ক্রুগার (Kruger) ন্যাশনাল পার্ক, সংক্ষেপে কে এন পি। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ন্যাশনাল পার্ক। বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য। এটি দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিলো ২০০৮ সালে।

সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমন্ত্রণ এলো একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাবার। সম্মেলনের স্থান একবারে কে এন পির গেটের কাছে। ভাবা যায়? সম্মেলনের আয়োজকদের একজন আমার পূর্ব পরিচিত এবং বন্ধু। তাকে ইমেইল করে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কি সাফারি না মিটিং? সে বললো, চাইলে মিটিং এবং সাফারি দুটোই একসাথে করতে পারো। একেই বলে, রথ দেখা আর কলা বেচা। একের ভিতরে দুই, এক টিকেটে দুই ছবি।

সিডনি থেকে জোহানেসবার্গ পৌঁছে সেখান থেকে ছোট এক প্লেন ধরে নেলস্প্রুটে নামলাম। তারপর সড়ক পথে কে এন পি অভিমুখে যাত্রা। সব মিলিয়ে বেজায় লম্বা জার্নি। কিন্তু আমার ক্লান্তি নেই। আমায় তখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ক্রুগারের বন্য প্রাণীর দল। এতদিন ওদের দেখেছি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে। এবার দেখবো সামনা সামনি।

সম্মেলন কেন্দ্রে এসে আমি খুবই চমৎকৃত হলাম। পুরো কমপ্লেক্সটাই কাঠের তৈরি। আফ্রিকান রীতিতে বানানো। খুবই সুন্দর আর্কিটেকচার। সুযোগ সুবিধার কমতি নাই। ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের প্রধান ফটক থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দুরে এর অবস্থানের কারণে কিছু কিছু বন্য প্রাণীর আনাগোনাও আছে এর ভিতরে। আমার রুমের জানালা দিয়ে দেখলাম এক শাখামৃগ ছাদের উপর লাফালাফি করছে। ছবি তুলতে বেরিয়ে এসে মুখোমুখি হলাম এক আসল মৃগের। স্টাফরা এসে আমাদের বলে গেলো রাতে রুম থেকে বের না হতে। মাঝে মাঝে নাকি হায়েনারা আসে দল বেঁধে। মনে মনে ভাবলাম, পারফেক্ট প্লেস ফর এ কনফারেন্স। তখনও কি জানি কি অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাবো এখান থেকে।

দিনটা ছিল রোববার। সাতসকালেই বের হলাম আমরা সাতজন। দুজন মার্কিন, দুজন জাপানি, একজন ব্রাজিলিয়ান, একজন কোরিয়ান আর আমি। এরা সবাই আমার পূর্ব পরিচিত। আগের রাতেই সাফারি গাড়ি ঠিক করা ছিল। খুব ভোরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির হলো। গাড়ি দেখে মনে একটু সন্দেহ হলো। এ তো মাইক্রোবাস। তাও আবার লক্কর মার্কা। আমাদের সাথে ট্যুর কোম্পানির কথা ছিলো সাফারি গাড়ি দেবার। কিন্তু দিয়েছে মাইক্রোবাস। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করাতে সে বললো আসল গাড়ি সার্ভিসিং এ আছে। অগত্যা কি আর করা। মাইক্রোতে চেপেই বুনোদের দেখতে চললাম। আর মনে মনে ভাবলাম সব জায়গায়ই দুই নম্বরি কাজ কারবার। দোষ হয় খালি আমাদের।

ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে যখন পৌঁছলাম তখনও রাতের আঁধার পুরোপুরি কাটেনি। সূর্যি মামা উঠি উঠি করছে। চারিদিকে আলো আঁধারের খেলা। এর মধ্যেই দর্শন মিললো একপাল ইম্পালার। হরিন জাতীয় তৃণভোজী প্রাণী। খুবই নিরীহ দর্শন। ড্রাইভারই আমাদের গাইড। সে বললো, এরা হলো সিংহের প্রিয় খাদ্য। ক্রুগারের ফার্স্ট ফুড। দেখ এদের পশ্চাত দেশে ম্যাকডোনাল্ডের মত একটা এম সাইন আছে। তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই তো তাই। গাড়িটা কাছে নিয়ে ছবি তুলতে গেলাম। ওমনি ব্যাটারা লেজ তুলে খুব জোরে দৌড়। ফার্স্ট ফুডই বটে।

আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে শুরু করেছে। আমরাও চলেছি ক্রুগারের আরো ভেতরে। একদম পীচ ঢালা মসৃন রাস্তা। চলেছি তো চলেছি। ছোটখাটো অনেক প্রাণী দেখলাম । কিন্তু এখনো বিগ ফাইভের দেখা মেলেনি। এই বিগ ফাইভ হলো সিংহ, হাতি, গন্ডার, লেপার্ড আর বাফেলো । এদের কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাত দেখি রাস্তায় যানজট। ব্যাপারটা কি?

বিষয়টা হলো এক সিংহ দম্পতি পাশের ঝোপে রাজকীয় ভোজে বসেছেন। তাদের ছবি তোলার জন্য পাবলিক সব গাড়ি থামিয়ে যানজটের সৃষ্টি করেছে। আমরাও তুললাম বেশ কিছু ছবি। এখানে বলে রাখি সিংহ ভায়ারা কাজ কাম কিছু করেনা। শিকার টিকার সব ম্যাডামই করেন। ভায়ার কাজ হলো চার পাঁচটা সিংহীকে সামলে রাখা। রাজা বাদশাহদের কাজ কারবারই আলাদা।

সিংহদের পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি আমরা। পথে দেখলাম একদল জেব্রা রাস্তা পার হচ্ছে। অথচ কোথাও কোনো জেব্রা ক্রসিং দেখলাম না। আশ্চর্য, জেব্রার জন্য কোনো জেব্রা ক্রসিং নাই! এর পর দেখা পেলাম গন্ডারের। পাথরের মূর্তির মত এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। নো নড়ন চড়ন। বেঁচে আছে কিনা কে জানে?

এখানে বলে রাখি ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক কোনো ঘন জঙ্গল নয়। এটা একটি সাভানা, গাছপালাগুলো বেশ দুরে দুরে। মাঝে ঘাসের জঙ্গল। বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। দৃষ্টি আটকায় না। তাই গাড়িতে বসেই বন্যপ্রাণী দেখা যায়। গাড়ি থেকে নামতে হয় না। গাড়ি থেকে নামা অবশ্য নিষেধ। কারণ যেকোনো সময় হিংস্র পশু ঘাড় মটকাতে পারে।

চলতে চলতে একসময় এক জলাশয়ের কাছে আসলাম। অসংখ্য ওয়াটার বাফেলোকে দেখলাম জলকেলি করতে। এরা সবসময় দলবেঁধে চলে। দলে বলে থাকে বলে সিংহরা এদের সচরাচর আক্রমন করতে সাহস পায়না। একা পেলেই ছিঁড়ে খায়। ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড ডিভাইডেড উই ফলের প্রাকৃতিক এবং ব্যবহারিক উদাহরণ।

আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে হাতিদের দর্শন মিললো। আফ্রিকান হাতি এক অতিকায় প্রাণী। আমাদের দেশী হাতি এদের কাছে শিশু। এই হাতি দেখতে গিয়েই বিপদটা হলো। হাতি গুলো একটা নালা থেকে পানি খাচ্ছিলো। রাস্তা থেকে খুব পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো না বলে ছবি তুলতে অসুবিধা হচ্ছিলো। আমাদের সাথের দুই আমেরিকান ড্রাইভারকে তাগাদা দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলেন রাস্তার বাইরে প্রায় ১০০ মিটার দূরে নালাটার কাছে। গাড়ি থামিয়ে ছবি টবি তোলা হলো বেশ। বিশ পঁচিশটা বিশাল আফ্রিকান বুনো হাতির খুবই কাছে আমরা। বেশ একটা থ্রিলিং ব্যাপার।

ছবি তোলা শেষ হলে গাড়িতে স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখা গেল গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছেনা। ইঞ্জিন বিকল। আগেই বলেছি গাড়িটা দেখেই আমার কেমন জানি সন্দেহ লাগছিলো। এবার ব্যাপারটা ফলে গেল মার্ফির ল -র মত। মার্ফি বলেছেন, থিংস দ্যাট ক্যান গো রং উইল গো রং। মনে মনে মার্ফির মন্ডুপাত করছি আর দেখছি হাতিগুলোর কাজ কারবার। তারা তখনও পানি খেতেই ব্যস্ত। ড্রাইভার বললো গাড়ি থেকে বের হবে না। বন্য হাতিরা গাড়ি দেখলে সচারচর আক্রমন করেনা কিন্তু মানুষ চলাফেরা করতে দেখলে আক্রমন করে মেরে ফেলে। গাড়িতে চুপচাপ বসে থাকো আর ঈশ্বরের নাম জপ কর।

মাত্র পঞ্চাশ মিটার দুরে বন্য হাতির পাল। আমাদের মাইক্রোবাস গুঁড়িয়ে দিতে একটি হাতিই যথেষ্ট। দোয়া দরুদ পড়ছি আর আড়চোখে দেখছি হস্তী বাহিনীর কার্যকলাপ। পানি খাওয়া শেষ হলো হাতিদের। তারপর তারা আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। আমাদের কোনরকম পাত্তা না দিয়েই। খুব কাছ থেকে দেখলাম ওদের। গায়ের কটু গন্ধও নাকে লাগছিলো । হাতি রাগলে ভয়ংকর। কিন্তু ওরা ছিলো খোশ মেজাজে। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলাম আমরা। তারপর সেই ভাঙ্গা গাড়ি ঠেলে ঠুলে রাস্তায় আনলাম। মোবাইল ফোনও কাজ করছেনা। নেট ওয়ার্ক নাই। অগত্যা কি আর করা। রাস্তায় এক চলমান গাড়িকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে লিফট নিলাম পরবর্তী রেস্ট এরিয়া পর্যন্ত। পরে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হলো মূলকেন্দ্রে।

এর পরেও কয়েকবার গেছি পার্কের ভিতর। রাতের বেলায় চাঁদের আলোতেও দেখেছি এর রূপ। অপরূপ এই রূপ। ভয়ংকর সুন্দর। দক্ষিন আফ্রিকায় গেলে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক দেখতে ভুলবেন না প্লিজ।

লেখাটি “ফিরে দেখা” বইতে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।