মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে উৎসাহিত করা ও প্রকৃতি ভিত্তিক ভ্রমণে আগ্রহী করে তোলাই ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে নিয়মিত প্রকৃতি ভিত্তিক ভ্রমণ আয়োজন করে আসছে যা বাংলাভাষী প্রবাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। সে ধারাবাহিকতায় এবারে (রবিবার ৬ অগাস্ট ২০২৩) ঘোরাঘুরির আয়োজন ছিল বাও বাও (Baw Baw) ন্যাশনাল পার্কের মাউন্ট এরিকা (Erica) কার পার্কিং এলাকা থেকে মাশরুম রক (Mushroom Rock) হয়ে মাউন্ট এরিকা পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার (রিটার্ন) হাইক। এই আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন মেলবোর্নের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কয়েকটি পরিবার। যদিও প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নানা ব্যাস্ততায় আরো কয়েকটি পরিবার শেষ পর্যন্ত যুক্ত হতে পারেননি।
বাও বাও ন্যাশনাল পার্ক:
বাও বাও ন্যাশনাল পার্কের অবস্থান মেলবোর্ন থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। মেলবোর্ন থেকে মোনাশ ফ্রিওয়ে ধরে মো (Moe) শহর পার হয়ে ছোট্ট শহর এরিকার (Erica) উত্তরে থমসন (Thomson) ভ্যালি রাস্তা বরাবর বাও বাও ন্যাশনাল পার্ক। পাশেই শত বছরের পুরোনো গোল্ড মাইনিং শহর ওয়ালহালা (Walhalla) এবং থমসন রিসার্ভার।
১৯৭৯ সালে বাও বাও ন্যাশনাল পার্ক তালিকাভুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে ২০০৮ সালে এই পার্কটি অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায় (Australian National Heritage List) যুক্ত হয়। পার্কটি অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের সাব-আল্পাইন পরিবেশের দক্ষিণে বিস্তৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী কুলিন জাতির (Kulin Nation) উরুন্ডজেরি (Wurundjeri) লোকেরা বাও বাও ন্যাশনাল পার্কের এবং আশেপাশের জমির ঐতিহ্যবাহী অভিভাবক। এছাড়া গানাইকুর্ণাইবাসী (Gunaikurnai) বাও বাও ন্যাশনাল পার্কেকে তাদের ঐতিহ্যবাহী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে।
ন্যাশনাল পার্ক সহ অন্যান্য উদ্যান ও সংরক্ষিত এলাকা এবং বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল পার্ক ও বন্যপ্রাণী আইন (National Parks Act 1975) তৈরী করা হয়। সুরক্ষিত জাতীয় উদ্যান থেকে বিনা অনুমতিতে কোনো গাছ, লতা, পাতা সংগ্রহ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
কেন যাবেন ন্যাশনাল পার্কে:
পরিবার সহ বিশেষ করে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্কে ভ্রমণ করাটা বেশ জরুরি। পার্কগুলির অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়মিত ভাবে কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করলে বাচ্চারা পরিবেশ এবং প্রকৃতি বিষয়ে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। কাদামাটিতে হাঁটা, পাহাড়ি পথে পাথর বেয়ে উঠে যাওয়ার মতো দুঃসাহসিক কাজগুলোতে ওদের আগ্রহ জন্মে যা পরবর্তীতে প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক সাথে সংযোগ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বাচ্চাদের সাথে কথা বলে জানা যায় স্কুলের তুলনায় ওরা যখন বাবা-মার্ সাথে ন্যাশনাল পার্কগুলোতে ভ্রমণ করতে আসে তখন ওদের আত্মবিশ্বাস অনেকে গুন বেড়ে যায়।
আমাদের যাত্রাবিরতি ছিল রসন (Rawson) শহরে। এখানে মোট তিনটি পরিবার একসাথে একটু চা পানি খেলাম। রসন পুলিশ স্টেশনের সাথেই এই জায়গাটা। এখানে ছিল বসার জন্য বেঞ্চ, স্কেট স্পেস, গোসলের জায়গা এবং টয়লেট। আমরা ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে চা পানি খেয়ে আবার রাস্তায় নেমে গেলাম। থমসন ভ্যালি রাস্তা দিয়ে থমসন রিসার্ভারের দিকে যাবার পথে হাতের বা দিকে মাউন্ট এরিকা রোড। কাঁচা রাস্তায় প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কারপার্ক । পাহাড়ি পথে কাঁচা রাস্তায় আমাদের তিন গাড়ির মাঝেরটি কাদায় আটকে গেলো। আমরা রাস্তার পাশ থেকে পাতা ডাল এনে কাঁদার উপর ছড়িয়ে দিলাম। সে গাড়ির ড্রাইভারকে বলা হলো ১০-১৫ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাতে আর আমরা ৩ জন গাড়ির পেছন থেকে ঠেলা দিলাম। যাই হোক ঠেলা ধাক্কা দিয়ে আমরা সেই অংশটুকু পার হলাম। কারপার্কে পৌঁছাবার কিছুক্ষন পর আরেকটি পরিবার আমাদের সাথে যুক্ত হলো। আমরা অস্ট্রেলিয়ান আল্পস ওয়াকিং ট্র্যাকের পথে পা বাড়ালাম।
কারপার্ক থেকে পার্কে প্রবেশ পথেই ২ বেঞ্চ পাতা। যে কেউ এখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারবে বা পিকনিক করতে পারবে। এখানে লিডবিটার (leadbeater’s) পসাম্ এবং বাও বাও ন্যাশনাল পার্ক সম্পর্কে দুটো সাইনবোর্ড দেয়া আছে। সাইনবোর্ড দুটো খুবই তথ্যপূর্ণ। লিডবিটার’স পসাম (বৈ: Gymnobelideus leadbeateri) ফেয়রি পসাম বা লিডবিটার’স গ্লাইডার নামেও পরিচিত, দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার একটি ছোট মার্সুপিয়াল। অস্ট্রেলিয়ার মহাবিপন্ন মার্সুপিয়ালদের মধ্যে এটি অন্যতম। শুধুমাত্র ভিক্টোরিয়ার নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে এদের দেখতে পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে সেন্ট্রাল হাইল্যান্ডের মধ্যে, যার মধ্যে ইয়ারা (Yarra) রেঞ্জ ন্যাশনাল পার্ক এবং টুলাঙ্গি (Toolangi) স্টেট ফরেস্টের মতো এলাকা রয়েছে। অন্য সাইনবোর্ডটিতে কারপার্ক থেকে মাউন্ট এরিকার উচ্চতা প্রোফাইল এবং ন্যাশনাল পার্কের কোথায় কোন ধরণের গাছ রয়েছে তার বর্ণানা করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কারপার্কের উচ্চতা ছিল ১,০৯০ মিটার আর আর মাউন্ট এরিকার উচ্চতা ছিল ১,৫১২ মিটার।
কারপার্কের আশে পাশের এলাকায় রয়েছে মাউন্টেন অ্যাশের (Eucalyptus regnans) বন। মাউন্টেন অ্যাশ অস্ট্রেলিয়ার সবচে উঁচু গাছ। এই গাছ কখনো কখনো উচ্চতায় ১২০ মিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে। লম্বা অ্যাশের ছায়ায় জন্মে মার্টেল ব্রীচ (myrtle breach) গাছ। এর পাতা দেখতে অনেকটা কদবেল গাছের মতো। গারো নিলাভ সবুজ এই ব্রীচের পাতা। আরেকটু উপরে উঠে গেলে দেখা যায় সিলভার ওয়াটল (wattle) গাছ। আমাদের দেশের বাবলা গাছের মতো, গারো হলুদ এর ফুল। পাতার রংটা খানিকটা রূপালী তাই এর নাম সিলভার ওয়াটল। পাহাড়ি পথে আরেকটু উপরে গেলে দেখা মিলবে পাহাড়ি কোরিয়া (mountain correa) গাছের। ঘন এই জংলী গাছে চমৎকার ফুল ফুটে থাকে। মাশরুম রকের কাছাকাছি এলাকায় (১,২৪০ মিটার) দেখা মিলবে অস্ট্রেলিয়ার আলপাইন অঞ্চলের বিখ্যাত গাছ স্নো গাম। এর চাইতে বেশি উচ্চতায় কোথাও কোথাও টি ট্রি (Tea Tree) এবং নানা স্রাব জাতীয় গাছ চোখে পরবে। তবে উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে স্নো গামের আধিপত্য লক্ষণীয়।
বাও বাও ন্যাশনাল পার্কের অন্যতম আকর্ষণ মাশরুম রক। একে ঘন পাহাড়ী বনে লুকিয়ে থাকা গ্রানাইট বোল্ডারের একটি সংগ্রহশালা বলতে পারেন। মাশরুম রকের গঠন একটি অনন্য ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। একটি বড় পাথর বা শিলা একটি সংকীর্ণ শিলার পাদদেশের উপরে বসে আছে। একটু দূর থেকে দেখলে একদম মাশরুম আকৃতির মতো মনে হবে। এই শিলার ঘঠন মূলত দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষয়ের ফলাফল, যেখানে বোল্ডারের নীচের নরম শিলাটি উপরে থাকা শিলার চেয়ে দ্রুত ক্ষয় হয়েছিল, যা স্বতন্ত্র এই আকৃতিটি তৈরি করেছে। সপ্তাহান্তে শহরের ভিড় এড়িয়ে বাও বাও মালভূমিতে এই লুকানো রত্নটিতে পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি পরিবার মাউন্ট এরিকা কারপার্ক থেকে অস্ট্রেলিয়ান আল্পস ওয়াকিং ট্র্যাকের ৪ কিলোমিটার পথ পারি দিয়েছিলাম।
আমাদের চার পরিবারের ছোট ছেলে মেয়েদের বাও বাও ন্যাশনাল পার্কের বুশওয়াকে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল নজরকাড়া। বাবামায়ের উৎসাহে তারা সবাই ছিল উদ্দীপিত। তাদের সুরেলা সুর, হাসাহাসি, কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তায় শান্ত পাহাড়ি পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তাদের হাসাহাসি ছিল আমাদের জন্য সংক্রামক, আমরাও মেতে উঠেছিলাম হাসাহাসিতে।
গাঢ় সবুজ ফার্নের ছোপের পাশ দিয়ে কর্দমাক্ত পাহাড়ি পথ। গত কয়েক দিনের মৃদু আবহাওয়ায় স্নো গলে পাহাড়ি পথটি থকথকে কাঁদায় পরিনিত হয়েছিল। আমাদের উদ্যমী ছেলে মেয়েরা থোড়াই কেয়ার করে সেই কাঁদায় তাদের ভ্রমণের ছাপ রেখে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের মাঝে ছিল প্রকৃতি দেখার আনন্দময় প্রত্যাশা মুখে ছিল উত্তেজনার অভিব্যক্তি।
আদতে এই বুশওয়াক আসলে ছিল একটা স্নো ওয়াক অর্থাৎ তুষার ঢাকা পথে হাইক। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, গত কিছুদিনের মৃদু আবহাওয়ায় বরফ গলে গেছে। চারপাশে বসন্তের বাতাস, গাছে গাছে কুড়ি থেকে হলুদ পাপড়ি উকি দিতে শুরু করছে। বাও বাও ন্যাশনাল পার্কে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৫০০ মিটার উচচতায়, কাজেই শীতে স্নো না পাওয়াটা অনেক দুর্ভাগ্যজনক। যাই হোক, সবাই মিলে জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে দায়ী মানুষের নানা কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে করতে যখন মাউন্ট এরিকার কাছাকাছি পৌছাতেই ট্রেইলের পাশের বুশে দেখা গেল খানিকটা বরফ জমে আছে। সামান্য এতটুকু বরফ, তাতে কি, আনন্দের কমতি ছিল না।
মাউন্ট এরিকার চূড়া বেশ খানিকটা খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে হয়। উপরে উঠে এলে জায়গাটি মালভূমির মতো। এই নিচে এবড়োখেবড়ো শৈলশিরা এবং উচ্ছৃঙ্খল উপত্যকাগুলি দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত এবং ঘন সবুজ বন দ্বারা আচ্ছাদিত। মাউন্ট এরিকা, বিশেষ করে শীতের মাসগুলিতে, প্রায়শই বরফের একটি সাদা আবরণ থাকে, যা প্রাকৃতিক দৃশ্যকে একটি জাদুকরী শীতকালীন আশ্চর্যভূমিতে রূপান্তরিত করে। তবে হাইকিং ট্রেইলগুলিতে বরফের পরিমান কম হলেও আল্পাইন অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে এই এলাকার জুড়ী মেলা ভার।
বাও বাও ন্যাশনাল পার্ক হল ফটোগ্রাফারদের জণ্য একটি স্বর্গ। এর অস্পৃশ্য প্রান্তর, শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য, নানা ধরণের নেটিভ গাছ, ফার্ন, মস, লাইকেন, স্নো, কুয়াশা, বন্যপ্রাণীর বিচিত্র পরিসরের সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক পরিবেশ যে কোনো ফটোগ্রাফারকেই উৎসাহিত করবে। ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বিশ্বের জাদুকরি মুহূর্তগুলো ক্যামেরার সেন্সরে বন্দি করতে ভুলবেন না যেন।
ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানগুলো “ফ্রি ইভেন্ট” অর্থাৎ যে কেউ যোগ দিতে পারবেন। আমাদের পরবর্তী ইভেন্টগুলো সম্পর্কে জানতে ঘুরুঞ্চির ফেইসবুক গ্রুপের ইভেন্ট পেজে চোখ রাখুন। অনুষ্ঠান গুলোর সফল পরিকল্পনার স্বার্থে সবাইকে বুকিং করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।