অবশেষে শারমীন আর আমি পৃথিবীর শেষ মহাদেশে পা ফেললাম। আমরা একসাথে আছি ১৭ বছর, পথ চলার শুরুর দিকেই এক ভয়ঙ্কর ড্রাগ আমাদের মধ্যে ঢুকে গেলো। দুনিয়া দেখতে হবে, চলে যেতে হবে যতদূর যাওয়া যায়। আমরা দুজনেই বাংলাদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা। জীবনের তাগিদ চলে আসা আমেরিকাতে। আমি আসলাম ১৯৯৯, শারমীন ২০০৫। আর অন্য দশজন প্রবাসীর মতো শুরুর দিকটা আমাদেরও ছিলো টানা হেচড়ায় পথ চলা। দেখতে দেখতে কিছু বছর পার হলো, তারপর একটু সাধ্য সামর্থ, শুরু হলো ঘর ছেড়ে বের হওয়া।
২০০৮ থেকে শুরু করে একে একে বহুদেশ, ৬ টি মহাদেশ দেখা। ২০১৬ এর দিকের ঘটনা, এক সন্ধ্যায় টিভিতে অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে কোনো এক ডকুমেন্টরি দেখতে দেখতে শারমীন বললো- আমি অ্যান্টার্কটিকা যাবো। আমি মনে মনে ভাবলাম, মহিলা বলে কী এসব। একটু খোঁজ নিলাম, যাওয়া যায়, সম্যসা একটাই, অনেক টাকার মামলা। তখনও কিন্তু আমরা বছরে অনেক ঘোরাঘুরি করি, টাকা জমিয়ে তারপর ঘোরাঘুরি। এই ঘোরাগুরিও বন্ধ রাখা যাবে না। শারমীন বললো আমি আলাদা করে টাকা জমাবো। তারপর প্রায় বছর তিনেক পর হঠাৎ সে বললো অ্যান্টার্কটিকা যাবার জন্য বেশ কিছু টাকা জমে গেছে। হিসাব করে যা বুঝলাম, অর্থেক জমেছে। কী আছে দুনিয়ায় – এই কথা মাথায় রেখে বাকী টাকা ক্রেডিট কার্ড থেকে দিয়ে দিলাম। হয়তো একবার, যাবোই যখন, যাবার মতো করে যাবো। সিলভার-সী এক্সপেডিশন ত্রুজ লাইনের সাথে এক বছর তিন মাস অগ্রিমে বুকিং শেষ করলাম।
এর পর শুরু হলো অপেক্ষার পালা, অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণের সময় ঠিক হলো ২০২০ এর নভেম্বর। বছর শুরু বিশ্বে কবিড মহামারী নিয়ে, একে একে বন্ধ হওয়া শুরু হলো চারিদিকে।
ঢাকাতে তখন মা অসুস্থ, আমার শেষ আশ্রয়, আমার মা। মায়ের অসুখটা ছিলো চলে যাবার অসুখ, মা থাকবে না, এই সত্য নিয়ে প্রতিটা দিন মুহূর্ত পথ চলা। অ্যান্টার্কটিকা ট্রিপ আপাতত বাদ দিলাম, ত্রুজ এমনিতেও বাতিল হতো কবিড এর কারনে, পরে তাই হলো। অনেকগুলো টাকা জমা দেয়া, তুলে ফেলবো কিনা ভাবতে শারমীন বললো থাক, পরের বছরের জন্য প্ল্যান করো। টাকা তুলে ফেললে খরচ হয়ে যাবে, আর যাওয়া হবে না এন্টার্কটিকা।
অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ পিছিয়ে দিলাম ২০২১ এর ডিসেম্বরে। এর মধ্যে দেশে গেলাম দুবার, ছিলাম বেশ কিছু সময় মায়ের সাথে। মা চলে গেলো ২১-শের এপ্রিলে। মা না থাকার কষ্টটা কেমন সেটা থাক আপাততঃ আমার সাথে। জীবন রহস্যময়, জীবন মানেই থেমে না যাওয়া। আমি ভালো থাকবো, মা হয়তো কোথাও থেকে দেখবে, এই যা।
অনেক চড়াই-উতরাই পারি দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু ২০২১ এর ১৯শে ডিসেম্বর। চারিদিকে এতো নিয়ম-কানুন, কবিড টেস্ট, ইন্সুরেন্স, হেলথ ডিক্লারেশন, চিলিয়ান গভর্নমেন্টের অনুমুতি -লম্বা লিস্টের এই কিছু অংশ। দুটো এয়ারপোর্ট পার হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার চিলের শেষ প্রান্তে ত্রুজশিপের পোর্ট এ পৌঁছানোর পরেও বিশ্বাস হচ্ছে না যেতে পারবো, কী পারবো না। ডিসেম্বর ২১-শের সন্ধ্যা ৬ টার দিকে সব নীতিমালা শেষ করে যখন সিলভার-সীর ডাইনিং এ বসে আছি, দেখলাম আমাদের জাহাজ পোর্ট ছেড়ে বেরুচ্ছে। এই প্রথম বুঝলাম আমরা যাচ্ছি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ।
এর পরের ১৬ দিনের গল্প না বলারই মতো। কোনো শব্দ, অনুভূতি সেই ভ্রমণকে কারো কাছে নিয়ে যেতে পারবে না। প্রথম দু-রাত পারি দিলাম ড্রেক প্যাসেজ, উত্তাল সমুদ্র। উত্তাল বলতে ভয়ংকর, ড্রেক সম্পর্কে জানতে গুগল বা ইউটুব করে কিছুটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে। ড্রেক প্যাসেজ পার হওয়াটা অ্যান্টার্কটিকারই অংশ। সমুদ্রের সেই রাত মনে থাকবে বহুদিন, শারমীন অসুস্থ হয়ে পড়লো, সী-সিকনেস।
দু-রাত পারি দিয়ে পরের এক সকাল। ঘুম থেকে জেগে পর্দা সরিয়ে রুমের পাশে বেলকনিতে যেয়ে শব্দহীন কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। আমার সামনে এক অপরিচিত জগৎ, অনেকটা -আমি কী জেগে আছি না ঘুমে, এই ভাবনা।
এর পর প্রায় সপ্তাখানেক, একে একে বেশ কিছু আইল্যান্ড আর অ্যান্টার্কটিকা মূল ভূখণ্ডে পা রাখলাম। অ্যান্টার্কটিকার ভ্রমণ গল্প, নিয়ম-কানুন, মহাদেশের প্রীতিচ্ছবি – এসব নিয়ে গল্প জুড়ে দিলে পাঠকের পথ চলা থেমে যাবে, হয়তো অবাক-বিস্ময়ে ভাববে এ এক কল্প-কাহিনী। পৃথিবীর শেষ প্রান্তের এই অংশটুকু কল্পনার মতোই, এজগৎ আমাদের নয়, এ জগৎ পেংগুইন, তিমি, সীল আর আলবাট্রস পাখিদের। সাড়া মহাদেশ জুড়ে ৭০০০ ফুট বরফের স্তর, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে, মূল ভূখণ্ডে বছরের অর্ধেক সময়ই থাকে মাইনাস (-) ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গলে গেলে সারা পৃথীবির সমুদ্র ২০০ ফুট উচ্চতায় উঠবে।
কিন্তু আমাদের কাছে এগুলো শুধুই কিছু সংখ্যা মাত্র, এটা বোঝার মতো অবস্থা আমাদের মস্তিককের বাইরে। আর সেটাই বোধহয় ভালো, অ্যান্টার্কটিকা থাকুক বাইরের এক জগৎ হয়ে। মানুষতো পৃথিবীর সব কিছুই দখল করে নিলো, কোথাও কিছু থাকুক অন্য প্রাণীকুলের জন্য, এন্টার্কটিকা থাকুক সবার ধরা ছোয়ার বাইরে।