এঁকেবেঁকে বয়ে চলা ম্যারিবির্নং (Maribyrnong) নদীর পাড়ঘেঁষে ব্রিমব্যাংক পার্ক। প্রতিদিন শত পরিবারের আনাগোনা এই পার্কে। পার্কটির ল্যান্ডস্কেপ (বাচ্চাদের খেলার জায়গা) এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যা বাচ্চাদের সৃজনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এখানে এমন পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে যেখানে “অটিজম স্পেকট্রামের লোকেরা” আরো ঘন ঘন প্রাকৃতিক পরিবেশে আসতে অনুপ্রাণিত হবেন। শিশুরা এবং তাদের পরিবার একসাথে প্রকৃতির মাঝে খেলার সুযোগ পাবেন যা তাদের প্রকৃতির সাথে সংযোগ করতে আরো আগ্রহী করবে।
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আয়োজনে গেল ২ অক্টোবর ঘোরাঘুরির এবারের আসর বসেছিলো অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের এই ব্রিমব্যাংক পার্কে। মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে উৎসাহিত করা ও ভ্রমণে আগ্রহী করে তোলাই ঘুরুঞ্চির উদ্দেশ্য। এই আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন মেলবোর্নের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কয়েকটি পরিবার।
এবারের আয়োজনের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল দলবেধে ম্যারিবির্নং নদীর ধার ঘেসে মেঠো পথে প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ হাঁটাহাটি। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অংশে অক্টোবর মাসে বেশ বৃষ্টি হয়। ফলে সারা বছর প্রায় পানিশূন্য হয়ে থাকা ম্যারিবির্নং নদীতে পানির প্রবাহ সবাইকে মুগ্ধ করেছে। দুপুরের কড়া রোদে তাপমাত্রা ছিল বেশ আরামদায়ক তবে গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালে বাতাস হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিলো অনেকের।
এবারে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ঘুরুঞ্চি টিমের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন বে টু বে কংক্রেটিঙের (Bay 2 Bay Concreting) নির্মাণ প্রকৌশলী জনাব মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম । জনাব ইসলাম রিসাইক্লিং বিষয়ে আমাদের সাথে কথা বলেন এবং নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রথম যে কাজটি আমাদের করতে হবে তা হলো আমরা যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি করি তা কমিয়ে আনা। তা জীবন চর্চায় যুক্ত করা। আমরা অনেকেই আরামপ্রিয় এবং ফ্যাশন সচেতন। আমাদের নানা খাদ্যাভ্যাসের কারণে প্যাকেটজাত খাবারে অভ্যস্ত। ফ্যাশন সচেনতার কারণে এক জামা কাপড় অনেকদিন পড়িনা। কেবলই নতুন জামা কাপড় চাই আমাদের। এভাবে আমরা বর্জ্য তৈরি করি বা বর্জ্য উৎপাদনে সহায়তা করি। যা মাটি এবং পরিবেশের জন্য ভয়াবহ রকম ক্ষতিকর। জনাব আজহার বলেন শুধুমাত্র একটি ডেনিম জিন্স প্যান্ট বানাতে প্রায় ১০,০০০লিটার পানির প্রয়োজন হয়। অনুন্নত দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের ফ্যাক্টরীগুলোতে এ ধরণের বর্জ্য তৈরি হয়। সেগুলো ট্রিটেড না হয়ে অনেক সময় সরাসরি ভূপৃষ্ঠের পানির সাথে মিশে যায়। এটা শুধু একটি উদাহরণ মাত্র কিন্তু বাস্তবে আমাদের বর্জ্য তৈরির ঘটনা আরো ভয়াবহ।
জনাব ইসলাম বলেন, ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে “reduce – কমানো” এর একটি ভালো দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। এ সংগঠনের আয়োজনে সকলের সচেনতায় অনুষ্ঠানগুলোতে তেমন কোনো বর্জ্য তৈরি হয় না – যেমন আমরা কাঁচের মগ, কাঁচের গ্লাস ব্যবহার করি, বাড়ি থেকে কাঁচের বাটি নিয়ে আসি। দিন শেষে বাড়ি পৌঁছে ধুয়ে নিলেই পরিবেশের উপর বাজে প্রভাব কমানো যায়।
জনাব আজহার তাঁর আলোচনায় কিছু চর্চা, অভ্যাস গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে বলেন, সেগুলো হলো:
- শুধুমাত্র যা একান্ত প্রয়োজন তা কিনুন
- প্যাকেজিং করা পণ্য কেনা বন্ধ করুন, একান্তই না পারা গেলে ব্যবহার সীমিত করুন
- পরিমানে অনেক করে কেনা (bulk amount)
- পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন আইটেমগুলি বেছে নিন
- কেবল একবার ব্যবহার করা যায় তেমন পণ্য বর্জন করুন
- ব্যবহার শেষেও অনেক পণ্য ব্যবহারযোগ্য থাকে, সেগুলো কারো সাথে শেয়ার করুন
জনাব ইসলাম আরো বলেন “reduce” এর পাশাপাশি আমাদের “reuse” করতে শেখাটাও জরুরি। reduce এবং reuse একে অপরের পরিপূরক অর্থাৎ reduce করতে পারলে reuse করা হবে অথবা reuse করলে reduce হবে। যেমন ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা কাঁচের মগ নিয়ে আসি সেটা reuse আর reuse করার কারণেই reduce হয়ে যাচ্ছে।
কাজেই আমরা এই কাজগুলো আরো বেশি করে করতে পারি যেমন:
- এক বোতল পানি না কিনে একটা পানি রাখার বোতল কেনা
- ক্যাফেতে যাবার সময় নিজের মগটা নিয়ে যাওয়া
- নতুন কম্পিউটার না কিনে RAM বা মাদারবোর্ড আপডেট করা
- প্লাস্টিকের ব্যাগ বাদ দিয়ে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য, পরিবেশ-বান্ধব কাপড়ের ব্যাগ বেছে নেয়া
- টেকসই (environmentally sustainable) পদ্ধতিতে উৎপন্ন কাপড় পরা ইত্যাদি
এরকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে, এগুলো আমাদের সবারই জানা তবে মূল কথা হলো এগুলো আমাদের অভ্যাসের মধ্যে আনতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা যারা অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করি তারা অর্থনৈতিক ভাবে অনেকের তুলনায় সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছি। এই বিষয়টি আমাদের কাজে লাগানো উচিৎ।
জনাব ইসলাম “recycle“ সম্পর্কে বলেন, পরিবেশ বায়ু, মাটি ও পানির দূষণ কমায়, গ্রীন হাউস গ্যাস কমায়, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে এবং শক্তি সংরক্ষণ করে। তবে আমাদের সামান্য অবহেলা, বিশৃঙ্খল আচরণ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আমরা অনেকে সঠিকভাবে রিসাইকেল করতে জানি না ফলে আমরা রিসাইকেল বিনে রিসাইকেল অযোগ্য জিনিস ঢুকিয়ে দেই। পাতলা, নরম প্লাষ্টিক রিসাইকেল অযোগ্য তবে Coles এবং Woolworth সুপারমার্কেটে নরম প্লাষ্টিক জমা করার জন্য বড়ো বিন আছে। কেনাকাটা করার আগে সেগুলো তাদের বিনে ফেলে আসতে পারি।
তিনি একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বলেন, তাঁর অফিসে A3 সাইজ পেপার একপাশে প্রিন্ট হতো।এক পাশে প্রিন্ট করার কাগজগুলো ফেলে দিতেন সবাই। তবে তিনি অকেজো কাগজ জমা করে সেগুলোর উল্টো পাশে প্রিন্ট করে নিতেন। এনিয়ে আগে তাঁর অফিসের কলিগরা হাসতো কিন্তু এখন তারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে এবং তারাও এখন এই কাজটি করছে।
আলোচনা ফাঁকে জনাব ইসলাম অনুষ্ঠানে আগত শিশুদের কুইজ জিজ্ঞেসা করেন এবং তাদের উত্তরে অভিভূত হন। ৭ বছরের ছোট্ট টায়রা বলে ওঠে যে সে ড্রইং করার সময় সব খালি জায়গায় আঁকা শেষ করে তারপর অন্য পাতায় যায়। তার কথায় সবাই তার কথায় হেঁসে ওঠেন।
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানগুলো “ফ্রি ইভেন্ট” অর্থাৎ যে কেউ যোগ দিতে পারবেন। আমাদের পরবর্তী ইভেন্টগুলো সম্পর্কে জানতে ঘুরুঞ্চির ফেইসবুক গ্রুপের ইভেন্ট পেজে চোখ রাখুন। অনুষ্ঠান গুলোর সফল পরিকল্পনার স্বার্থে সবাইকে বুকিং করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাষ্টিক ব্যান করা হয়েছে।