আমি বুশরা আর নাজ। আমাদের তিনজনের অনেক নাম কেউ বলে থ্রী স্টুজেস কেউ বলে থ্রী মাস্কেটিয়ারস, আবার কেউ বলে চার্লিস এন্জেল’স।‌ যদিও আমরা তিনজন একেবারেই তিন রকমের মানুষ। বুশরা কবিতা আবৃত্তি করে, নাজ গান গায় আর আমি ছবি তুলি।

আমরা ঠিক করেছি প্রতিবছর একবার হলেও তিনজনে মিলে কোথাও বেড়াতে যাব। ২০২০ এ গিয়েছিলাম ব্লু মাউন্টেনে (Blue Mountains), সেটা ছিল আমাদের প্রথম একসাথে কোথাও বের হওয়া। তারপর ২০২১ সালে উলঙ্গন (Wollongong), ২০২২ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের কেনোলা ট্রেইলে (Canola Trail) আর এবার ঘুরে ফিরলাম মেলবোর্ন থেকে। হিউম হাইওয়ে ধরে ক্যানবেরা থেকে মেলবোর্ন যাত্রাটা খুব সহজ কিন্তু খুব একঘেয়ে তাই ঠিক করেছিলাম আমরা যাব সমুদ্রের তীর ঘেঁষে। পরিকল্পনা মাফিক ক্যানবেরা থেকে চলে গেলাম কুমা (Cooma)। কুমাতে সকালের নাস্তা সেরে আমরা গাড়িতে উঠলাম। বুশরা একটু অসুস্থ থাকায় এই যাত্রা নাজ হবে ড্রাইভার, আমি জিপিএস আর বুশরা দুধ ভাত। বুসরা পিছনের সিটে উঠে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকলো। স্পটিফাইতে গান ছেড়ে দিয়ে আমি আর নাজ গল্প করতে করতে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে উঠে এসেছিলাম প্রিন্সেস হাইওয়েতে। প্রিন্সেস হাইওয়ে রাস্তাটি সমুদ্রের তীর ঘেঁষে চলে গেছে সিডনি থেকে মেলবোর্ন পর্যন্ত।

নিউ সাউথ ওয়েলস পার হয়ে ভিক্টোরিয়াতে প্রবেশ করে কিছুদূর যাওয়ার পরই বাম দিকে টুরিস্ট ড্রাইভ কেপ কনরান (Cape Conran)। নাজকে যখন বললাম চলো টুরিস্ট ড্রাইভ দিয়ে ঘুরে যাই, ও রাজি হলো। যেমন বলা তেমন কাজ, প্রিন্সেস হাইওয়ে ছেড়ে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে আমরা চলে গেলাম মারলো (Marlo) তে। সেখান থেকে স্নোয়ী রিভার (Snowy River) কে হাতে বায়ে রেখে আবার প্রিন্সেস হাইওয়ে এবং অবশেষে আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য লেক এন্ট্রান্স (Lakes Entrance)। আমাদের থাকার জায়গা ছিল একটি মটেলে যেটা ছিল একেবারে ঠিক লেক এন্ট্রান্স লুক আউট পয়েন্টের সাথে লাগানো।

দুপুর নাগাদ আমরা লেক এন্ট্রান্সে এসে পৌঁছেছিলাম। বুশরা খুবই ভোজনবিলাসী, ও সাথে থাকলে খাওয়া-দাওয়ার কোন চিন্তাই নেই। আসার সময় বুশরা আমাদের খিচুড়ি আর বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে এসেছিল। আমরা মোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে, খাবার খেয়ে সাথে সাথেই বের হয়ে গিয়েছিলাম। সময়টা শীতকাল, দিন ছোট হাতের সময় বেশি ছিল না। আমাদের আশেপাশে‌র দেখার মত জায়গাগুলোই দেখেছিলাম।

মোটেলটার ঠিক সামনেই লেক এন্ট্রেন্স লুকআউট পয়েন্ট আর মোটেলটাকে হাতের বায়ে রেখে পাহাড়ি রাস্তা নেমে গেছে একেবারে লেকের ধারে জেটি পয়েন্টে। জেটি পয়েন্টে গাড়ি করেও যাওয়া যায়। সময় বাঁচাতে আমরা গাড়ি করেই চলে গিয়েছিলাম জেটি পয়েন্টে l সেখানে দাঁড়িয়ে তিন বন্ধু নিমগ্ন হয়ে উপভোগ করেছিলাম লেকের বুকে সূর্যাস্ত আর পেলিকানের ভেসে চলা।

যদিও অরিজিনালি আমাদের প্ল্যান ছিল সকালের নাস্তা সেরে চলে যাব মেলবোর্ন কিন্তু রাতে আমরা ঠিক করলাম এত দূর এসেও লেক এন্টেন্স এলাকাটা না দেখে চলে যাওয়াটা বোকামি হবে। কাজেই প্ল্যান হলো সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা শহরটা ঘুরে দেখব তারপর একটা বোট ক্রুজ নিয়ে পুরো লেকটা ঘুরে আসবো। এখানে বলা ভালো যে এলাকাটার নাম লেক এন্টেন্স হলেও লেকটার নাম কিন্তু গিপসল্যান্ড (Gippsland) লেকস। এই এলাকার লেকটিকে ছোট্ট একটা খালের মাধ্যমে তাসমান সমুদ্রের সাথে যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে সংযুক্ত করা হয়েছে ওই জায়গাটার নামই হচ্ছে এন্ট্রান্স।

গিপসল্যান্ড লেক প্রায় ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। অনেকগুলো লেক, নদী খাল এখানে এসে মিলেছে।‌ লেক গুলি নাইনটি মাইল বীচ দিয়ে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন। এই এলাকার লেকটার অনেকগুলি শাখা-প্রশাখা। লেক এন্টেন্স শহরটা গড়ে উঠেছে এই লেকের কানিংহেম আর্ম (Cunninghame Arm) আর নর্থ আর্মের (North arm) মাঝখানে।

আমাদের দিন শুরু হয়েছিল লেক এন্ট্রান্স লুক আউট পয়েন্টে। সেখান থেকে আমরা গিয়েছিলাম একেবারে সিটি সেন্টারে, এসপ্ল্যানেডে। শহর থেকে সমুদ্র সৈকতে যেতে হলে কানিংহেম আর্ম পার হতে হয়। এই ছোট্ট প্রণালীটা পার হওয়ার জন্য একটা পায়ে হাঁটা ব্রিজ আছে। আমরা শহরের ক্যাফেতে নাস্তা খেয়ে কানিংহেম আর্মের ফুট ব্রীজের উপর দিয়ে হেটে গেলাম বাস প্রণালীর (Bass Strait) সমুদ্র তীরে। ওখান থেকে ফিরে গেলাম ইকো ক্রুজের বোটে।‌

দিনটা ছিল রৌদ্রজ্জ্বল। শীতকাল একেবারেই মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল যেন বসন্ত এসে পড়েছে। ইকো বোট আমাদেরকে নিয়ে ভেসে গেলো নীল পানির বুক চিড়ে। একপাশে নাইনটি মাইল সমুদ্র সৈকত আরেকপাশে ইনল্যান্ড। বিশাল লেকের বুকের মধ্যেও আছে অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপ। ফ্রেজার আইল্যান্ড, পেলিক্যান্ আইল্যান্ড, আরো অনেক। আমাদের বোটের ক্যাপ্টেন টনি বোট চালাতে চালাতে লেক এন্ট্রেন্স এর ইতিহাস বলছিলো আর আমরা ব্যাস্ত ছিলাম নীল সবুজের মাখামাখি, সিল মাছের খেলা, পেলিকনের উড়ে চলা, কাল রাজহাঁসের দল বেঁধে ভেসে চলা, পানকৌড়ির উড়ে বেড়ানো দেখতে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে তিন ঘন্টা পার হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। মাঝখানে বোট ক্যাপ্টেনের স্ত্রী ম্যান্ডি ফ্রেশ স্কোন বেক করে নিয়ে এলো সবার জন্য। তিন ঘণ্টা ক্রুজ শেষে বুক ভরা এক প্রশান্তি নিয়ে আমরা ফিরে আসলাম লেক এন্ট্রান্স এসপ্ল্যানেডে।

রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মত “শেষ হইয়াও হইল না শেষ” এমন এক অপূর্ণতা নিয়ে আমরা রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যর দিকে।