আমার স্কুল বন্ধু রিজওয়ানের গাড়ী ছুটে চলছিল, আমি পাশে বসে চোখ বড় বড় করে অবাক বিস্ময়ে চারিদিকের পথশোভা দেখছিলাম, আড়চোখে তাকিয়ে দেখতেই বুঝলাম আমাদের গাড়ী প্রায় ৮০ মাইল গতিতে ছুটছে, আপাততঃ গন্তব্য বন্ধু’র বাসা কুপারটিনো। কিছুক্ষন আগে বন্ধুর সাথে “সেভেনটিন মাইল ড্রাইভ” দেখে আমরা ফিরছি। এই ড্রাইভে বা পথ চলায় প্রতিটি জায়গাই ছিল ছবির মত সুন্দর। এরই মাঝে এক দর্শনীয় জায়গা ছিল দেল মনতে ফরেস্টের।
‘লোন সাইপ্রেস’, প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে সুউচ্চ গ্রানাইট পাথর খন্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একাকি এক সাইপ্রেস বৃক্ষ, বয়স কমবেশী ২৫০ বছর হবে, এখনও অক্ষত রয়েছে, এক দর্শনেই যার অসীম সৌন্দর্য যে কারো হৃদয়ে জায়গা করে নিবে, তা আমি নিশ্চিত।
ফিরতি পথের প্রশস্ত রাস্তা, তারি মাঝে শত শত গাড়ী নিজেদের মধ্যে নিয়মিত দুরত্ব বজায় রেখে সুশৃংখলভাবে পথ চলে যার যার গন্তব্য বেছে নিচ্ছে। নিয়ম মেনেই পথ চলা, উঁচুনিচু পাহাড় কেটে তৈরী করা রাস্তায় একেবেকে চলা পথে হাতের বায়ে মাঝে মধ্যেই আদিগন্ত বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগরের অসীম নীল জলরাশি আমাদের দৃষ্টিতে ধরা দিয়ে আবার হারিয়ে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসছে। সাগর আর পথের অপূর্ব এই লুকোচুরি খেলা এক কথায় অসাধারন, রাস্তা তৈরীর কারিগরেরা যেনো এভাবেই অনাগত দিনের পথিকদের মন ভরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই মহাসড়ক নির্মানের পরিকল্পনায়।
পড়ন্ত বিকেলে এই হাইটেক শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো যার যার ঠিকানায় ফিরতে ব্যস্ত, তাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডও ভীষন গুরুত্বপূর্ণ তা আমার মত জাত অলসের বুঝতে কষ্ট হয়নি মোটেও। সেই ভীষন ব্যস্ততার মাঝেও বন্ধু আমাকে তার শহরের কাছে বা দূরের সুন্দর জায়গাগুলো এক এক করে ঘুরে বেড়িয়ে নিয়ে চলেছে।এই সফরের পূর্বেও আমার বেশ কয়েকবার ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে বন্ধুর নিমন্ত্রণে তার এই অনিন্দ্য সুন্দর দেশ ক্যালিফোর্নিয়াতে। যে কতকবার এই শহরে এসেছি প্রতিবারই নতুন কিছু দেখা হয়েছে, কখনও সমুদ্র
তো কখনো পাহাড়, বনভূমি, পরিষ্কার নীল আকাশ, তুষার আচ্ছাদিত পথ, টলমলে লেক, কখনো বা মিউসিয়াম, কখনো বিশাল শহরের প্রানকেন্দ্র, পৃথিবী বিখ্যাত অফিস পাড়া, শো-রুম সংগে বিখ্যাত সব রেঁস্তোরায় বিভিন্ন রকমের খাবারের স্বাদ গ্রহন। সংগে থাকে দুই বন্ধুর প্রান খুলে গল্প, আড্ডা, মাঝে মাঝে জীবন দর্শন, ‘নির্দিষ্ট সময় আর অপরিমেয় জীবন ও তার অর্থবহতা’ নিয়ে নিজেদের ভাবনাগুলোর আদান প্রদান, নিজেদের একান্ত কিছু কথা, চিন্তা ও চেতনার মিল বা অমিল সংগে হাসাহাসিতো থাকতেই হবে। এবারের ভ্রমনে সানফ্রান্সসিসকো শহরকে কেন্দ্র করে তার আঁশে পাশের দর্শনীয় স্হানগুলো ঘুরে দেখাই আমাদের লক্ষ্য।
রিজওয়ান আমার ভ্রমন নেশার ঢাকি, প্রায়শই ঢাকের বাড়ি দিয়ে আমাকে ঘর থেকে পথে নামিয়ে দেয়। সেই পথের পথিক হতে আমার বেজায় আনন্দ, পুরো বিশ্বটাই তখন আমার বিদ্যালয়। এই শহরে এসে আমার একমাত্র কাজ হলো ঘুরে ফিরে দেখে বেড়ানো। এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশন রেখা পার হওয়া পর্যন্ত আমার কাজের আওতায় পড়ে বাকি সবটুকুই বন্ধু আনন্দ চিত্তে নিজ কাধে তুলে নেয়।এই শহর আমার সম্পূর্ণ অচেনা তারপরও এই শহরের আমি চেনা অতিথি।
সূর্যের আলো কমে আসছে, মহাসাগরের পাড় ধরে ছুটে চলা রাস্তায় ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামতেই গাড়ীগুলোর পেছনের হেডলাইট জ্বলে উঠা শুরু করেছে, দূরের দিগন্ত রেখা ইচ্ছে মতো রং বদলের খেলা খেলে চলেছে, মহাসাগরের দূর সীমানায় ডুবতে বসা সূর্য একটু পরেই সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়ে পৃথিবীর উল্টো প্রান্তে ঘুম ভাংগাবে মরুময় মধ্য এশিয়ার কোন এক দেশে।
আমাদের গাড়ী এরই মাঝে মূল শহরের প্রান্তে চলে এসেছে, স্টিয়ারিংয়ে কন্ট্রোল রেখেই রিজওয়ান গাড়ীর ভেতর গান বাজানো শুরু করলো, চন্দনের গাওয়া। “হৃদয় জুড়ে যত ভালোবাসা শুধু তোমাকে, দেবো ভেবে”, সন্ধ্যার আলোয় ছুটে চলা গাড়িতে ঝকঝকে আলোকিত শহরের প্রানচঞ্চলতার সাথে গানের কথামালা আর সুর আমাদেরকে এক ভীষন অনুভূতিময় মূহুর্তে দাঁড় করিয়ে দিলো। খুব ইচ্ছে করছিল এই অনন্য সুন্দর সময়টাকে যদি কোন যাদুমন্ত্র বলে আটকে দিতে পারতাম বা প্রলম্বিত করা যেতো কি মধুরই না হতো, কিন্তু হায়, জীবন ঘড়ির অংক যে ভিন্ন, এর হিসাব অন্য পরিমাপে হয়, যাহাই সুখের তাঁহাই ক্ষনিকের, যাহাই কম স্হায়ী তাহাই স্মৃতিতে অক্ষয় অমলিন।তবে এর সন্ধান পাওয়ার পথ কিন্তু মসৃন নয়।
সব কিছুই এক সময় শেষ হতে হয়। কাল বাদে পরশু আমার দেশে ফেরার পালা, আজ রাতে স্কুলের আরেক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত আছে আমাদের।আমরা রিজওয়ানের বাসা কুপারটিনো থেকে তার বউ শারমিনকে তুলে নিয়ে এক সংগে যাবো সেই দাওয়াতে, ওদিকটায় রাববুর বউ টিনা রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত আমাদের সবার জন্য।
হাইটেক শহরের ব্যস্ততাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে ছুটে চলা গাড়ীর ভেতর আমরা দুই বন্ধু, চন্দনের গানের সাথে মনের আনন্দে গলা মিলিয়ে গান গেয়েই চলেছি, একবার দুবার করে বার চারেক একই গান, “হৃদয় জুড়ে যত ভালোবাসা শুধু তোমাকে দেব ভেবে…’ আর চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছিল প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে নীরব ভূমিতে বছরের পর বছর একাকী দাঁড়িয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর লোন সাইপ্রেসের নিঃসঙ্গতা।