীর্ঘ মেয়াদে কাজে দেয়নি।
 
Map of sinitic dialect (Simplified Chinese) – wiki