করোনা-কালীন লক-ডাউনের সময় যখন আমরা হাঁসফাঁস এর চূড়ান্তে তখন প্রায়ই দিবাস্বপ্ন দেখতাম যে অস্ট্রেলিয়ার এইখানে যাবো, ঐখানে যাবো। প্রত্যেকদিন সকালে সংবাদের মধ্যে করোনায় এবং গতবছর দাবানলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর নাম বলার সময় মালাকোটা নাম প্রায়ই উচ্চারিত হতো। মালাকোটা গতবছর শেষের দিকে দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে শীর্ষে ছিল। এলাকাটি ভিক্টোরিয়ার এক্কেবারে পূর্বদিকে। মেলবোর্ন থেকে পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা লাগে সরাসরি ড্রাইভ করে যেতে। প্রথমে দাবানল এরপরে করোনার দীর্ঘ লক-ডাউনে এলাকার অর্থনীতিতে ধস নামে যেটা পুরোটাই চলতো পর্যটনের উপর। সরকারের কাছ থেকে আহবান ছিল এইসব এলাকাতে ভ্রমণে যাওয়ার জন্য যাতে দ্রুত অর্থনীতি চাংগা হয়ে উঠে। নতুন ভিক্টোরিয়া বাসী হিসেবে আমাদের মনে হলো এটা আমাদের দায়িত্বও বটে। আমরা পুরো পরিবার আর আমার বরের এক বন্ধু মিলে রউনা হয়ে গেলাম মালাকোটার পথে।

দিন ছিল ২৪শে ডিসেম্বর যা কিনা ক্রিসমাসের আগের দিন। পৌছাতে পৌছাতে আমাদের বিকাল পাঁচটা বেজে গেলো। ধারনা ছিল কোনোনা কোনো খাওয়ার দোকান তো খোলা পাওয়া যাবেই। পৌঁছে দেখি কিছুই নেই বলতে। হাতে গুনে কয়েকটা দোকান। দুটো গ্রোসারির দোকান। এবার গুগলে খোজ করে মোটামুটি খরচে একটা বাসা পাওয়া গেলো। যা শুধু তিনদিনের জন্যই ফাকা ছিল। বাসার কেয়ারটেকার হাতে চাবি দেয়ার সময় জানিয়ে গেলো যে এক ঘণ্টার মধ্যে গ্রোসারির দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আমরা গ্রোসারীর দোকানে দিলাম ছুট। আগামী দিন ক্রিসমাস। মোটামুটি নিশ্চিত যে একটা দোকানও খোলা থাকবে না। হাতের কাছে যতটুকু খাবার রাখা যায় সেটাই বাজার করে ফেলতে হবে। পরের দুইদিন আমরা ইন্দোমি নুডুলস খেয়ে ছিলাম। চারজন ক্রিসমাসের দিন ঘুরতে বের হলাম। মালাকোটার সমুদ্র সৈকত নাম করা। দুটো আলাদা সৈকতে ঘুরার সুযোগ হলো। প্রথমটাতে কিছু লোক দেখলাম। পরেরটা একেবারেই নিরিবিলি। আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ছিলাম ঐ-যায়গায়। পুরোই জন-মানবহীন একটা যায়গা। খুবই ভালো লাগছিলো। বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন জায়গাও এখনও পৃথিবীতে আছে।

পরদিন সকালে (ক্রিসমাসের পরদিন) এক-জায়গায় খেয়ে চিন্তায় পরে গেলাম কই যাওয়া যায়। আমার বর ঠিক করলো ক্রইয়াজিংগোলোং পার্কে যাওয়ার। দুইঘন্টার রাস্তা ছিল। ম্যাপ দেখে আমার বর আর তার বন্ধু ঠিক করলো বনের মধ্যদিয়ে দেখতে দেখতে যাবে। কিছুদূর যাওয়ার পরে আমরা বুঝলাম যে বনের রাস্তাটা পুরোটাই কাচা রাস্তা। এমনকি এক জায়গায় সাইনবোর্ড লাগানো জেনো চার চাকার ফোর হুইল ড্রাইভ ছাড়া না চালানো হয়। চাকা গর্তে পরলে তোলার জন্য লোক পাওয়া যাবে না। আমি দেখলাম ঐ জঙ্গলের মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। যাইহোক আমরা অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার জন্যই আর পিছু ফেরার সুযোগ ছিল না। সোজা এগিয়ে যেতে থাকলাম। এখন মনে হয় ঐ সিদ্ধান্তটা বিপদজনক হলেও অভিজ্ঞতাটা এমন চমৎকার হতো না। পুড়ে যাওয়া বন এমন সুন্দরভাবে পুনরায় আগের মতো খোলস ছেড়ে সবুজ হচ্ছে তার সাক্ষী হতে পারতাম না। অবাক করা বিষয়গুলোর মধ্যে একটা ছিল উইপোকার বিশাল ডিবি দেখা। পুড়ে যাওয়া গাছগুলো উইপোকা খেয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে।

দুইঘন্টা পরে ক্রইয়াজিংগোলোং পার্কে পৌঁছে গেলাম। একটা পরিবার দেখলাম তাঁবু খাটিয়ে বসে আছে। সামনে একটা লেক। আমরা লেকের সামনে হাঁটাহাঁটি করলাম। তিনটে বিশাল কালো বুনো হাঁস এই প্রথম একসাথে তাল মিলিয়ে কোত্থেকে উড়ে আসতে দেখলাম। হাসগুলো আমাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছিল। কিছু ছবি তুলে আবার একই পথে ফেরার জন্য রউনা হয়ে গেলাম।

মালাকোটা এলাকায় ফিরে আমার বর আর বন্ধু ঘোষণা দিলো তারা মাছ ধরবে। মালাকোটায় বেরাতে গেলে সবাই প্রথমেই মাছ ধরার কাজটা করে। বাসার সামনে লেকের পাশে প্রায় পঞ্চাশটা পরিবার তাঁবু-গেঁড়ে রয়েছে। প্রত্যেক পরিবারের দাদা দাদী থেকে নাতি নাতনী সহ সবাই তাবুতে। সাথে পরিবারের প্রিয় কুকুরটাও। আমার বর আর তার বন্ধু গাট বেধে বসে ধার করে আনা ছিপে মাছ ধরার যারপরনাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি লেকের পাশে পরিবারগুলোর কার্যকলাপ দেখছিলাম। বুলেটের গতিতে কিছু ছেলেপেলে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলো। বুড়বুড়ি তাঁবুর সামনে ভাঁজ-খোলা চেয়ারে বসে বিয়ার খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখছে। একসময় বাসায় চলে গেলাম। প্রায় তিনঘণ্টা পরে আমার বর বিজয়ীর বেশে এক পুঁটি মাছের সাইজের মাছ নিয়ে ফেরত আসলো। মাছখানা নাকি তার বন্ধু ধরতে পেরেছে। সেই মাছ ভেজে সাথে আলু ভর্তা করা হল। সরিষার তেলের অভাবে মাখনটাই গরম করে ভর্তার মধ্যে দিয়ে দেয়া হল। আয়োজন ছিল সামান্য কিন্তু মাছ ধরার উত্তেজনাতেই সেটা অমৃতের মতো মনে হচ্ছিলো।

সারাটা বছর বাসায় বন্দী থাকার পরে কোথাও ঘুরতে পেরে খুবই ভালো লাগছিলো। কোন দামী রেস্তোরা যাওয়া হয়নি, কোন বিলাস বহুল হোটেলে থাকা হয়নি। কিন্তু একটা পুড়ে যাওয়া বনের রাস্তা আর জন-মানবহীন সৈকতের ভালোলাগা মনে থেকে যাবে চিরকাল।