গত বছর পাচেক অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে টুকিটাকি লিখছি। জেগে থাকা স্বপ্ন থেকে স্বপ্নময় এক জগৎ দেখা এখন শেষ আর যখনই মনে হয় শেষ, শুরুটাও আবার সেখানে। শারমিন আর আমার জগৎ ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত দেখা শেষ। সে এক অদ্ভুত স্বপ্নময় জগৎ, হয়তো পৃথিবী নয়, হয়তো অন্য এক ভূবন।
পৃথিবীর শেষ মহাদেশ, সাদা মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা থেকে আমরা দুজন ঘুরে এসেছি। ঠিক এই কথাটা বলতে গিয়েও মনে হলো, না, হয়তো ঘুরে আসিনি, ওটা ছিলো ঘুমিয়ে থাকা এক স্বপ্ন। অনেক ছবি আর ভিডিও আছে, তার মানে আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু জায়গাটা ঠিক ছবি, ভিডিওর মতো নয়, পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে যা অনুভব করা যায়, তাকি ছবিতে ভেসে উঠে।
হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর এই প্রান্তের গল্প নিয়ে একটা বই লিখে ফেলবো। ইচ্ছে করে না. লিখে কি বলা যাবে? মাঝে মাঝে গভীর ঘুমের স্বপ্নে যা ভেসে উঠে, সকালে জেগে কি তা কাউকে বলা যায়?
বই না হয় কোনো একদিন লিখেই ফেলবো। আপাতত সার সংক্ষেপ বলি শারমিন আর আমি একসাথে আছি ২০০৫ থেকে। আর সব মানুষ বা দম্পতিৰ মতো আমাদের নিজস্ব গল্প আছে কিছু নিজেদের, কিছু অন্যকে বলা যায়. আমাদের ভ্রমণের গল্প হয়তো সবাইকে বলা যায়. কেন ভ্রমণ করি সে এক লম্বা ফিলোসোপিকাল আলাপ। এই আলাপে গেলে জীবন আর বাস্তবতার অনেক কিছুই চলে আসবে, গল্প চলে যাবে অন্য দিকে। কিন্তু সই একই সুতায় গাঁথা।
ভ্রমণ কেন করবেন না সে ব্যাপারে আমি সংক্ষেপে বলতে পারি। যেমন ধরুন, আপনি অপেক্ষায় আছেন, একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে আর সবার মতো আপনাকেও যেতে হবে. ওপারে আছে অনন্তকাল। যদি ভাগ্য ভালো হয় হয়তো স্বর্গে একদিন যাবেন। আর তা যদি সত্য হয় তবে অযথা দুই দিনের এই পৃথিবীতে ভ্রমণ করে অর্থ সময় নষ্ট করার কি প্রয়োজন। স্বর্গে অনন্ত কালে যা কিছু দেখেননি, ঈশ্বরকে বলবেন, উনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে।
যাই হোক, গল্প হয়তো আবার অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। আমরা দুজন ভ্রমণ করি শ্রেফ অভিজ্ঞতার জন্য। যা কিছু দেখা যায়, জানা যায় দুচোখ বুজিবার আগে। অনেকটা পথ ঘুরে, বহু মানুষের জীবন যাত্রা দেখে, স্বচক্ষে ইতিহাসের কাছাকাছি দাড়িয়ে অবশেষে যেটুকু বোঝা যায় তা হলো- কত ক্ষুদ্র আমি, কতো ক্ষুদ্র তুমি। জীবনের মানে কী, বেচে থাকার এতটা লালসা কোথায়, কেন?
আমার কাছে জীবন মানে তিনটা জিনিস- মস্তিস্ক (মন), স্থান আর কাল. জীবন মানেই তো ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার সমিষ্টি। ঘটনা ঘটছে স্থান-কালে, আর মস্তিস্ক কিভাবে তা দেখছে। জীবনের চাওয়া পাওয়া, রাগ ঘৃণা, ভালোবাসা যত ধরনের অনুভূতির কথাই বলি না কেন, সব ওই মস্তিকে। ভালো থাকা এক ধরনের দক্ষতা, অনেকটা মেসির ফুটবল খেলার মতো. অনুশীলন করতে হবে, মস্তিষ্কের অনুশীলন। এই যা, আবার গল্প দিকে চলে যাচ্ছে। এতক্ষনে হয়তো অনেকে মনে করছে এই লোক এতো পেছাচ্ছে কেন. সোজা সুজি অ্যান্টার্কটিকা কিভাবে গেলো বলে দিলেই তো হয়. শুনলাম, দু-চারটা ছবি দেখলাম, ভালো লাগলে একটা “লাইক” ক্লিক করে অন্য কোথাও চলে গেলাম। থামুন ! পেছাচ্ছি কারণ আমার মস্তিষ্কে যা কিছু ঘটে, সে বের করতে গেলে তো ছোট গল্প নয়, উপন্যাসের পর উপন্যাস লিখতে হবে.
হুট্ করে কিন্তু আমরা অ্যান্টার্কটিকা চলে যায়নি।অনেকটা পথ, অনেকটা চিন্তা, অনেকটা সঞ্চয়, আর প্রবল আকাঙ্খার পরেই শেষ মহাদেশে আমাদের পদার্পন। আমাদের ভ্রমণের সারসংক্ষেপটা অনেকটা এরকম:
বছর বিশেক আগে আমেরিকাতে এসেছি। কোনো ফাইন্যান্সিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া। আর সেখান থেকেই প্রথম কয় একটা বছর বেড়াছেড়া অবস্থা। রীতিমতো জীবন যুদ্ধ। ছোট বেলায় আমাদের শেখানো হতো – টাকা পয়সাই জীবনের সব না, টাকায় সুখ-শান্তি আনে না. কথা হয়তো খানিকটা সত্য। যেটা আমাদের শিখানো হতো না -টাকা পয়সা ছাড়া জীবনে সুখ শান্তি অসম্ভব, এবং এটা সত্য। পৃথিবীর বেশ কিছু মানুষ যাদের টাকা নেই তারা ছুটছে টাকার পিছনে, কিছু মানুষ যাদের অনেক টাকা আছে তারাও ছুটছে টাকার পিছনে।ছুটে ছুটে কোথায় যাচ্ছে আমি জানি না. আমি যেটা জানি, টাকার প্রয়োজন অনেক, তবে জীবনের সাথে সামঞ্জস্য মেলানোটা অনেকেই ঠিক মতো করতে পারে না।
আমার কাছে জীবন অনেকটা এক তরকারী দিয়ে ভাত খাবার মতো. কেউ আছে, এক তরকারী দিয়ে খাচ্ছে, কেউ আবার দশ পদ সামনে নিয়ে একটা একটা করে চেকে যাচ্ছে। এক জীবনে সব কিছু চাইলে তো হবে না. জীবনের পথ একটা, জীবনের চাওয়া গুলোকে গুরুত্ব আকারে সাজাতে হবে. গাড়িও কিনবো, ফ্লাট হবে, পোলাপান ইংলিশ মিডিয়ামে যাবে, সামাজিকতা বজায় রাখতে হবে, গয়না গাটিতে মোড়ানো থাকবে বিবাহীত জন, সপ্তাহে আবার দু-তিনবার ডিনারে যেতে হবে. সেই সাথে ঘরে দুই-একজন কাজের মানুষ, ড্রাইভার তো থাকতেই হবে. ছেলে-মেয়ে কি রিকশায় করে স্কুলে যাবে? যাই হোক, স্টেটাস স্টেটাস স্টেটাস সব চাই. খুব হাতে কোনো কিছু মানুষই হয়তো এই সব স্টেটাস আর চাওয়া-পাওয়া মেটাতে পারে। পরিবার বেশীর ভাগ মানুষই দৌড়ের উপর থাকে কিভাবে খাবে, কিভাবে বাসা ভাড়া দেবে, কিছু চিকিৎসা, ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার খরচ।
জীবন ততো জটিল যখন মানুষ একের পর এক দায়িত্ব / বোঝা বাড়াতে থাকে। এই দায়িত্ব/বোঝা বলতে আমি সব কিচিছুকেই বোঝাচ্ছি। বাসায় একজন ড্রাইভার রাখা এক বোঝা, ১০ হাজার টাকার বাসা ভাড়া থেকে ১২ হাজারে উঠা বোজা, বিয়ে করাটাও বোঝা যদি সামর্থ না থাকে। এ পৃথিবীতে যে মানুষের জন্ম এখনো হয়নি তাকে বংশ বৃদ্ধি আর ভালোবাসার অজুহাতে নিয়ে আনাটাও বোঝা। তারপরও জীবনে বেচে থাকার জন্য কিছু বোঝা আমাদের বইতেই হবে. আর সেখানেই জীবনের চাওয়া গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সাজাতে হবে।
আমাদের জীবনে জাগতিক নিয়মে বোজার পরিমান একটু কম। তাছাড়া, দুজনই ভালো চাকরী করি সেটাও একদিনের নয়, পেছনে আছে লম্বা সময়ের পরিশ্রম। এতক্ষনে আপনারা মোটামুটি নিশ্চিত, আমার পেচানোর স্বভাব।আসলে ব্যাপারটা তা নয়, সাথে থাকুন। আসছি অ্যান্টার্কটিকা গল্পে।
২০০৮ সালে শারমিন আর আমি প্রথম ইন্টারন্যাটিনাল ট্রিপে বের হয়, বাহামাস ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। তখনও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি যে রক্তে ভ্রমণ নেশার ওষুধ ঢুকাচ্ছি। করতে করতে দুনিয়ার বেশ কিছু দেশ ঘোড়া হয়ে গেলো। ২০১৬ সাল, শারমিন টিভিতে কোনো একটা ডকুমেন্টারী দেখছে, অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে। হটাৎ বলে ফেললো -আমি অ্যান্টার্কটিকা যেতে চাই. এক কার দিয়ে ঢুকালাম, কিন্তু অন্য কান দিয়ে বের করার আগে গুগল করে বেসিক ইনফরমেশন নিয়ে যা জানলাম -হ্যা, যাওয়া যায়. ভয়ংকর খরচ. শারমিনের জীবনের পসিটিভ অনেক কিছুই আছে, হয়তো সেটাও একটা বইয়ের আকার নিবে। যাই হোক, সে বললো টাকা সেভ করা শুরু করবে। আমাদের দুজনের আয়ের কমপ্লিট ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট শারমিনের হাতে।সী ইস নট অনলী এক্সপার্ট, সী ইস ব্রিলিয়ান্ট। বছর তিন পার হতেই হটাৎ অ্যান্টার্কটিকা যাবার সঞ্চয়ের হিসাব দিলো। অনেক টাকা জমে গেছে, ১৭ হাজার ইউ এস ডলার হাতে। তারপরও যাবার জন্য যা দরকার তার অর্ধেক রাস্তায় আছি আমরা। কোনোমতে সস্তায় অ্যান্টার্কটিকা যাওয়া যায়, জনপ্রতি তাও হাজার দশেক লাগে। আমরা ওভাবে যাবো না, জীবনে একবারই যাবো, যাবার মতো যাবো। আরাম করে যাবো। ড্র্রেক প্যাসেজ ক্রস করে যাবো, এক্সপেডিশন শিপ এ যাবো, লাক্সারী শিপ এ যাবো। খরচ লাগবে ৩২,০০০ ইউ এস ডলার। কী আছে জীবনে, অদৃশ্য বন্ধুক বের করে গুলী ছুড়লাম। ক্রেডিট কার্ড থেকে বাকী টাকা দিবো। এক বছররের বেশী সময় হাতে নিয়ে বুকিং, এক বছর ধরে ক্রেডিট কার্ড এর দেনা পাওনা মিটাবো। ২০১৯ এর আগেস্টে সিলভার-সী ক্রুস লাইনে ফুল পেমেন্ট করে দিলাম ২০২০ এর নভেম্বর ভয়াজের জন্য। ১৪ রাতের ভয়েজ, নবেম্বর ভয়াজের বুকিং ফী একটু কম. অ্যান্টার্কটিকা যাবার সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। এখানে সামার/গ্রীস্ম বলে কিছু নেই. ডিসেম্বর এ তাপমাত্রা সবচেয়ে ভালো থাকে, শূন্য ডিগ্রী। সুর্য দেখা যাই ১৮ ঘন্টার মতো। ডিসেম্বর এবং ডিসেম্বর এর শেষ অংশে (ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার) খরচ সবচে বেশী।
অ্যান্টার্কটিকা যাবার বীজ বপন হলো, এখন অপেক্ষার পালা। সামনে সময় এক বছর তিন মাস. সময়টা কিন্তু অনেক লম্বা, কত কিছুই তো ঘটে যেতে পারে। ২০২০ এর শুরুর দিকে অ্যান্টার্কটিকা যাবার কাপড়-চোপড় কেনা কাটা শুরু করলাম, অনেকটা আনন্দ নিয়ে। এখানে যাবার জন্য শীতের জামাকাপড় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই কেনাকাটার পর্ব চলবে সামনের বেশ কয়েক মাস.
শুরু হলো বিশ্ব জুড়ে কোভিড, একে একে বদলে যেতে থাকলো জীবন যাত্রা, শুরু হলো আন্তর্জার্তিক ভ্ৰমণ নিষেধাজ্ঞা। চারিদিকে মানুষ হারাচ্ছে চাকুরী, মারা যাচ্ছে আপনজন। অদ্ভুত খারাপ সময় সামনে।
আমার বাবা মারা গেছেন ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারী। মা থাকেন বড় ভাইয়ের সাথে ঢাকায়। বেশ কিছুদিন যাবৎ মাযের জন্ডিস। চারিদিকে মহামারী, ঘোরছেড়ে বের হচ্ছে না মানুষ, হাসপাতালগুলোর অবস্থা নড়বড়ে, ডাক্তারও রোগী দেখা সীমিত করে রেখেছে। আমরা ছয় ভাইবোন। বড় ভাই আর বড় বোন আছে ঢাকায়। বাকিরা আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া।
জুন মাসের মাঝামাঝি, সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে আমি কম্পিউটার নিয়েই থাকি, টিভি চলে সামনে। বোনের ফোন এলো. সে তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ খবর টা আমাকে দেবে। আমি শুনলাম। তার পর থেকে আমার মাথার মধ্যে দিয়ে কী ঘটে গেছে, কী হয়েছিলো এসব নিয়ে এখন লিখতে ইচ্ছা হয়েছে না। আমার মায়ের প্যানক্রেটিক ক্যান্সার। এর পরের সময় গুলো যেভাবে যাবার কথা তাই. শারীরিক অবস্থা, অসুখের ধরণ, সময়, আর সারা বিশ্বের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমার মায়ের হাতে সময় আছে ৬ থেকে ১২ মাস. মায়ের অসুখটা নিয়ে আমিও সবচেয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করেছি, জানার চেষ্টা করেছি। আমি মিরাকেল এ বিশ্বাস করি না. প্রকৃতি, জীব, জীবন কোনো কিছুই নিয়মের বাইরে নয়। আমার বোঝামতে মায়ের সময় ধরে নিলাম ৬ মাস এভাবেই এগোতে হবে।
অ্যান্টার্কটিকা যাবার প্ল্যান ক্যানসেল করবো নভেম্বরের ঠিক ৩ মাস আগে. বুকিংয়ের এর নিয়ম অনুযায়ী ৩ মাস আগে ক্যানসেল করা যায়. সারা বিশ্বে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থেকে আমিও নিশ্চিত ছিলাম আমি নিজে থেকে ট্রিপ ক্যানসেল না করলেও সিলভার-সী করবে। এবং তাই হলো. সিলভার-সী ২০২০ এর সব ভয়েজ ক্যানসেল করলো।অনেকগুলো টাকা জমা দেয়া, কিছুটা ভয় আছে. এই ধরেনর ইকোনোমিতে বিসনেস ব্যাঙ্ক-ক্র্যাফট করে, দেউলিয়া হয়ে যায়. কিছুই করার থাকে না. বেশ কয়েকবার চিন্তা করলাম টাকা তুলে ফেলবো। শারমিন মানা করলো, রিস্ক নিতে বললো, টাকা তুললে অন্য কাজে খরচ হয়ে যাবে। অ্যান্টার্কটিকা আর যাওয়া হবে না. রিস্ক নেবার একটা ভালো দিক হলো সিলভার-সী পরের বছর, ২০২১ এর ডিসেম্বর এর পিক-সীজনের বুকিং দিলো, নতুন ভয়েজের খরচ ৪৮,০০০ টাকা। আমাদের কোনো এক্সট্রা টাকা দিতে হবে না. এই হলো সুবিধা। টাকা তুললাম না. পরের বছরের বুকিং নিলাম।
এর পর প্রতিটা মাস, প্রতিটা দিন খান খেটেছে মাকে নিযে। কবিড নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দেশে গেলাম দুবার। শেষ বার শেষ যাওয়া মায়ের জন্য। ছিলাম আড়াই মাসের মতো। ২০২১, এপ্রিলের মাঝামাঝি আমার মা চলে গেলেন। মা যাবার পর আমার মাঝে মাঝে মনে হতো আমার নিজের ছেলে-মেয়ে থাকলে ভালোই হতো. মায়াটা অনত্র থাকতো। চারপাশের সবাইকে দেখে বুঝি যার সন্তান আছে, তার চিন্তা চেতনার প্রথম মানুষটাও তার নিজস্ব সন্তান। আমরা প্ল্যানিং করেই সন্তান না নিয়ে আছি. কাজেই আমার ক্ষেত্রে আমার চিন্তা চেতনার ক্ষেন্দ্র বিন্দু ছিলো আমার মা।
আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ, আমার রাগ কষ্ট চিৎকার সব ঢেলে দেবার জায়গা আমার মা, আমার শেষ আশ্রয় আমার মা। মা নেই, আমি স্বাধীন। আর কোনো চিন্তা নেই. সমস্যা হলো এক ধররেন ডিপ্রেশনের মধ্যে পরে গেলাম। আমি জীবনমুখী মানুষ, আমি ডারউইনের লোক, বিজ্ঞান আমার সামনে। যত কষ্টই হোক, আমার মা না, আর কখনো দেখা হবে না, আমাকে ভালো থাকতে হবে, আমি ভালো থাকলে সবচেয়ে যে মানুষটি বেশী খুশি হতেন তা হলো মা।
মা মারা যাবার সময় আর ঢাকাতে যেতে পারিনি। সময় দেননি, ডাকার এয়ারপোর্ট ও বন্ধ, কবিড তখন ভয়াবহ। মা যাবার এক দিন পরেই আমি টিকিট কেটে অল্যাস্কা চলে গেলাম। অনেক দূরে কোথাও যেতে হবে আমাকে, গাড়ি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। কোনোভাবে মেক জানানোর চেষ্টা করলাম – আমি ঠিক আছি. সব ঠিক হয়ে যাবে। মা যাবার ২ মাস পর কোরবানী। আমাদের গ্রামের বাড়ী পটুয়াখালী। বাবা-বা দুজনেই ওখানে আছেন। আমাদের গ্রামের বাড়ী, গ্রামের নাম লোন্দা।
প্রতিবছর কোরবানীর সময় দেশের বাইরে থাকা ভাই-বোনেরা দেশে টাকা পাঠাই কোরবানী দেয়ার জন্য। ভাইয়া, ভাবী আর তাদের একমাত্র ছেলে ইমু কোরবানীর ঈদে বাড়ি গেলো। পটুয়াখালী যেতে হয় বরিশালের উপর দিয়ে। বরিশালে আমার ভাবীর বাপের বাড়ী। লোন্দা গ্রামে কোরবানী শেষ করে ভাবী ইমুকে নিয়ে বরিশাল ফিরবে বাপের বাড়ী, ভাইয়া থাকবে কিছিদিন গ্রামে। ফেরার পথে ভাবী আর ইমুকে নিয়ে ঢাকা ফিরবে। ঈদের পরের দিন গ্রাম থেকে বরিশাল ফেরার পথে আমরা ইমুকে হারালাম। রোড এক্সিডেন্ট।
দাদা-দাদীর পাশে ঘুমিয়ে পড়লো ২০ বছরের ইমু মাকে নিয়ে ডিপ্রেশন বন্ধ হয়ে গেলো। এখন ইমু. আর ভহইয়ার প্রতিটা দিন।
জুলাই শেষ. তারপর অগাস্ট। কানাডাতে আমার ভাইয়ের এক মাত্র ছেলে আয়ান, বয়স ১৩ বাবা মায়ের সাথে ঘুরতে গিয়ে স্পিড-বোট থেকে পরে প্রপ্রেলার ব্লেডে এক্সিডেন্ট। ভাগ্যে জীবন রক্ষা, একটা পা হয়তো যারা জীবনের জন্য নড়বড়ে। কাছের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের বাবা-মা অনেকেই চলে গেছেন এই বছরটাতে। বেচে যে আছি সেই তো এক সৌভাগ্য। এর পরের তিন মাস আমরা দুটো ইন্টারন্যাশনাল ট্রিপ করেছি। ইউক্রেইন্ আর রোমানিয়া। জীবনে ফিরে যাবার চেষ্টা, সোজা হয়ে আবার হেটে চলা।
ডিসেম্বর এর ১৯ তারিখ আমাদের ফ্লাইট অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশ্যে। প্রিপারেশন অনেক। গভর্নমেন্ট রেগুলেশন, কাবিদ, একের পর এক টেস্টিং, চিলিয়ান গভর্নমেন্টের অনুমতি সে এক লম্বা লিস্ট। এতো গুলো বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে, অথচ অনেক ভয়. যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি, যদি টেস্ট রিপোর্ট পসিটিভ হয়, তাও আবার একবার টেস্ট নয় ১৮ তারিখ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিদিন টেস্ট। যাবার আগে টেস্ট, এয়ারপোর্টে টেস্ট, হোটেলে টেস্ট, শিপে উঠার আগে টেস্ট, শিপে ১৫ দিনে ২ বার টেস্ট, প্রতিসকালে টেম্পারেচার চেক যাই হোক, অনিশ্চতা চারিদিকে। একটু সমস্যা হলেই সব শেষ।