অনেকেই যখন গল্প শুনতে চায়, তারা খোজে জীবনের কষ্টের অংশ, বাধা বিপত্তির অংশ। কীভাবে কী হলো, কতটা বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে ঘটনা এগুলো ইত্যাদি। জীবন মানেই তো চড়াই-উতরাই, আনন্দ বেদনা। দূর থেকে হয়তো ওপাশটা অনেক সুন্দর মনে হয়, কিন্তু প্রকাশ্যে বা চেপে থাকা সংগ্রাম আমাদের সবার মাঝেই আছে।
বহু বছর বেঁচে থেকে মাঝে কিছুটা ভালো সময়য়ের নামই জীবন, বেঁচে থাকার আনন্দ অনেক না পাওয়ার মাঝে কিছু অর্জন।
আমাদের ভ্রমণের ব্যাপারটাও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা সবাই কিছু না কিছুর পিছু ছুটছি। কিছু পিছুটান, কিছু আকাঙ্খা নিয়েই দেখতে দেখতে জীবন শেষ।
জীবনে ছোট বড় বিষয় গুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে সাজাতে থাকি। কারো ব্যবসা, কারো সম্পত্তি, কারো ছেলে-মেয়ে মাউস করা, কারো হয়তো ঘাপটি মেরে ঘরে বসে থাকা, যার যা ভালো লাগে তাই চলছে চারপাশে। বছর দশক আগেও ভাবিনি আমরা অজানা দেখার নেশায় পরে যাবো। শুরুরটা ছিল কোথাও বেড়াতে যাওয়া, দুই তিন চার পাড়ি দিতেই রক্তে নেশা চেপে ধরলো। এখন দুনিয়া দেখতে হবে, এই আমাদের স্বর্গ। চোখ বুজার পরে অন্য কোনো স্বর্গ অপেক্ষায় আছে কিনা জানা নেই, থাকলেও তা হবে অন্য কোনো জগৎ, আমি হবো অন্য কেউ। এই ক্ষনিকের স্বর্গে চোখ বুজার আগে আমাদের যেতে হবে বহুদূর। প্রয়জন অর্থ, স্বাস্থ্য আর সময়। এই তিনের একটা ঘাটতি থাকলেও হবে না স্বর্গে পদার্পন। ছোটবেলায় অনেকেই শিখিয়েছে টাকা পয়সায় সুখ কেনা যায় না, যেটা শিখানো হয়নি তা হলো – টাকা পয়সা ছাড়া সুখ হবে নারে পাগল। কাজেই অর্থ লাগবে, বংশ পড়াম্বনায় তা থাকলে তো বেশ ভালই। আমরা সেই পক্ষের নই, কাজেই আমাদের কাজ করতে হয়। শুরুতে কতটা পড়াশুনা আর পরিশ্রম সে নিয়ে আলাপ এখন থাকে। শুধু জেনে রাখা ভালো সেই গল্প শুনলে অনেকেই হয়তো বলবে, থাক আপাতত ভ্রমণের দরকার নাই, হুদাহুদি এতো কষ্ট কে করবে।এর চেয়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করি, ওপারে অনন্ত কাল, ঈশ্বর হাত ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে সব। এখন ভালো ঘাপটি মেরে ঘরে বসে থাকি। কিন্তু একটু কষ্ট করে নিজেকে যদি দাড় করানো যায়, তার পর যদি শুরু হয় অজানার পথে পা বাড়ানো, মনে রেখো সে এক স্বর্গীয় তৃপ্তি।
আমরা দুজন মানুষ, এক সাথে আছি ১৭ বছর। প্রথম ৫ বছর বাদ দেই, সেটা ছিলো সোজা হয়ে জীবনে দাড়ানোর সময়, জীবন সংগ্রাম। এর পর আসি গত ১২ বছরের সারসংক্ষেপে, আমাদের দেখা হয়েছে ৭ টি মহাদেশ, পৃথিবীর ৮৩ টি দেশ। ৭ মহাদেশের শেষটি অবশ্যই এন্টার্টিকা। সেখানে যাবার পরিকল্পনাও গত ৫ বছরের।বড় বাধা -টাকা। ইচ্ছা আর সামর্থের যোগে জোগাড় হয়ে গেলো ৩০ লক্ষ টাকা। জমা দিয়ে শেষ মহাদেশ যাবার পরিকল্পনা শেষ, এখন অপেক্ষার পালা। এন্টার্টিকা অনেক ভাবেই যাওয়া যায়, সবচেয়ে ভালো আর্জেন্টিনা বা চিলি থেকে ক্রুজে করে, ড্রেক প্যাসেজ পাড়ি দিয়ে।
যাবার তখন এক সপ্তাহ বাকী। মাস খানেক আগেই চিলিয়ান গভর্নমেন্টের অনুমুতি পেয়েছি। অনলাইনে কাগজ পত্র জমা দেয়া, কবিড ভ্যাকসিনেশন, ট্রিপ প্ল্যান ইত্যদি। মেডিকেল হেলথ ইস্যুরেন্সও কিনতে হলো কবিড এর জন্য। পুরো সপ্তাহটা সাবধানে থাকলাম, কোনোভাবেই কবিড পসিটিভ হওয়া যাবে না। যাবার আগে টেস্ট করলাম দুবার, ওমা রেজাল্ট আসে না, এয়ারপোর্টে যাবার মাত্র ৩ ঘন্টা বাকী। যাই হোক, এদিক ওদিক ফোন করে রেজাল্ট পাওয়া গেলো। আবারও অনলাইনে ঢুকে চিলিয়ান গভর্নমেন্ট কে হেলথ ডিক্লারেশন দিলাম। ২০ বছর ধরে গাড়ি চালাই, সাবধানেই চালাই। এবার কানেক্টিকাট (আমাদের বাসা) থেকে নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্ট এ গেলাম অতিরিক্ত সাবধানে গাড়ি চালিয়ে। কোনো রকম কোনো দুর্ঘটনায় পড়া যাবে না। নিজের গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে রেখে গেলাম, ট্যাক্সি বা উবার নেয়া যেত, কিন্তু না। সাবধানে থাকতে হবে, এন্টার্টিকার জাহাজে উঠার আগে পর্যন্ত কোনো ভাবেই কবিড পসিটিভ করা যাবে না। সামনে আরও অনেক টেস্ট বাকী। চিলিতে নামার পর এয়ারপোর্ট এ টেস্ট, হোটেলে গিয়ে জাহাজে উঠার আগে আবার টেস্ট।এ এক ভয়ংকর মানসিক চাপ, যদি ঝামেলা হয়, উঠতে পারবো না, ৫ বছরের স্বপ্নের আপাতত সমাপ্তি হবে করেনটিনের মাধ্যমে, চিন্তা করতেই মনে হয় শীত সিট ভাব, গা গরম গরম লাগছে।
আমাদের যাত্রা শুরু হলো নিউ ইয়র্কের জে. এফ. কে. এয়ারপোর্ট থেকে। এখন থেকে চিলির সান্টিয়াগো। সেখানে নামার পর আর একদফা নিয়ম কানুন আর কোবিদ টেস্ট। আমাদের ক্রুজ লাইনের রিপ্রেসেন্টেটিভ ছিলো এয়ারপোর্টে, বাসে করে নিয়ে গেলো ম্যান্ডারিন হোটেলে। ফাইভ-ষ্টার লাক্সারী হোটেল, সবই ঠিক আছে শুরু রুমে থাকতে হবে এয়ারপোর্টে করা কবিড-এর রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত। প্রিলিমিনারী একটা ইমেইল আসলো, সব স্প্যানিশে লেখা। কোথায় যেন দেখলাম একটা শব্দ “নেগেভিতো” টাইপ। ভাবলাম ঝামেলা শেষ, রুম ছেড়ে বের হলাম হোটেলে ডিনার এদিক ওদিক হাটাহাটি। পরে জানলাম রেজাল্ট এখনো আসে নি, যাই হোক রেজাল্ট আসলো মাঝ রাতে। এই হোটেলেই ক্রুজের সব গেস্ট জড়ো হবে, এখানেই রাত থেকে সকালে একটা চার্টার ফ্লাইটে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে চিলির দক্ষিণে, পুন্টা এরিনা শহরে। সেখানেই আমরা জাহাজে উঠবো।
অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। আজ আমাদের সেই দিন, আজ আমরা রওনা দিবো এন্টার্টিকার দিকে। সকালে নাস্তা শেষ করার পরেই জানানো হলো কিছু দেরী হবে, কোনো একটা ঝামেলা চলছে। ক্রুজের সব গেস্টরা এদিক ওদিক বসে আছে, হাটাহাটি করছে, গল্প করছে, অপেক্ষায় আছে সবাই। চারিদিকে হাটাহাটি করা লোকজন দেখে বোঝা যায় করা এই ট্রিপের যাত্রী। শারমীন এন্ড আমি বসে আছি হোটেলের সুমিং পুলের পাশে। এক ভদ্রলোক এসে পরিচয় দিলাম, স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে তারাও যাচ্ছে। ভদ্রলোকের নাম রেট, আমার আবার উচ্চারণে ঝামেলা। আমার মুখ থেকে চলে আসে RAT (ইঁদুর), শারমীন কয়েকবার সাবধান করে দেবার পর উচ্চারণ একটু ঠিক করলাম। এর পর সামনের ১৬ দিন আমি তাকে “রেট” বলেই ডেকেছি। যাই হোক রেট জানালো আমাদের জাহাজ পোর্টে ভিড়তে পারছে না, প্রচন্ড ঝড়ো-হাওয়া। আমরা এর আগেও একবার পুন্টা-এরিনাতে গিয়েছি। সেখানে বাতাস কি জিনিস তা আমাদের জানা। প্রায় ঘন্টা তিনেক অপেক্ষার পর আমাদের বাসে করে একটা প্রাইভেট টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হলো। লাল গালিচা বিছানো, কালো-সাদা পোশাকের লোকজন অপেক্ষায় আছে কখন আমাদের গলা ভিজাবে, শেম্পেন আর সাদা-লাল ওয়াইন, সাথে স্নাক্স আর চকলেটে। জীবনে অল্প কয়েকবার নিজেকে ভি আই পি টাইপ মনে হয়েছে, যতদূর মনে পরে বিয়ের সময় একবার। আর বোধয় এই।
চার্টার প্লেনে করে ঘন্টা তিনেক পরে পৌছে গেলাম পুন্টা এরিনাতে, সেখান থেকে আবার বাসে করে পোর্টে। সেখানে ইমিগ্রেশন শেষ করার পর, হাতে ধরিয়ে দিলো রুমের ডিজিটাল চাবি। আমাদের নাম লেখা ওখানে, অরে অরে তাড়াতাড়ি ছবি তুলে নেই। চাবির ছবি তোলা শেষ, শারমীন তার হার ব্যাগ সাথে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে শিপে, আমি পেছনে, জাহাজে উঠার একটা ছবি থাকা দরকার, তুললাম।
জাহাজে ঢুকে কিছু ফর্মালিটিজ তো আছেই, পাসপোর্ট জমা দেয়া, কিছু কাগজ পড়তে সাইন করা, ওদিকে আবারো সাদা-কালো পোশাকে গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে, স্যার-মেডামদের গলা ভিজানো দরকার। কী আছে ভিজাইতে থাকি, চলুক। ওদিকে দুপুর পার হয়ে গেছে, পেটে ক্ষুধা। রুমে দুঃখে দেখি ওয়াও, কি সুন্দুর রুম, কতো বড়, সাথে লাগোয়া বারান্দা। ওয়াও তা একনিতেই বললাম, এর সব কিছুই আমি আগে থেকে জানি, জাহাজের খুঁটিনাটি ডিটেলস আমার আগেই জানা। তারপরো প্রথম সশরীরে এখানে। ওমা! ওদিকে আবার টেবিলে বরফ বাটি ভর্তি ছোট বালতির (বালতি বলা ঠিক হচ্ছে কিনা জানি না ) মধ্যে শেম্পেন। কতবার জীবনে কি আছে বলবো, যাই হোক আবার বললাম। পেটে ক্ষুধা থাকুক আর যাই থাকুক স্টেপ বাই স্টেপ সেলিব্রেট করে নেই। বোতল খুললাম, রুমের সেলেব্রেশন এখন শেষ, শিপে রেস্ট্রুরেন্ট ৪ টা, সবই ফাইন – ডাইনিং, অ্যামেজিং ফুড, এইগুলা আগে থেকেই জানা। শারমীন কিছু কিছু রেসেরভেশন আগেই দিয়ে রেখেছে, কিন্তু এখন কোনো একটাই গেলেই হবে। দুপুর পার হয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা, আমার “লা তেরেজা” রেস্ট্রুরেন্ট এ চলে গেলাম। সে কী আপ্যায়ন, বিয়ে বাড়ীতে বর ঢুকছে এখন খেতে বসবে, অথবা গুরুর্ত্বপূর্ণ কোনো মন্ত্রীসাহেব সরকারী সফরে ডিনারে আসছে। যাই হোক, যে যেভাবে নেয়। আমি ভাই বন্ধু মানুষ, চারপাশে যা আছে সবাই আমার দোস্ত, আমার লোগে ফর্মালিটিস বেশী দূর আগাবে না।
খেতে বসেছি, রেস্ট্রুরেন্টটা জাহাজের পিছনে, চারিদিক গ্লাস দিয়ে ঢাকা, প্যানারোমা ভিউ। এখন মনোযোগ খাবারে, কোনটা রেখে কোনটা খাবো টাইপ অবস্থা। দুজনের জন্য মোট গ্লাস রাখা আছে ৮ টা, কাটা চামচ, ছুরি, চাকু এতগুলা কেন? মানুষ তো দুজন। যায় হোক, ফাইন-ডাইনিং বা এই ধরণের জাহাজে আগামী ১৬ দিন এই চলবে। ব্যাপার গুলো মোটামুটি সবই জানা, আমি অনেক ঘাটের পানি খাওয়া মানুষ।
হটাৎ হকজন বাইরে তাকাচ্ছে, কি ব্যাপার। আমরাও দেখলাম। সে এক অদ্ভুত মুহূর্ত, আমাদের জাহাজ পোর্ট ছেড়েছে, ধীরে ধীরে মূল ভূখণ্ড দূরে সরে যাচ্ছে। আচ্ছা ওরা হর্ণ বাজাচ্ছে না কেন? বাজালে ভালো হতো, এতো নীরবে পৃথিবী ছেড়ে অন্য এক জগতে যাচ্ছি ব্যাপারটা ঠিক না। আমরা খাবার টেবিল ছেড়ে বাইরে এসে দাড়ালাম, খাবারের জন্য আমরা এখানে আসিনি, আমরা এসেছে এই শহর জনপদ ছেড়ে যাবার জন্য। আমরা যাচ্ছি, এই প্রথম সব বাধা পেরিয়ে আমাদের মনে হলো সত্যিই তো আমরা যাচ্ছি।
আগামী তিন রাত আমরা সমুদ্র পাড়ি দিবো। ড্রেক প্যাসেজ এ ঢুকে যাবো। সামনে হয়তো কিছু ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে।
এন্টার্কটিকা মানে দক্ষিণ মেরু। অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা এন্ড দক্ষিণ আমেরিকা থেকে যাওয়া যায়। সবচেয়ে সহজ পথ দক্ষিণ আমেরিকার চিলির পুন্টা এরিনা বা আর্জেন্টিনার উসুইয়া থেকে। এখন থেকেই এই শেষ মহাদেশে যাবার দুরত্ব কম। বেশীর ভাগ এক্সপেডিশন সিপিগুলো এখন থেকেই ছেড়ে যায়। এখন থেকে সমুদ্রের যে অংশ পাড়ি দিতে হয় তার নামই ড্রেক প্যাসেজ। সমুদ্রগামী সব নাবিকেরাই পৃথিবীর এই ভয়ংকর উত্তাল সুমুদ্র সম্পর্কে অবহিত। ড্রেক প্যাসেজ অনেকটা বোতলের মুখের মতো। দক্ষিণের ঠান্ডা উত্তরের উষ্ণ সমুদ্রস্রোত এখানে এসে তৈরী হয় এক লন্ড্রী মেশিন। সমুদ্র হয়ে উঠে উত্তাল। আমরা যাচ্ছি ডিসেম্বরে, বছরের এটাই সব থেকে ভালো সময় সমুদ্র পারি দেবার।ভালো বলতে কতটা ভালো তা আমাদের বোঝার বাইরে ছিলো। শারমীনের অপছন্দ জাহাজের দোলানী, আমি নিজেও যাবার আগে তাকে বলেছি এই ড্রেক প্যাসেজ -এর কথা, কিছু ইউটুব ভিডিও দেখে আমারও শংকা ছিলো। সী -সিকনেসের মেডিকেশন সাথে আছে, আমাদের ক্রুজেও যথেষ্ট ভালো মেডিকেল সিস্টেম আছে, ডাক্তার আছে।
ড্রেক বাদ দিয়েও এন্টার্টিকা যাওয়া যায়। আন্টার্কটিক পেনিনসুলাতে শেটল্যান্ড আইল্যান্ড-এ চিলির বেস আছে, সীমিত কিছু প্লেন উঠা নামা করে। কিছু এক্সপেডিশন কোম্পানী এয়ার-ক্রুজ বলে ট্রিপের ভ্রমণসূচী তৈরী করে। প্লেনে নেমে সেখান থেকে সরাসরি এন্টার্কটিকা। আমার ইচ্ছাটা ছিলো ড্রেক প্যাসেজ পাড়ি দেয়া, এন্টার্কটিকা ভ্রমণের এটা বড় একটা অংশ। এখনকার আধুনিক জাহাজগুলো আইস – ক্লাস, বরফ ভেঙে যেতে পারে, নতুন প্রযুক্তি আর আবহাওয়া সবই অভিজ্ঞ নাবিকের জানা। এধরের জাহাজের নাবিকেরা জানে কখন কীভাবে পাড়ি দিতে হবে ড্রেক। কাজেই যাবই যখন ড্রেক ধরেই যাবো।
পোর্ট ছাড়ার পর প্রথব রাত। জাহাজ মূলভূখন্ডের কাছ ঘেষে ধীরে ধীরে এগুছে। রাতে জাহাজে ডিনার, কিছু নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, আড্ডা আর শান্ত সমুদ্রের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালটা শুরু সমুদ্রের মাঝামাঝি, নাস্তা শেষ করে সিগার রুমে আড্ডা, জাহাজের এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখা করতে করতেই আমরা অফিসিয়ালি ড্রেক প্যাসেজে ঢুকলাম। জাহাজের উপরের ডেকে অবসেরভেশন ডেকে গিয়ে মাঝে মাঝে বসলাম। এই জায়গাটা সমুদ্র দেখার জন্য, ১৮০ ডিগ্রী গেল;গ্লাস দিয়ে ঘেরা, সামনের দিকটা জাহাজের মাথা দেখা যায়, সাগর কেটে জাহাজ সামনে এগুচ্ছে, যতদূর চোখ যায় শুধু নীল, দূরে এক সরলরেখায় সমুদ্র আর আকাশের নীলের বিচ্ছেদ। এই আমাদের প্রথম দিন, আজ এবং আগামীকাল এই দুদিন আমরা পাড়ি দিবো ড্রেক। সমুদ্র আর জাহাজ দুলছে খানিক, খুব বেশী টের পাওয়া যাচ্ছে না। দিন কেটে যাচ্ছে লাঞ্চ, আফটার নূন টি, ক্যাপাচিনো, আর মাঝে মাঝে কিছু ড্রিঙ্কস।
ভ্রমণবিলাসীতার এ এক অন্য রূপ। জাহাজে আছে ১৮০ জন গেস্ট, মোট ক্রু মেম্বার আছে ২১৯ জন। রুমে বাটলার আছে ২৪ ঘন্টা সার্ভিস দেবার জন্য, মেইড আসে ৩ বার রুম আর কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখার জন্য। বিকালের দিকে কিছু স্পেশাল চকলেট রাখা থাকে রুমে, সাথে পরের দিনের একটিভিটি প্ল্যান, অনেকটা ৪ পাতার নিউস পেপারের মতো, শীপেই চাপানো হয় প্রতিদিন, কারণ আমাদের আগামী ১৬ দিনের কোনো লোকেশন এন্ড প্লানইনিং ফিক্সড নয়। সব কিছুই নির্ভর করে বাইরের আবহাওয়া আর সুমুদের উপর।
শারমীন আগে থেকেই রিসারভেশন দিয়ে রেখেছিলো লা-দাম রেস্ট্রুরেন্টে। ইটা ফ্রেঞ্চ রেস্ট্রুরেন্ট, শিপে এই রেস্ট্রুরেন্টটা ছোট আকারের, কিন্তু একটু অন্যরকম। এখানে খাবার আসবে, ড্রিঙ্কস আসবে ফ্রেঞ্চ স্টাইলে। একটু ভালো ড্রেস আপ করেও যেতে হবে, রোমান্টিক ভাব নিয়ে ডিনার প্রিপারেশন। রেস্ট্রুরেন্ট একটু ভিন্ন আর ছোট হবার কারণে এখানে আগে থেকেই বুকিং দিতে হয়, কিছু এক্সট্রা ফী রাখা হয় ডিমান্ড মেইনটেইন করার জন্য। শারমীন আমি গেলাম, ভাব খানা এমন এই টাইপ রেস্ট্রুরেন্টে আমরা সপ্তাহে দু-তিন বার ডিনার করি, যাই হোক, চারপাশের কর্ম কান্ড দেখে পুরো ব্যাপারটা চলে যায় হাসির পর্যায়ে। তিন থেকে ৪ জন মিলে টেবিলে সার্ভ করবে। এক এক জনের এক এক দায়িত্ব। কমপ্লিট স্যুট পড়া লোকটা বিভিন্ন ওয়াইন-এর নাম বলে যাচ্ছে, সাজেশন দিয়ে যাচ্ছে কোন কোর্স খাবারের সাথে কোন ওয়াইন -টা ভালো হবে। বলে রাখা ভালো এখানে আমাদেরকে ৭ কোর্স খায়ানো হবে। কী সর্বনাশ। আমি এক পেলা ভাত আর সেই একই পেলায় এক তরকারী খাওয়া মানুষ। সামনে গ্লাস রাখা আছে দুজনের জন্ন্য আটটা। কি খাবো তার উপর নির্ভর করে গ্লাস থাকবে, অন্য একজন এসে বাকী গ্লাস সরিয়ে নিবে।
কি আছে জীবনে – এই থিউরি আমার সব সময়ের। আনতে থাক একটার পর একটা, যা রেকমেন্ড করবি চেকে দেখবো। সেই চেকে দেখতে দেখতে তখন দেখি চারিদিক দুলছে। না, ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টের কোনো দশ নেই, বাইরে ড্রেক তার ধারণা কিছুটা দেবার চেষ্টা করছে। ডিনার শেষে রুমে, শুয়ে পড়তে হবে, দোলানী বাড়ছে।
তার পর আর সারারাত ঘুম হয়নি তেমন, এই সেই ভয়ংকর ড্রেক, সে তার রূপ নিয়েছে। রুমে এ বাতি নেভানো, বাথরুমের বাতি জ্বালিয়ে দরজা একটু ফাঁকা ছিলো, দরজা বন্ড হয়ে গেছে। চারপাশ থেকে কিছু ঝাপসা আলো এখনও আছে। জাহাজ দুলছে, রুমের ফার্নিচার গুলোতে কচ-কচ শব্দ হচ্ছে। টিভিটা শক্ত করে লাগানো আছে, তার পরও ডান বায়ে কাপছে। আমি জানি শারমীন জেগে আছে, কিন্তু এখন আর তাকে বিরক্ত করা যাবে না। সে ঘুমাবে না, কিন্তু চুপ করে শুয়ে থাকবে, যা কিছু হবে মাথার ভেতর, এখন কোনো কথা না বলাই ভালো। সী -সিকনেস এর মেডিকেশন নেয়া আছে দুজনেরই। কিছুক্ষন পর শারমীন আর বোধয় পারলো না, সোজা বাথরুম আর বমি। বিছানা ছেড়ে বাথরুমে যাওয়া আশাটাও চ্যালেঞ্জ, ধরে ধরে যেতে হয়। তার নির্ঘুম রাত, জাহাজ সামনে পিছনে দোলার মাঝামাঝি হটাৎ হটাৎ মনে হয় শূন্যস্থানে পরে যাচ্ছে, সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাশে, শব্দ শোনা যায়, ভয় হয়। আমি ড্রেক এর কিছু রূপ দেখবো এমনটা আশা আমার ছিলো, ইচ্ছা ছিল কিছু ছবি বা ভিডিও করবো। কিন্তু সেই রাতে আর বিছানা ছাড়ার সাহস হয়নি, এখানে সোজা হয়ে হাঁটার অবস্থা নেই। আমি জানি এ জাহাজ ডোবার নয়, আমি আছি একবিংশ শতাব্দীতে, আমরাই প্রথম এন্টার্টিকা যাচ্ছি না। ভয়ের কিছু নেই, সেই ভেবেই ভাবনা আসে -আচ্ছা লোহার এই যন্ত্র যদি ডুবে যায় কী করবো। লাইফ জ্যাকেটগুলো কী বিছানার পাশে এনে রাখবো? রুমেই আছে ৪ সেট। আবার জানি এ এক অহেতুক ভয়। ফিরে এসে এখন জানি, ওই ড্রেকের জন্যই আমি এন্টার্টিকা গিয়েছি। জীবন মানেই তো অভিজ্ঞতা, কিছু গল্প যা ভোলার নয়। ড্রেকের সেই রাত মনে থাকবে। সকালের দিকে দুচোখ বুজে ঘুম আসার চেষ্টা, সমুদ্র এখন বেশ খানিকটা শান্ত, জাহাজ দুলছে কিন্তু শুধুই সামনে পিছনে, অনেকটা দোলনায় দোল খাবার মতোই অল্প কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলাম।